তিস্তার চরে পরিবেশবান্ধব সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র, বদলে যাবে উত্তরবঙ্গ

নিজস্ব প্রতিবেদক
ইনিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত: বুধবার ২৫শে অক্টোবর ২০২৩ ০৮:৫৯ অপরাহ্ন
তিস্তার চরে পরিবেশবান্ধব সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র, বদলে যাবে উত্তরবঙ্গ

তিস্তার বুকে জেগে ওঠা দুর্গম বালু চরে গড়ে উঠেছে দেশের সবচেয়ে বড় ও এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র ‘তিস্তা সোলার লিমিটেড’। প্রতিদিন গড়ে ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে এখান থেকে। যা অবদান রাখছে স্থানীয় ও জাতীয় অর্থনীতিতে। আর এতেই বদলে যেতে পারে গোটা উত্তরবঙ্গের চিত্র বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। 


গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার তারাপুর ইউনিয়ন এবং কুরিগ্রামের কোল ঘেষা চর খোর্দা গ্রামের বিস্তীর্ণ বালু চরের ৬০০ একর জমির ওপর স্থাপন করা হয়েছে এই পাওয়ার প্লান্ট। বসতভিটা থেকে অনেক দূরে হওয়ায় কোনো কাজেই লাগানো যেত না এসব জমি। সেই জমি এখন আলোর উৎস হয়েছে গোটা দেশের জন্য। 


স্থানীদের দাবি, এত বড় একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হলেও সেখানে যোগাযোগের ক্ষেত্রে নির্মিত রাস্তা-ঘাটগুলোর তেমন উন্নয়ন হয়নি।


সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ধু ধু বালুচরে বসানো রয়েছে সোলার প্যানেলগুলো। সারি সারি করে বসানোর কারণে দূর থেকে কালো রঙের সৌর প্যানেলগুলো অনেকটাই সাদা বালুচরে কালো রঙের গালিচার মতো মনে হয়। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির চারিদিকে নিরাপত্তার জন্য উঁচু করে কাঁটা তারের বেড়া দেওয়া হয়েছে। এর ভেতরই গোটা সোলার প্যানেলটির কার্যক্রম চলছে।


প্রত্যেকটি প্যানেলের আলাদা আলাদা সংযোগ রয়েছে। নিরাপত্তা, বিদ্যুৎ কন্ট্রোল কক্ষ আর সার্বিক ব্যবস্থাপনা করতে তিনটি আলাদা আলাদা অফিস রয়েছে। অফিসের কাজ ভেদে কক্ষের সংখ্যা কমবেশি ৮০টির মতো। এসব অফিসে যোগাযোগ করতে রয়েছে পরিপাটি পাকা রাস্তা। নামাজ আদায়ের জন্য রয়েছে মসজিদ। বেশ নিরিবিলি পরিবেশেই চলছে এই বিশাল কর্মযজ্ঞ। রাস্তার পাশেই রাখা হয়েছে সোলার প্যানেলের জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন উপকরণ।


তিস্তা সোলার লিমিটেড কতৃপক্ষের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, সুন্দরগঞ্জ উপজেলার তারাপুর ইউনিয়নের লাটশালা ও চরখোর্দ্দা গ্রামে ২০১৭ সালে সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কাজ শুরু করা হয়। পর্যায়ক্রমে ‘তিস্তা সোলার লিমিটেড’ নামে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি গড়ে তোলে বেক্সিমকো গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো পাওয়ার লিমিটেড। নির্মাণ কাজ শেষ হলে চলতি বছরের ২ আগস্ট রংপুর সফরে এসে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরিবেশবান্ধব এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে প্রতিষ্ঠানটির ব্যয় হয়েছে প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলার। গত বছরের ডিসেম্বর এ কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত দৈনিক ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যোগ হচ্ছে রংপুর গ্রিড হয়ে জাতীয় গ্রিডে। প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ১৩ দশমিক ৯৩ টাকা চুক্তি মূল্যে জাতীয় গ্রিডে দেওয়া হচ্ছে।  


বিদ্যুৎ কেন্দ্রে জমি বিক্রেতাদের একজন একরাম হোসেন বলেন, ‘এই জায়গাটি ছিল ধু ধু বালুচর। ফসল না হওয়ায় খুব বেশি প্রয়োজন না থাকলে এখানে কেউ যেতেন না। সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্রটি হওয়ায় কারণে এখানে এখন রাস্তাঘাট হয়েছে। বসতি গড়ে উঠেছে। নতুন নতুন দোকানপাট হচ্ছে। লোক সমাগম হচ্ছে। তাই নানামুখী ব্যবসা বানিজ্যের প্রসার হচ্ছে।’


স্থানীয় বাসিন্দা আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘বিদ্যুৎকেন্দ্রটি আসার পর এখানে আমার নিরাপত্তারক্ষীর চাকরি হয়। একসময় এসব এলাকার জমির তেমন কোনো দাম ছিল না। জমি ভেদে এক শতক জমি ২ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত দামে বিক্রি হয়েছে। এসব অনাবাদি জমি থেকে মোটা অংকের টাকা পেয়ে এলাকার অনেকেই এখন স্বাবলম্বী।’ 


তিস্তা সোলার লিমিটেডে যাওয়ার পথেই বাঁধের ওপর ভাতের হোটেল করেছেন জসিম মিয়া। রাইজিংবিডিকে তিনি বলেন, ‘আগে বেকার বসে ছিলাম। হঠাৎ করেই মাথায় এলো, এই বাঁধ দিয়েই আলীবাবা থিমপার্ক (বিনোদন কেন্দ্র) এবং বিদ্যুৎকেন্দ্রে বহু লোক যাতায়াত করছেন। সেই চিন্তা থেকেই পরিবারের পরামর্শে ভাত-তরকারির হোটেল দেই। আলহামদুলিল্লাহ ভালোই চলছে।’ 


সুন্দরগঞ্জে এমন বৃহৎ প্রকল্পের বিষয়ে মতামত জানতে চাইলে সুন্দরগঞ্জ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল আলম সরকার লেবু বলেন, ‘শুধু জাতীয় পর্যায়ে নয় প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হওয়ায় স্থানীয়দের জীবন-জীবিকাতেও গতি এসেছে। লোডশেডিং নেই বললেই চলে। উৎপাদিত বিদ্যুতের একটি নির্দিষ্ট অংশ সুন্দরগঞ্জসহ উত্তরবঙ্গের (রংপুর) পিছিয়ে পড়া এলাকাগুলোর জন্য বরাদ্দ দিলে ভালো হতো। এটা করতে পারলে এলাকার শতশত মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।’ 


তিস্তা সোলার লিমিটেডের সিনিয়র নির্বাহী কর্মকর্তা (জমি অধিগ্রহণ) সুজা আহমেদ বলেন, ‘৮৫টি মাউন্টিং পাইলসের ওপর বসানো হয়েছে প্রায় ৫ লাখ ৬০ হাজার সৌর প্যানেল। এসব সৌর প্যানেল থেকে ১২০টি ইনভার্টারের মাধ্যমে প্রতিদিন ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। এজন্য ২৮টি বক্স ট্রান্সমিশনে সংযোগ স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে সাবস্টেশনসহ ১৩২ কেভিএ ট্রান্সমিশন টাওয়ার নির্মাণ এবং জাতীয় গ্রিডে সংযুক্তির জন্য তিস্তা পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে রংপুর পর্যন্ত তৈরি করা হয়েছে ১২২টি টাওয়ারের ৩৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার লম্বা সঞ্চালন লাইন। এ লাইনের মাধ্যমেই সুন্দরগঞ্জের তিস্তাপাড়ের কেন্দ্রটি থেকে রংপুর গ্রিড সাবস্টেশনে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে।’


তিনি আরও বলেন, 'ভবিষ্যতে পরিবেশবান্ধব আরও সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের। বিদ্যুৎ সরবরাহ নিরবিচ্ছিন্ন করতে পারলে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে। আমাদের এ উদ্যেগ কর্ম সহায়ক পরিবেশ তৈরির পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টিতেও ভূমিকা রাখবে।’