মৌলভীবাজারে বন্যা আক্রান্ত প্রায় তিন লাখ মানুষের চরম দুর্ভোগ অব্যাহত রয়েছে। বন্যাকবলিত ছয় উপজেলার অধিকাংশ গ্রামীণ রাস্তা, বাড়িঘর ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তলিয়ে গেছে। এ ছাড়া মৌলভীবাজার রাজনগর উপজেলার কদমহাটা মনো নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ ভাঙ্গন কুলাউড়া-সিলেট সড়ক এবং সড়কপথে সিলেটের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থাও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ছয় উপজেলার প্রায় ৩ লাখ মানুষ বন্যার পানিতে দুর্ভোগ নিয়েই দিনাতিপাত করছেন।
জেলা প্রশাসন সুত্রে জানা যায়, মৌলভীবাজার জেলার ৪০ ইউনিয়নের ৪৫০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। জেলায় মোট ৯৮টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এখন পর্যন্ত আশ্রয়কেন্দ্রে গেছেন প্রায় ৫ হাজার মানুষ।
বন্যার্তদের সহায়তায় ১০৫০ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ২৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বন্যা, নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে চাল ও নগদ অর্থ বিতরণের ব্যবস্থা নিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
জেলার কমলগঞ্জে ধলাই নদীর তিনটি স্থানে বাঁধ ভেঙে নতুন করে প্লাবিত হয়েছে বিস্তির্ণ এলাকা। কমলগঞ্জে ধলাই নদীর সদর ইউনিয়নের চৈতন্যগঞ্জ এলাকায়, রহিমপুর ইউনিয়নের চৈত্রঘাট ও মুন্সীবাজার ইউনিয়নের খুশালপুর গ্রামে ধলাই নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙন দিয়ে পানি প্রবেশ করে ৪০টি গ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকার ফসলি জমি ডুবে গেছে।
মৌলভীবাজারের রাজনগরে মনু নদ প্রকল্প বাঁধের একাধিক স্থান ভেঙে গেছে।
মনু ও ধলাই নদীর বাঁধের ১৯টি স্থান ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। নতুন করে প্লাবিত হয়েছে কুলাউড়া পৌরসভার তিনটি ওয়ার্ড। এছাড়াও বন্যার পানি প্রবেশ করেছে কুলাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, কুলাউড়া উপজেলা পরিষদ ও জুড়ী উপজেলা পরিষদে।
বড়লেখা উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এসব গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে পানি উঠেছে। এতে প্রায় লাখো মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ঘরে টিকতে না পেরে অনেকে আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটছেন। এছাড়া বিভিন্ন এলাকার গ্রামীণ রাস্তা পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে।
মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্য অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার সকাল ৯টার আপডেট অনুযায়ী জেলার মনু নদী (রেলওয়ে ব্রীজ) বিপদসীমার ১০৫ সে.মি, চাঁদনীঘাট এলাকায় ১১৫ সে.মি, ধলাই নদীতে ৩২ সে.মি ও জুড়ী নদীতে বিপদসীমার ১৯০ সে.মি উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কুশিয়ারা নদীর পানি বিপদসীমার ৫ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
স্থানীয়রা জানান, টানা ভারী বর্ষণ ও ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে মৌলভীবাজারের বন্যা পরিস্থিতি চরম অনতির দিকে যাচ্ছে। জেলার পাঁচটি নদ-নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে নদ-নদীর ভাঙনে প্লাবিত হয়েছে জেলার সদর, রাজনগর, কমলগঞ্জ, কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলার শতাধিক গ্রাম।
গতকাল রাতে কমলগঞ্জ উপজেলায় নতুন করে ধলাই নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধে ভাঙন দেখা দেয়। এতে নতুন করে আরও কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়। অপরদিকে মনু নদীর টিলাগাঁও প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে তলিয়ে গেছে কুলাউড়া উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রাম। মনু নদীর ভাঙনে রাজনগর উপজেলার টেংরা, কামারচাক, মনসুরনগর, রাজনগর সদর ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়ে গেছে।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মোহম্মদ ছাদু মিয়া জানান, ‘এখন পর্যন্ত আশ্রয়কেন্দ্রে গেছেন প্রায় ৫ হাজার মানুষ। বন্যার্তদের সহায়তায় ১০৫০ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ২৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
মৌলভীবাজারের পুলিশ সুপার মো. মনজুর রহমান জানান, শহর রক্ষায় ও মানুষের জানমাল রক্ষা করতে অতিরিক্ত পুলিশ নিয়োগ করা হয়েছে।
শ্রীমঙ্গল ৪৬ ব্যাটেলিয়নের অধিনায়ক লেঃ কর্ণেল মোহাম্মদ মিজানুর রহমান সিকদার জানান, ‘বিজিরি পক্ষ থেকে জেলার বিভিন্ন প্লাবিত এলাকায় ত্রান দেওয়া হচ্ছে। বিজিবি সব সময়ই সমাজের দরিদ্র এবং বিপন্ন মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ভবিষ্যতেও এই কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে বলে বলে বিজিবি পক্ষ থেকে জানানো হয়।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) মৌলভীবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী জাবেদ ইকবাল জানান, মৌলভীবাজার জেলায় ভয়ানকভাবে পানি বাড়ছে। মনু, কুশিয়ারাসহ সব নদীর পানি বিপদসীমা দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আমরা বিভিন্ন এলাকায় জিও ব্যাগ ফেলে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে চলেছি। তবে ধলাই নদীর পানি কিছুটা কমেছে। উজানে ভারত অংশে বৃষ্টি না হলে পানি কমতে শুরু করবে। ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলো মনিটরিং রাখা হচ্ছে। এ ছাড়া যেসব স্থানে বাঁধ ভেঙেছে সেগুলোতে কাজ চলছে। জেলা প্রশাসক, পুলিশ, বিজিবি, সড়ক, জেলা ত্রাণ ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা মাঠে তৎপর রয়েছেন।
এদিকে বিএনপি, জামাত, খেলাফত মজলিস, ছাত্রশিবির, ছাত্র মজলিস, বরুণা মাদরাসা কর্তৃপক্ষসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ব্যক্তি উদ্যোগ এবং স্বেচ্ছাসেবি সংগঠনের নেতাকর্মীরা পানিবন্দি মানুষ উদ্ধার ও ত্রাণ সহায়তা কাজে সক্রিয় রয়েছেন।
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।