একজন শিক্ষার্থীর প্রকৃত শিক্ষা চর্চা শুরু হয় স্কুল জীবন থেকে। একজন শিক্ষক শুধু পাঠদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেননা। প্রকৃত মানুষ গড়ার মহান কারিগরও। সন্তানদের কাছে মা-বাবা প্রথম শিক্ষক। কিন্তু এর পর যিনি একজন সন্তানকে আদরমাখা শাসন, ভালোবাসা ও পরম মমতায় আগলে রেখে যোগ্য মানুষ হিসেবে করে তুলতে ভূমিকা রাখেন তিনি হলেন পরম শ্রদ্ধার ও ভালোবাসার মায়া ভরায় শিক্ষক। একজন আদর্শ শিক্ষক এর শিক্ষাদান শিক্ষার্থীকে আদর্শ ও নীতিবান মানুষ হিসেবে গড়ার ক্ষেত্রে রয়েছে অপরিসীম ভূমিকা । যা পরিমাপ যোগ্য নয়। একজন শিক্ষার্থী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা গ্রহণ শেষ করে ভর্তি হয় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। শিক্ষা জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হচ্ছে মাধ্যমিক বিদ্যালয়।
আমার শিক্ষাগুরু নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার মালশন-গিরিগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক প্রিয় আব্দুল হামিদ স্যার। ২০০২ সালে প্রাথমিক শিক্ষা জীবন শেষ করে মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হই।
তখন আব্দুল হামিদ স্যার ছিলেন স্কুলটির সহকারী শিক্ষক। সে সময় আমাদের গণিতের শিক্ষক ছিলেন তিনি। ক্লাসে যখন প্রবেশ করতেন তখন শুরুর দিকে খুব ভয় অনুভব করতাম। মনে হতো স্যার অনেক রাগী একজন মানুষ। আমাদের অনেক সহপাঠীরা ভয়ে পিছনের বেঞ্চে বসতো । মাঝে মাঝে আমিও সেটাই করতাম। পড়া হোক বা না হোক খুব ভয় অনুভব করতাম। তাছাড়া সবাই মিলে দুষ্টুমীতে কম এগিয়ে ছিলামনা। যার কারনে স্যার অনেকবার কড়াভাবে শাসনও করেছেন স্যার।
তবে কিছুদিন পর নিজ থেকেই একটা পরিবর্তন অনুভব করলাম নিজের মধ্যে। আর স্যারের প্রতি ভুল ধারনা ও ভয় মনের ভিতর থেকে দূর হতে লাগলো। কারন স্যারের পাঠদানের ধরণ, আদরমাখা শাসন ও প্রকৃত শিক্ষার গুরুত্ব এমনভানে আমাদের বোঝানো হচ্ছিল যার কারনে দিন যতই যাচ্ছিল ততই যেন স্যারের ভক্ত হয়ে যাচ্ছিলাম। শুধু পাঠদানের মধ্যেই সীমাবন্ধ ছিলেননা স্যার। একজন প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে স্যারের নিরলস প্রচেষ্টা ছিল। ক্লাসের মাঝেই পাঠ্য বইয়ের বাহিরে স্যার শিখিয়েছেন অনেক কিছুই। জীবন গড়ার ক্ষেত্রে দিয়েছেন নানা ধরনের পরামর্শ, যা জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে গভীরভাবে অনুভব করছি।
একদিন ক্লাসে প্রিয় আব্দুল হামিদ স্যার বলছিলেন, তোমরা শিক্ষা জীবন শেষে চাকরি করে শুধু নিজের ও পরিবারের চাহিদা মেটানোকে বড় প্রাপ্তি ভাববেনা। মনোনিবেশ করতে হবে সমাজ ও রাষ্ট্রের মঙ্গলের জন্য কিছু করার। বড় বড় ডিগ্রী অর্জন করে অনেকেই নিজের আখের গোছানোর পাশা-পাশি দূনীর্তিতে লিপ্ত হয়ে পড়ে। ক্ষমতার বড়াই দেখিয়ে অনন্যের ক্ষতি সাধনে লিপ্ত থাকে । অহংকার করে চারপাশের মানুষগুলোকে ছোট করে। তাহলে সেই শিক্ষার কি মূল্য থাকে। আর শুধু চাকরির পেছনে না ছুটে প্রকৃত শিক্ষা ও সুপ্ত মেধাকে কাজে লাগিয়ে অনেক কিছুই করা যায়। যেমন ব্যবসা বা উদ্যোগতা হওয়া। যার মাধ্যমে নিজের ও অন্যদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। চাকরি না পেলে যেন কেউ ভেঙ্গে পড়োনা। রিজিক,সাফল্য ও সন্মানদানকারী মহান সৃষ্টিকর্তা।
এসএসসি পরীক্ষার আগে মাধ্যমিক স্কুল জীবনের শেষ ক্লাসে স্যার বলেছিলেন, কখনো হতাশ হইয়োনা, ভুল পথে পা বাড়িয়ে নিজেদের সুন্দর ভবিষৎ শেষ করোনা। পরিবারের স্বপ্ন নষ্ট করোনা। সৃষ্টিকর্তার উপর ভরসা রেখে ধৈর্য্য ধারন করে চেষ্টা চালিয়ে যাবে। চেষ্টা,শ্রম ও সাধানা জীবনে সাফল্য এনে দেয়। মনে রাখবে সৎ পথে সকল কর্মই পরম সন্মান ও তৃপ্তির। অন্যায়ের কাছে কখনো মাথা নত করবেনা, অন্যায় পথে নিজেকে বিলিয়ে দিবেনা। বেশি প্রাপ্তির আঙ্খাকা যেন মনে ভর না করে। চলার মত অর্থ ও খ্যাতির মাঝেও জীবন কাটিয়ে দেয়া যায়।
সেই স্কুল জীবনে স্যারের কথাগুলো আজও মনে খুব করে নাড়া দেয়। জানিনা স্যারের বাস্তবধর্মী কথাগুলো কতটা মেনে চলতি পারছি। তবে শিক্ষা জীবন শেষে চেষ্টা করছি চলমান জীবন খেয়ার পথে নিজের পেশাগত কাজের মাধ্যমে চারপাশের মানুষের সমস্যা ও সম্ভবনাগুলোর কথা তুলে ধরতে। অনেক টাকার মালিক হইনি, দামি গাড়ি নেই, দামি বাড়িও নেই। সাধামাটা ভাবেই চলে যাচ্ছে প্রতিটি দিন।
স্যারের সাথে মাঝে মাধ্যে দেখা হলেই প্রথমে মৃদু হাঁসি দিয়ে বলে কেমন আছো বাবা। একজন গণমাধ্যমকর্মী তুমি চেষ্টা করে যাচ্ছো ভালো কাজ করার, সমাজ ও রাষ্ট্রের মঙ্গল যেন হয় সেভাবেই কাজ করে যাও। চালিয়ে যাও বাবা তবে বিতর্কে জড়াবেনা, অন্যায়ের কাছে মাথা নত করবেনা। আমার দোয়া রইলো তোমার জন্য সব সময়। প্রিয় স্যার আরও একবার আপনার ক্লাসের ছাত্র হতে চাই। প্রিয় স্যার আপনার মত করে এমন প্রশান্তিদায়ক কথা কেউ বলেনা, অনেকই আপনার মত করে ভাবতে চায়না। চারপাশে যেন স্বার্থের বেড়াজাল। মন চায় আবারও আপনার ক্লাসের ছাত্র হয়ে পাঠদান গ্রহন করি এবং আপনার মুখ থেকে বাস্তবধর্মী কথাগুলো মন ভরে শুনি। খুব মিস করি স্যার হৃদয়ের গভীর থেকে আপনাকে। আপনি ভালো থাকবেন সব সময়। মহান সৃষ্টিকর্তা আমার শিক্ষাগুরুকে সুস্থ ও নিরাপদে রাখুন সব সময়। সকল শিক্ষাগুরুদের প্রতি রইলো শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
- লেখক, রিফাত হোসাইন সবুজ , যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, জেলা সাংবাদিক ইউনিয়ন, নওগাঁ।
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।