জাতির পিতা হত্যার নেপথ্যে

নিজস্ব প্রতিবেদক
ইনিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত: মঙ্গলবার ১৫ই আগস্ট ২০২৩ ০৪:৪৮ অপরাহ্ন
জাতির পিতা হত্যার নেপথ্যে

বাঙালীর শুদ্ধনাম শেখ মুজিবুর রহমান। বিখ্যাত সাংবাদিক সেরিল ডান বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বলেছেন, “In the thousand years history of Bangladesh, Sheikh Mujib is the only leader who has, in terms of blood, race, language, culture and birth, been a full- blood Bengali." ডানের এই উক্তিতে প্রকাশ পায় যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাংলার হাজার বছরের ইতিহাসে একমাত্র নেতা যিনি পরিপূর্ণভাবে ভাবে বাঙ্গালী চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য ধারণ করেন। আজন্ম বঙ্গবন্ধু এই পরিচয় বহন এবং  প্রসারিত করেছেন।  


বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বের সবচেয়ে বড় সার্থকতা বাঙালি জাতিকে স্বাধীন রাষ্ট্রীয় সত্তায় উদ্ভাবন করা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এমন একজন নেতা ছিলেন যিনি বিশ্বের বুকে একটি জাতিসত্তাকে অমর করেছেন। যিনি বিশ্বের বুকে এঁকেছেন একটি মানচিত্র, দিয়েছেন জাতীয় পতাকা, এক বছরের ব্যবধানে দিয়েছেন একটি সার্বভৌম সংবিধান। যিনি তার রাজনীতির শুরুতে আন্দোলন - সংগ্রামের মাধ্যমে আদায় করেছেন বাঙালি জাতির ভাষার অধিকার। যেটি বিশ্বের বুকে একটা বিরল ঘটনা। যিনি অধিকার আদায়ের জন্য প্রতিষ্ঠা করেছেন একটি ছাত্র সংগঠন। ঐতিহাসিক ছয় দফার - যেটাকে বলা হয় "বাঙালির মুক্তির সনদ"- র প্রতি তাঁর বিশ্বাসের ভিত্তি ছিল বাঙালির প্রতি গভীরতম ভালোবাসার প্রকাশ।


‘বাংলা আমার ভাষা। বাংলার মাটি, আমার মাটি। বাংলার কৃষ্টি, বাংলার সভ্যতা আমার। আমি বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করি।’ (১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩,চাঁদপুরে দেওয়া ভাষণ)। এটি ছিল বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাসের ভিত্তি। মননে মগজে, চলনে বলনে যিনি ছিলেন একজন পুরাদস্তুর বাঙালি। বঙ্গবন্ধুর হাত দিয়েই প্রতিষ্ঠিত ও স্থায়ী রূপ লাভ করে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি। 


ঐ ভিত্তি ভেঙ্গে দেয়ার লক্ষেই সংঘটিত হয়েছিল ১৫ই আগস্টের হত্যাকাণ্ড। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেশে কালজয়ী মহানায়কদের অনেকেরই প্রাণ দিতে হয়েছে কিংবা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। বিশ্বে রাজনৈতিক হত্যার অন্যতমগুলো হলো ভারতের মহাত্মা গান্ধী, রাজীব গান্ধী, চিলির সালভাদর আলেন্দে, যুক্তরাষ্ট্রের আব্রাহাম লিংকন, মার্টিন লুথার কিং ও জন এফ কেনেডি, মিয়ানমারের জেনারেল অং সান ও সিংহলের প্রধানমন্ত্রী সলোমন বন্দর নায়েক, ঘানার নক্রুমা, ইন্দোনেশিয়ার আনোয়ার সাদাতসহ আরও অনেকে। কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডর মধ্যে একাধিক করনে যেটি সবচেয়ে বর্বরোচিত সেটি হচ্ছে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তার পরিবারের সদস্যদেরকে হত্যাকাণ্ড। এটি শুধু একটা রাজনৈতিক ব্যক্তির হত্যাকাণ্ড না, এটি হচ্ছে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে তার পরাধীনতায় ফিরিয়ে নেওয়া এবং নব্য উদ্ভাসিত জাতিসত্তা যা বিশ্বে সদ্য প্রকাশ পেয়েছিল, সেই জাতিসত্তার পরিচয় মুছে ফেলার জন্য এই হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়েছিল। তাই এটি নিঃসন্দেহে বলা যায় এই হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে বিশ্বের বুক থেকে বাঙ্গালী জাতিগোষ্ঠী ও জাতিসত্তার সমূলে ধ্বংস করার অপপ্রয়াস চালানো হয়েছিল। এই ধারনা পরিষ্কার হয় বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর এই হত্যার মাস্টারমাইন্ড ও পরবর্তী সুবিধাভোগী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে।


পরাস্ত পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের ষড়যন্ত্রের নৃশংস শিকার হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবার তথা মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শ ও চেতনা। এই শোকের মাসেই বাঙালীর স্বাধীনতার স্থপতির বুকের তাজা রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল স্বাধীন শ্যামল বাংলার মাটি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহতম ও নৃশংসতম (অ) - রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিল । সেই অন্ধকার ভোরের ঘটনা এই বিশ্বাস প্রমাণিত করে। কিভাবে সংঘটিত হল সর্বকালের সর্ব শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালীর উপর ইতিহাসের সবচেয়ে বর্বরোচিত এই হত্যাকাণ্ড? সেটা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।         


অন্য দিনের মত সেদিনও রাত ৮টার দিকে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে ফেরেন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান। অন্যদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে সেনাবাহিনীর টু—ফিল্ড রেজিমেন্টের যানবাহনগুলো সচল হয়ে ওঠে। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের দক্ষিণের একটি ইউনিট থেকে ১০৫ মিলিমিটার কামানগুলোকে ভারী ট্রাক দিয়ে টেনে কুর্মিটোলায় নির্মাণাধীন বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়া হয় নিয়মিত নৈশ প্রশিক্ষণের জন্য। রাত সাড়ে ১১টার দিকে মেজর শরিফুল হক ডালিম, মেজর এস এইচ এম বি নূর চৌধুরী, ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ বজলুল হুদা, মেজর শাহরিয়ার রশিদ, মেজর আজিজ পাশা, মেজর রাশেদ চৌধুরী প্রমুখ সেখানে জড়ো হন এবং ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পনা করে ন্যাকারজনক হত্যাকাণ্ডের।


১৫ আগস্ট প্রথম প্রহরে মেজর সৈয়দ ফারুক রহমান অফিসারদের নির্দেশ দেন, বিমানবন্দরের কাছে হেড কোয়ার্টারে স্কোয়াড্রন অফিসে মিলিত হতে হবে। অপারেশনের দায়িত্বে ছিলেন ফারুক। বঙ্গবন্ধুর বাসায় আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে ধানমণ্ডিতে শেখ ফজলুল হক মণি এবং আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাসাতেও আক্রমণের সিদ্ধান্ত হয়। মেজর ডালিম সেরনিয়াবাতের বাসায় আক্রমণের দায়িত্ব নেন। শেখ মণির বাসায় আক্রমণের দায়িত্ব দেওয়া হয় রিসালদার মোসলেমউদ্দিন খানকে। তার সঙ্গে দেওয়া হয় দুই প্লাটুন সৈন্য। এক কোম্পানি সেনাসহ রেডিও স্টেশন, বিশ্ববিদ্যালয় ও নিউ মার্কেট এলাকার দায়িত্বে থাকেন মেজর শাহরিয়ার। পিলখানায় বিডিআরের তরফ থেকে কোনো ধরনের আক্রমণ হলে তা প্রতিহত করার দায়িত্বও ওই গ্রুপকে দেওয়া হয়। ২৮টি ট্যাংক নিয়ে শেরে বাংলা নগরে রক্ষীবাহিনীকে প্রতিহত করার দায়িত্ব নেন মেজর ফারুক নিজে।


মেজর এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রমণের জন্য ১২টি ট্রাকে সাড়ে তিনশ সাধারণ সৈনিককে তৈরি করা হয়। মেজর রশিদের দায়িত্ব ছিল হত্যাকাণ্ড পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দেওয়া এবং সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি সমন্বয় করা। তার নেতৃত্বে থাকা ১৮টি কামানে গোলা ভর্তি করে যুদ্ধাবস্থার জন্য তৈরি রাখা হয়। কামানগুলো রক্ষীবাহিনীর হেড কোয়ার্টার এবং বঙ্গবন্ধুর বাসার দিকে তাক করা হয়। দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার পর সবাইকে তাজা বুলেট দেওয়া হয়। ঘাতকের দল বিমানবন্দর এলাকা থেকে ভোররাত ৪টার দিকে ধানমণ্ডির উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে।


ভোর সোয়া ৫.১০ মিনিটে ঘাতকরা আক্রমণ করে শেখ ফজলুল হক মণি’র বাসায়। রিসালদার মোসলেউদ্দিনের স্টেনগানে ঝাঁঝরা হয়ে যান বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মণি ও তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি। ১৫ আগস্টে প্রথম শহীদ হন বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও বিশিষ্ট সাংবাদিক শেখ ফজলুল হক মণি। শেখ মণি’কে বাঁচাতে তাঁর সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন স্ত্রী আরজু মণি।


 মোসলেউদ্দিনের স্টেনগানে শেখ ফজলুল হক মণি'র বুকে, গলায় ও থুতনিতে তিনটি গুলির চিহ্ন ছিল। আর আরজু মণি'র পেট ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল। প্রাণে বেঁচে যান শেখ মণির ছেলে শেখ ফজলে শামস পরশ ও শেখ ফজলে নূর তাপস।


ভোর ৫.১৫ মিনিটে আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাসায় হামলা করে। মেজর ডালিমের নেতৃত্বে হত্যা করা হয় আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার ১৪ বছর বয়সী মেয়ে বেবী, ১০ বছরের ছেলে আরিফ, চার বছরের নাতি সুকান্ত বাবু (আবুল হাসনাত আবদুল্লার ছেলে), ভাতিজা শহীদ সেরনিয়াবাত, ভাগ্নে আবদুল নইম খান রিন্টু (আওয়ামী লীগ নেতা আমীর হোসেন আমুর খালাতো ভাই), তিন অতিথি এবং চারজন গৃহকর্মীকে।


ভোররাত ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িটি আক্রান্ত হওয়ার আগেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর আত্মীয় ও মন্ত্রিসভার সদস্য আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও ভাগ্নে যুবনেতা, শেখ মণির বাসা আক্রমণের  খবর পান। যেনো সময়ের চেয়ে দ্রুত ঘটতে থাকে সবকিছু। বঙ্গবন্ধু নিচতলায় তার ব্যক্তিগত সহকারী এ এফ এম মহিতুল ইসলামকে টেলিফোন করে বলেন, সেরনিয়াবাতের বাসায় দুষ্কৃতিকারীরা আক্রমণ করেছে। জলদি পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ফোন করতে হবে। পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ফোন করে কোনো সাড়া না পেয়ে মহিতুল গণভবন (তৎকালীন রাষ্ট্রপতির কার্যালয়) এক্সচেঞ্জে চেষ্টা করতে থাকেন। ভোর সাড়ে ৫টার দিকে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির রক্ষীরা বিউগল বাজিয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন শুরু করা মাত্র বাড়ির দক্ষিণ দিক থেকে সরাসরি আক্রমণ শুরু হয়।


এরমধ্যেই বঙ্গবন্ধু তার ঘরের দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে আসেন। ঘটনা শুনে শার্ট—প্যান্ট পড়ে নিচতলায় নামেন শেখ কামাল। সুলতানা কামাল আসেন দোতলা পর্যন্ত। শেখ জামাল তার স্ত্রীকে নিয়ে দোতলায় ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের কক্ষে যান। ওদিকে গোলাগুলির মধ্যে অভ্যর্থনা কক্ষে বঙ্গবন্ধুর সামনেই বিভিন্ন জায়গায় ফোন করতে থাকেন মহিতুল। পুলিশ কন্ট্রোল রুম ও গণভবন এক্সচেঞ্জে চেষ্টার এক পর্যায়ে রিসিভার নিয়ে বঙ্গবন্ধু নিজেই বলেন, “আমি প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব বলছি ...”। বঙ্গবন্ধু তার কথা শেষ করতে পারেননি। একঝাঁক গুলি জানালার কাচ ভেঙে অফিসের দেয়ালে লাগে। কাচের এক টুকরোয় মহিতুলের ডান হাতের কনুই জখম হয়। ওই জানালা দিয়ে গুলি আসতেই থাকে। বঙ্গবন্ধু টেবিলের পাশে শুয়ে পড়েন এবং মহিতুলের হাত ধরে কাছে টেনে শুইয়ে দেন।


এর মধ্যেই গৃহকর্মী আব্দুলকে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে তার পাঞ্জাবি ও চশমা পাঠিয়ে দেন ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। কিছুক্ষণ পর গুলি থেমে গেলে বঙ্গবন্ধু উঠে দাঁড়িয়ে আব্দুলের হাত থেকে পাঞ্জাবি আর চশমা নিয়ে পরেন। নিচতলার ওই ঘর থেকে বারান্দায় বের হয়ে বঙ্গবন্ধু পাহারায় থাকা সেনা ও পুলিশ সদস্যদের বলেন, “এতো গুলি হচ্ছে, তোমরা কী করছ?” এ কথা বলে বঙ্গবন্ধু দোতলায় চলে যান।


বঙ্গবন্ধু উপরে উঠতে না উঠতেই শেখ কামাল নিচে নেমে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বলেন, “আর্মি আর পুলিশ ভাইয়েরা, আপনারা আমার সঙ্গে আসেন।” এ সময় শেখ কামালের পেছনে গিয়ে দাঁড়ান মহিতুল ইসলাম ও পুলিশের ডিভিশনাল সুপারিনটেনডেন্ট (ডিএসপি) নুরুল ইসলাম খান। ঠিক তখনই মেজর নূর, মহিউদ্দিন আহমেদ (ল্যান্সার) এবং ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা সৈন্যদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ঢোকে। গেটের ভেতর ঢুকেই তারা ‘হ্যান্ডস আপ’ বলে চিৎকার করতে থাকে। মহিতুল ইসলামকে টেনে ঘরের মধ্যে নিয়ে যান নুরুল ইসলাম খান। কোনো কথা না বলেই শেখ কামালের পায়ে গুলি করেন বজলুল হুদা। নিজেকে বাঁচাতে লাফ দিয়ে ঘরের মধ্যে গিয়ে পড়েন শেখ কামাল। মহিতুলকে বলতে থাকেন, “আমি শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল, আপনি ওদেরকে বলেন।” মহিতুল ঘাতকদের তা বলার সঙ্গে সঙ্গে বজলুল হুদা তার হাতের অস্ত্র দিয়ে শেখ কামালের ওপর ব্রাশফায়ার করেন। সঙ্গে সঙ্গে মারা যান শেখ কামাল। এর মধ্যে একটা গুলি মহিতুলের হাঁটুতে, আরেকটা নুরুল ইসলামের পায়ে লাগে।


এ অবস্থাতেই মহিতুলকে টেনে নুরুল ইসলাম তার কক্ষে নিয়ে যান। সেখানে তারা দেখেন, পুলিশের বিশেষ শাখার এক সদস্য দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপছে। অস্ত্রটা তার পায়ের কাছে পড়ে আছে। মুহূর্তের মধ্যে ওই ঘরে ঢুকে বজলুল হুদা সবাইকে বাইরে গিয়ে দাঁড়াতে বলেন। ভবনের নিচে কী হচ্ছে তার কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি দোতলায় তার ঘরের দরজা বন্ধ করে বিভিন্ন জায়গায় ফোন করতে থাকেন। এক পর্যায়ে ফোনে তার সামরিক সচিব কর্নেল জামিলউদ্দিনকে পান। তিনি তাকে বলেন, “জামিল, তুমি তাড়াতাড়ি আসো। আর্মির লোকরা আমার বাসা অ্যাটাক করেছে। সফিউল্লাহকে ফোর্স পাঠাতে বল।”


তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল সফিউল্লাহকেও ফোন করেন বঙ্গবন্ধু। তিনি তাকে বলেন, “সফিউল্লাহ তোমার ফোর্স আমার বাড়ি অ্যাটাক করেছে, কামালকে (শেখ কামাল) বোধ হয় মেরে ফেলেছে। তুমি জলদি ফোর্স পাঠাও।" জবাবে সফিউল্লাহ বলেন, “আই অ্যাম ডুয়িং সামথিং। ক্যান ইউ গেট আউট অফ দ্য হাউজ?”


বঙ্গবন্ধুর ফোন পাওয়ার পর কর্নেল জামিল তার ব্যক্তিগত লাল রঙের গাড়িটি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হন। সঙ্গে ছিলেন গাড়িচালক আয়েনউদ্দিন মোল্লা। কিন্তু পথেই সোবহানবাগ মসজিদের কাছে তাকে গুলি করে হত্যা করে ঘাতকরা। পালিয়ে বেঁচে যান আয়েনউদ্দিন। এদিকে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির গেটের সামনে মহিতুল, নুরুল ইসলাম, আব্দুল মতিন, পুলিশের বিশেষ শাখার সদস্যসহ অন্য সদস্যদের সারি বেঁধে দাঁড় করানো হয়। ঘাতকদের একজন পুলিশের বিশেষ শাখার এক সদস্যকে গুলি করলে তিনি পড়ে যান। এরপর ঘাতকরা গুলি করতে করতে ওপরে চলে যায়। তারা শেখ জামালের ঘরের বাথরুমে আশ্রয় নেওয়া গৃহকর্মী আব্দুলকে গুলি করে। হাতে ও পেটে গুলিবিদ্ধ অবস্থাতে তিনি সিঁড়ির পাশে গিয়ে হেলান দিয়ে বসে থাকেন। বঙ্গবন্ধুর ঘরে তিনি ছাড়াও ছিলেন স্ত্রী ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, ছেলে শেখ জামাল ও শেখ রাসেল, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল, শেখ জামালের স্ত্রী পারভীন জামাল রোজী।


ভোর ৫.৫০ মিনিট তখন। পুত্র কামালকে মেরে ফেলেছে, বঙ্গবন্ধু বুঝে গেছেন। ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর ঘরের বাইরে অবস্থান নেয়। গোলাগুলি থামলে বঙ্গবন্ধু দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে আসতেই ঘাতকরা তাকে ঘিরে ধরে। মেজর মহিউদ্দিন ও তার সঙ্গের সৈন্যরা বঙ্গবন্ধুকে নিচে নিয়ে যেতে থাকে। ঘাতকদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেন, “তোরা কী চাস? কোথায় নিয়ে যাবি আমাকে?” বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্বের কাছে মহিউদ্দিন ঘাবড়ে যান। বঙ্গবন্ধু বলেন, “তোরা আমাকে কোথায় নিয়ে যাবি, কী করবি— বেয়াদবি করছিস কেন?” এসময় নিচতলা ও দোতলায় সিঁড়ির মাঝামাঝিতে অবস্থান নেয় বজলুল হুদা ও নূর। বঙ্গবন্ধুকে নিচে নিয়ে আসার সময় নূর কিছু একটা বললে মহিউদ্দিন সরে দাঁড়ান। সঙ্গে সঙ্গে বজলুল হুদা ও নূর তাদের স্টেনগান দিয়ে গুলি করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। বঙ্গবন্ধুর বুকে ও পেটে ১৮টি গুলি লাগে। বিশালদেহী মানুষটি ধপাস করে পড়ে যান সিঁড়ির উপর। নিথর দেহ পড়ে থাকে সিঁড়ির মধ্যে। রক্তের স্রোত সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে থাকে। অন্য সবাই সে সময় বঙ্গবন্ধুর ঘরে আশ্রয় নেয়।


এর পরপরই মেজর আজিজ পাশা ও রিসালদার মোসলেউদ্দিন তাদের সৈন্যদলসহ বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ঢোকেন। আজিজ পাশা তার সৈন্যদের নিয়ে দোতলায় চলে যান। তারা বঙ্গবন্ধুর ঘরের দরজায় ধাক্কা দিতে থাকেন। এক পর্যায়ে তারা দরজায় গুলি করেন। ফজিলাতুন্নেছা মুজিব তখন দরজা খুলে দেন এবং ঘরের মধ্যে যারা আছেন, তাদের হত্যা না করার অনুরোধ করেন। কিন্তু ঘাতকরা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, শেখ রাসেল, শেখ নাসের ও রমাকে নিচে নিয়ে আসতে থাকে। সিঁড়িতে বঙ্গবন্ধুর লাশ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন বঙ্গমাতা। চিৎকার করে বলেন, “আমি যাব না, আমাকে এখানেই মেরে ফেল।” ফজিলাতুন্নেছা মুজিব নিচে নামতে অস্বীকৃতি জানালে ঘাতকরা শেখ রাসেল, শেখ নাসের ও রমাকে নিচে নিয়ে যায়। আর ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে তার ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর ঘরে আগে থেকেই ছিলেন শেখ জামাল, সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল। ফজিলাতুন্নেছা মুজিবসহ সবাইকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে আজিজ পাশা ও রিসালদার মোসলেউদ্দিন। ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের নিথর দেহটি ঘরের দরজায় পড়ে থাকে। বাঁ দিকে পড়ে থাকে শেখ জামালের মৃতদেহ। রোজী জামালের মুখে গুলি লাগে। রক্তক্ষরণে বিবর্ণ হয়ে যায় সুলতানা কামালের মুখ।


শেখ নাসের, শেখ রাসেল আর রমাকে এরপর নিচে নিয়ে লাইনে দাঁড় করানো হয়। শেখ নাসের ঘাতকদের উদ্দেশ্যে বলেন, “আমি তো রাজনীতি করি না। কোন রকম ব্যবসা বাণিজ্য করে খাই। আমাকে কেন মারবে?" অফিস সংলগ্ন বাথরুমে নিয়ে যাওয়া হয় শেখ আবু নাসেরকে। সেখানে গুলি করা হয় তাঁকে। অসহায় গুলিবিদ্ধ দেহ গড়াতে থাকে মেঝেতে। এ সময় “পানি... পানি ... ” বলে গোঙাতে থাকেন তিনি। পানি নয়, ঘাতকরা আরেকবার গুলিবর্ষণ করে তাঁর উপর।


১১ বছরের শেখ রাসেল লাইনে দাঁড়িয়ে প্রথমে রমাকে এবং পরে মহিতুল ইসলামকে জড়িয়ে ধরে বলে, “ভাইয়া, আমাকে মারবে না তো?” মহিতুল জবাব দেন, “না ভাইয়া, তোমাকে মারবে না।” এ সময় শেখ রাসেল তার মায়ের কাছে যেতে চাইলে আজিজ পাশা তাকে জোর করে মহিতুলের কাছ থেকে নিয়ে দোতলায় নিয়ে যেতে বলেন। আজিজ পাশার কথামত এক হাবিলদার শেখ রাসেলকে দোতলায় নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করে। কোটর থেকে চোখ বেরিয়ে আসে। থেঁতলে যায় মাথার পেছনের অংশ। নিথর রক্তমাখা একরত্তি দেহটি পড়ে থাকে সুলতানা কামালের পাশে। এই হত্যাযজ্ঞে ঘরের মেঝেতে রক্তের মোটা স্তর পড়ে যায়। এর মাঝেই লুটপাট চালায় ঘাতকের দল। মায়ের কাছে নেওয়ার কথা বলে হত্যা করা হয় অবুধ শিশু শেখ রাসেলকে।


অন্য যেকারণে এই হত্যাকাণ্ড ইতিহাসে সর্বাধিক বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড, সেটা হল এই হত্যাকাণ্ডে নারী - শিশুদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে এবং হত্যা করা হয়েছে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালীকে। এই হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে বাঙ্গালী জাতিসত্তা বিলীন করে দেবার চেষ্টা করা হয়েছে নিষ্ঠুরভাবে।


যে বিশাল হৃদয়ের মানুষকে কারাগারে বন্দী রেখেও দেহে স্পর্শ করার সাহস দেখাতে পারেনি পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী, অথচ স্বাধীন বাংলার মাটিতেই তাঁকে নির্মমভাবে জীবন দিতে হয়েছে। যে মানুষটি বাঙালীর জন্য এত ত্যাগ, এত তিতিক্ষা করেছেন সেই সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির পিতাকে গুটিকয় লোভাতুর নরপিশাচরা এমন নির্মমভাবে হত্যা করবে— এমন ভাবনা অবিশ্বাস্য লাগে।


কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সঙ্গেই ভিন্ন পথচলা শুরু হয় সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের। মুখ থুবড়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, প্রশাসন থেকে রাজনীতি সব জায়গায় জেঁকে বসে পাকিস্তানি প্রেতাত্মাদের ভূত। জাতির জনককে হত্যার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বাংলাদেশ বেতার হয়ে গিয়েছিল রেডিও বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধে রণধ্বনি জয় বাংলা বদলে যায় বাংলাদেশ জিন্দাবাদে। বছর না ঘুরতে জেলখানা থেকে স্বদম্ভে বেরিয়ে আসে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত প্রায় ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধী। যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন, যারা বিশ্বাস করতেন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ, তাদের জন্য শুরু হয় অন্ধকার কাল। ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই একটানা চেষ্টা চলে বঙ্গবন্ধুকে ভুলিয়ে দেয়ার। পাঠ্যপুস্তক থেকে মুছে ফেলা হয় বঙ্গবন্ধুর নাম। আওয়ামী লীগসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর চলে ধারাবাহিক নির্যাতন। জঘন্যতম এ হত্যাকাণ্ডে বিচার তো দূরের কথা, এর প্রতিদানস্বরূপ নানাভাবে পুরস্কৃত করা হয় বঙ্গবন্ধুর খুনি চক্রকে। বিভিন্ন দূতাবাসে তাদের চাকরি দেয়া হয়।


ঘাতকের দল অনুধাবন করে ফেলেছিল বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু মানেই বাঙালি জাতির স্বর। বঙ্গবন্ধু মানেই আমাদের ইতিহাসের ১৫০০ শত বছরের ব্যর্থতার ইতিহাসকে পেছনে ফেলে নতুনের কেতন উড়ানোর ইতিহাস। তাই তারা ১৫ আগস্ট শুধু বঙ্গবন্ধু হত্যা করেনি, তারা সেই সাথে বঙ্গবন্ধুর রক্তের যত উত্তরাধিকার ছিল তাদের সবাইকে হত্যা করেছে।


এই হত্যাকাণ্ডের মূল মাস্টারমাইন্ড ছিল জেনারেল জিয়াউর রহমান। হত্যাকারী বলতে আমরা শুধু মঞ্চের কিলারদেরই চিনি, কিন্তু নেপথ্যের নায়করাও থাকে। তেমনি জেনারেল জিয়াউর রহমান ছিল নেপথ্যের নায়ক। এ সম্পর্কে সাপ্তাহিক ‘বাংলার ডাকে’ আবদুল গাফফার চৌধুরী লিখেছেন—‘বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর পরই আমার মনে হয়েছিল, সিআইএ তাদের আসল লোকটাকে মাঠে নামায়নি। ফারুক, ডালিম, মোশতাককে সামনে ঠেলে দিয়ে প্রথম পর্যায়ে ধূম্রজাল সৃষ্টির চেষ্টা করেছে মাত্র।’ কিলার কর্নেল ফারুক সাংবাদিক এন্থনী মাসকারেনহাসকে বলেন, ‘আমাদের প্রথম পছন্দ ছিল জেনারেল জিয়া। বহু কষ্ট করে ১৯৭৫ সালের ২০ মার্চ জিয়াউর রহমানের সাথে সন্ধ্যায় সাক্ষাৎ করি। জেনারেল জিয়া বললেন—আমি একজন সিনিয়র অফিসার, আমি এভাবে জড়াতে পারি না। যদি তোমরা জুনিয়র অফিসাররা এটা করতে চাও, এগিয়ে যাও।’ সামরিক চক্রান্তকারীদের পক্ষে মেজর রশিদ হত্যাকাণ্ডের রাজনৈতিক নেতৃত্বের সাথে, অর্থাৎ খন্দকার মোস্তাকের সাথে যোগাযোগ করেছেন এবং মেজর ফারুক যোগাযোগ করেছেন অন্যান্য সহকর্মী ও তার গুরু ডেপুটি চিফ অব স্টাফ জেনারেল জিয়াউর রহমানের সাথে।


বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মূল দুই কিলার মেজর ফারুক ও রশিদ। জেনারেল জিয়া ছিলেন মেজর ফারুকের চাইতে ১৩ বছরের সিনিয়র। ১৯৬৫ সালে ফারুক ও রশিদ সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন এবং রিসালপুরস্থ সামরিক একাডেমীতে প্রশিক্ষণ নেন। ঐ সময় জেনারেল (মেজর) জিয়া ছিলেন সেখানকার একজন প্রশিক্ষক। সেই একডেমীতেই জিয়ার সাথে ফারুক ও রশিদের পরিচয় ও আন্তরিকতার সূত্রপাত। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে ১৯৭১ সালে পাকবাহিনীর এজেন্ট হয়ে নভেম্বর মাসে তারা ভারতে প্রবেশ করে। সন্দেহবশত কর্নেল ওসমানী তাদের গ্রহণ করেন নাই, কিন্তু তাদের আশ্রয় দিলেন তাদের প্রশিক্ষক মেজর জিয়া। জিয়ার মাধ্যমে তারা ঢুকে গেলেন বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন ‘জেডফোর্সে’।


হত্যাকারীদের মূলত লক্ষ্য ছিল শুধু বঙ্গবন্ধু নয়, তাদের লক্ষ্য আরও সুদূরপ্রসারী ছিল। তারা ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া বাঙ্গালিদের ওপর তাদের মূল ক্ষোভ ছিল। তাই তারা চায়নি বঙ্গবন্ধু পরিবারের কেউ বেঁচে থাকুক। থাকলে এই রক্ত মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। এজন্য এই হত্যাকাণ্ড ছিল বিশ্বের বুকে নজিরবিহীন ঘটনা। এ জন্য বিশ্বের বুকে ঘটে যাওয়া দুই একটি হত্যাকাণ্ড উল্লেখ করা দরকার।


সুইডেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ওলফ পালমকে ১৯৮৬ সালে হত্যা করা হয়। সিনেমা হল থেকে স্ত্রীর সঙ্গে বাড়ি ফেরার সময় পালমেকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল পেছন থেকে। ওইদিনই নিরাপত্তা রক্ষীদের বিদায় জানিয়েছিলেন ওলফ পালম। অথচ ওইদিন তার পাশেই ছিলেন তার স্ত্রী, কিন্তু তাকে হত্যা করা হয়নি।


সালভাদর আলেন্দে ১৯৭০ সালে চিলির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তাকে উত্তর—দক্ষিণ আমেরিকার প্রথম মার্কসবাদী প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৯৭৩ জেনারেল আগুস্তো পিনোশের নেতৃত্বে এক সেনা অভ্যুত্থানে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন। পিনোশের অনুগত সেনা ও বিমান হামলার পর আলেন্দের মৃতদেহ প্রেসিডেন্ট প্যালেসের ভেতরে পাওয়া যায়। অথচ প্রেসিডেন্ট ভবনে তার স্ত্রী—সন্তানদের অক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায়।


পাত্রিস লুমুম্বা ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গোর স্বাধীনতার স্থপতি। তিনি ছিলেন বিপ্লবী জাতীয়তাবাদী নেতা ও সাহিত্যিক। তার আসল নাম ছিল এলিয়াস ওকিত আসম্বো। ১৯৬০ সালের সেপ্টেম্বরে সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে লুমুম্বা ও কাসাভুবুকে পদচ্যুত করা হয়। ডিসেম্বরে গ্রেফতার হন লুমুম্বা। জানুয়ারি মাসের ১৭ তারিখ বন্দি অবস্থায় হত্যা করা হয় কঙ্গোর স্বাধীনতার স্থপতি লুমুম্বাকে। এরপর কঙ্গো চলে যায় সামরিক বাহিনীর হাতে।


ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী গান্ধী বিশ্বব্যাপী যার পরিচিতি ইন্দিরা গান্ধী নামে। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ও মা কমলা নেহেরুর একমাত্র সন্তান ইন্দিরা গান্ধী। তিনি ছিলেন ভারতের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী। একটি খারাপ সময়ে শক্ত হাতে রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা রক্ষার গুরুদায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বিষাদময় পরিণতি বরণ করতে হয় তাকে। পবিত্র স্বর্ণমন্দিরের অবমাননা আর খালিস্তানের স্বপ্ন ধূলিসাৎ করে দেওয়ার প্রতিশোধস্বরূপ ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর সাৎওয়ান্ত সিং ও বেয়ান্ত সিং নামে নিজের দুই শিখ দেহরক্ষীর গুলিতে নিহত হন ভারতের চার বারের প্রধনামন্ত্রী ইদন্দিরা গান্ধী। ওইসময় তার পরিবারের ওপর কোন হামলা করা হয়নি।


অথচ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বিশ্বের ইতিহাসের ভয়াবহ নিষ্ঠুর ও জগন্যতম হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে হত্যা করা হয়েছিল বাংলার  ইতিহাসের মহানায়ক বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতির জনকের সহধর্মিণী মহিয়সী নারী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনি ও তার স্ত্রী আরজু মণি, বঙ্গবন্ধুর একমাত্র ভাই শেখ আবু নাসের, জাতির জনকের জ্যেষ্ঠপুত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন শেখ কামাল, দ্বিতীয় পুত্র মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল, তাদের নবপরিণীতা স্ত্রী সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠপুত্র শেখ রাসেল, আব্দুর রব সেরনিয়াবাতসহ আরও অনেককে। এই হত্যাকাণ্ডে মস্তক বিদীর্ণ করা হয়েছিল ছোট্ট শিশুর, হত্যা করা হয়েছিল অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে। অবাধে হত্যা করা হয়েছিল একটি নির্দিষ্ট পরিবারের নারীদেরকে ।


বাংলাদেশে এই হত্যা—ষড়যন্ত্রের মূল হোতা ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান এবং খন্দকার মোশতাক আহমেদ। ১৯৭১ সালে আমেরিকার সঙ্গে মিলিত হয়ে মোশতাক স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল। আর এ জন্যই মোশতাককে ডামি হিসেবে ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রপতির গদিতে বসিয়ে ৮০ দিনের মাথায় তাকে সরিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসানো হয় জিয়াকে। জিয়ার মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশকে মিনি পাকিস্তানে পরিণত করার চেষ্টা শুরু হয়। এটা পরিষ্কার যে, সেনাবাহিনীর তৎকালীন উপ—প্রধান জিয়াউর রহমান নেপথ্যে থেকে মদদ না দিলে কোনভাবেই মুজিব হত্যা সম্ভব হতো না। খুনিদের মদদদাতা, আশ্রয়দাতা, প্রশ্রয়দাতা ও পুরস্কারদাতা ছিলেন এই জিয়াউর রহমান। বাস্তবতা হলো— যেকোন দেশে সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পালাবদলের অন্তরালে থাকে একটি রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্ব। এ নিরিখে ১৫ আগস্টের ক্ষমতার পালাবদল কার্যক্রমে রাষ্ট্রপতি হিসেবে সার্বিক রাজনৈতিক ক্ষমতার মঞ্চে খোন্দকার মোশতাক আবির্ভূত হলেও সামরিক নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। অর্থাৎ মোশতাক—জিয়ার যৌথ নেতৃত্বেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পালাবদল সংঘটিত হয় ন্যাকারজনক ঐ দিনের হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে।


অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে, কেন অবাধে হত্যা করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর শিশু পুত্রসহ সবাইকে? এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর কিলার মেজর রশিদ এর কথায় স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৮৬ সালে দেওয়া ভারতীয় লেখক সলীল ত্রিপাঠিকের একটি সাক্ষাৎকারে। এই সাক্ষাৎকার অনুযায়ী মেজর রশিদকে প্রশ্ন করা হয়েছিল মুজিবের শিশু পুত্রটিকে কেন হত্যা করা হয়েছিল? তার স্পষ্ট উত্তর ছিল, "আমরা চাইনি মুজিবুরের রক্তের কেউ বেঁচে থাকুক। এই বংশটি আমাদের জন্য হুমকিস্বরুপ ছিল।" সুতরাং এখান থেকে বোধগম্য হয় যে খুনিরা একটা পরিবারকে চিহ্নিত করে এই হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল। এখানে সমর আইনের কোন রীতি - নীতি অনুসরণ করা হয় নাই, অনুসরণ করা হয় নাই নারী - শিশু হত্যার ক্ষেত্রে ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা। সম্পূর্ণভাবে স্বাধীনতা বিরধি গোষ্ঠীর পরাজয়ের ক্ষোভ চরিতার্থ করার জন্য খুনিরা অন্ধের মত নারী -শিশু হত্যা করেছে ১৫ই আগস্ট। মানবিকতার লেস মাত্র খুঁজে পাওয়া যায় না এই বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডে। একইসাথে কর্নেল রসিদের এই উক্তির মাধ্যমে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় তাদের ক্ষোভ এই জাতিসত্তার ওপর ছিল প্রবল। তারা কোনভাবেই বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ মেনে নিতে পারেনি।


ঠিক জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসে হত্যাকাণ্ডের মূল নায়ক রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান। যিনি খুব দ্রুততার সাথে নিধন করতে থাকেন মুক্তিযোদ্ধাদের। বাঙালি কৃষ্টি-কালচারকে চিরতরে ঝেঁটিয়ে বিদায় দেওয়ার চেষ্টা করেন। ওয়াং চেনের কায়দায় জিয়াউর রহমান শুরু করেন বাঙালি জাতির বীরত্বপূর্ণ স্বাধীনতার ইতিহাসকে নিজের ঝুলিতে নেওয়ার। অসংখ্য ঘটনা ঘটে বাঙালি জাতির ইতিহাসকে বিকৃত করার, বিভ্রান্তি ছড়ানোর, জবরদখল করার এবং শাসককুলের মনগড়া ইতিহাস রচনার। আগস্টের নিষ্ঠুরতার অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল ৭৫ উত্তর ইতিহাস বিকৃতির মহা উৎসব।


১৫ আগস্টের হত্যাকারীদের নিষ্ঠুরতা পৃথিবীর ইতিহাসের সকল নিষ্ঠুরতাকে ছাড়িয়ে গেছে, একটি দেশের জাতির পিতাকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার নজির পৃথিবীতে নেই। নারী, শিশু, অন্তঃসত্ত্বা নারী, পঙ্গু ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়েছে নির্মম ভাবে। বঙ্গবন্ধুর ভ্রাতা শেখ নাসের পানি বলে আকুতি জানালে তাকে বাথরুমে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। ঘটনার সময় বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা বিদেশে অবস্থান করায় প্রাণে বেঁচে যান।


বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরবর্তী ঘটনাবলি বলে দেয়, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড কেন এবং কারা? বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে জনগণের নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের খেলা শুরু হয়। ১৯৭৫সালে ২৬ সেপ্টেম্বর, অবৈধ ও স্বঘোষিত রাষ্টপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে। অধ্যাদেশটিতে দু’টি ভাগ রয়েছে, প্রথম অংশে বলা হয়েছে ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট ভোরে বলবৎ আইনের পরিপন্থি যা কিছুই ঘটুকনা কেন, এ ব্যাপারে সুপ্রীম কোর্টসহ কোন আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোন আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবেনা। দ্বিতীয় অংশে বলা হয়েছে, রাষ্টপতি উল্লিখিত ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত বলে যাদের প্রত্যয়ন করবেন তাদের দায়মুক্তি দেয়া হল। ৩রা নভেম্বর কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়। এই অধ্যাদেশ নৃশংসতা এবং অমানিবিকতার এক নূতন মাত্রা সৃষ্টি করে। কারণ যে কোন মানুষেরই বিচার চাওয়ার অধিকার আছে। কিন্তু ১৫ই আগস্টের নিহতদের স্বজনদের সেই বিচার চাওয়ার মৌলিক অধিকার থেকে তাঁদের বঞ্চিত করা হয়। আশ্চর্যজনকভাবে তখন মানবাধিকার সংস্থাগুলো নীরব ভূমিকা পালন করে। থাকে। তখন কিন্তু কোন তথাকথিত সভ্য ও উন্নত দেশ, বা মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই অধ্যাদেশের বিরুদ্ধে তৎকালীন সরকারকে কোন প্রকার চাপ প্রয়োগ করতে দেখা যায় নাই, অথবা উন্নত দেশগুলো কোন স্যাঙ্কসনও দেয় নাই। ২১ বছর আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে বিচার চাওয়ার অধিকার পাওয়ার জন্য। বঙ্গবন্ধু কন্যাকে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে এসেই এই ন্যাকারজনক আদ্ধাদেশ বাতিল করতে হোল। অন্য কোন সরকার এই যৌক্তিক এবং মানবিক কাজটা কিন্তু করে নাই নিহতদের পরিবারের জন্য।


বরঞ্চ বঙ্গবন্ধু হত্যার সবচেয়ে বড় বেনিফিশিয়ারি জিয়াউর রহমান, ’৭৯ সালে সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স সংযুক্ত করে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সুরক্ষা করেন। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল সায়েমকে পদত্যাগ করিয়ে রাষ্ট্রপতি হন জিয়াউর রহমান। সংসদে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ—সহ চার বছরে সামরিক আইনের আওতায় সব অধ্যাদেশ, ঘোষণাকে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে আইনি বৈধতা দেওয়া হয়।


এখানে কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করা প্রয়োজন, জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের বিচারে সোপর্দ না করে রাষ্টীয়ভাবে পুরস্কৃত করে। ১২ জন ঘাতককে বিভিন্ন দুতাবাসে চাকুরি দেয়া হয়। জিয়াউর রহমান কর্তৃক পুরস্কৃত ও পুনর্বাসিত হওয়ার ফলেই বঙ্গবন্ধুর খুনিরা সদম্ভে খুনের কথা স্বীকার করে বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়েছে। ২৬.০৫.১৯৭৬ সালে খুনি সৈয়দ ফারুক রহমান ’৭৫—এর আগস্টের হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে সানডে টাইমস পত্রিকার ১১নং পৃষ্ঠায় একটি বিবৃতি প্রদান করে, যার শিরোনাম— ‘‘I helped to kill Mujib, dare you put me on trail.’ এভাবেই খুনিরা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ঔদ্ধত দেখিয়েছেন এবং মানবিকতা নিয়ে চরম উপহাস করেছে বহু বছর।


বিশ্বখ্যাত সাংবাদিক এন্থনি মাসকারেনহাসের কাছে সাক্ষাতকারে খুনি ফারুক ও রশিদ শিকার করেছে যে, জিয়াউর রহমান তাদের কে বলেছে, তিনি সিনিয়র, এই কাজে অংশ নিতে পারবেন না কিন্তু ‘Go ahead’। এই সাক্ষাতকারটি বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় প্রচার হয়েছে পরবর্তীতে। বঙ্গবন্ধু হত্যার ঘটনায় জিয়াউর রহমানের ভূমিকা সাক্ষী ও আসামিদের জবানবন্দিতেও উঠে আসে। খুনি লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান ১৯৯৬ সালের ১৯ ডিসেম্বর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলে, ‘... এ ব্যাপারে জিয়াউর রহমানের সাথে আলোচনার সিদ্ধান্ত হয় এবং সে মতে এপ্রিল মাসের এক রাতে তার বাসায় আমি যাই..., আলোচনা হয় এবং সাজেশন চাইলে জিয়াউর রহমান বলেন, ‘তোমরা করতে পারলে কিছু কর।’


বেনিফিশিয়ারি জিয়া ’৭৫ এর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের তদন্তেও বাঁধা দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী জিয়াউর রহমানের কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করলে বঙ্গবন্ধু হত্যা কেন ও কারা এটি আরো স্পষ্ট হয়। যেমন: বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের তদন্তে যুক্তরাজ্যে যে অনুসন্ধান কমিশন গঠিত হয়েছিল তার সদস্য ব্রিটিশ পার্লামেন্টের এমপি জেফরি টমাস ও তার সহকারিকে ’৮১ সালে বাংলাদেশে আসতে বাঁধা দিয়েছিল জিয়াউর রহমান। নিজের মুখোশ আড়াল করবার জন্য তিনি এই বাধা দিয়েছিলেন। আসলে এটা অনেকের কাছে পরিষ্কার যে তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের পরিকল্পনাকারী এবং জড়িত।  তিনি যদি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জড়িত না থাকতেন তবে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের প্রটেকশন দিতেন না, বিদেশি দূতাবাসে চাকুরি দিতেন না, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স সংবিধানে সংযুক্ত করে বিচারে বাঁধা দিতেন না এবং যুক্তরাজ্যের অনুসন্ধান কমিটিকে বাংলাদেশে আসতে বাধা দিতেন না। এক্ষেত্রে মাননীয় আইনমন্ত্রী, আনিসুল হকের একটি উক্তি প্রনিধানযোগ্যঃ ‘বেঁচে থাকলে জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু হত্যার মামলার আসামি হতেন।’ অর্থাৎ যথেষ্ট প্রমাণাদি সরকারের কাছে আছে, তাই জিয়াউর রহমান এই মামলার আসামি হতেন।


জিয়াউর রহমানের আরো কিছু কর্মকাণ্ড উল্লেখ করা প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যাকে আশ্রয় দেয়ার কারণে জার্মানে নিযুক্ত তৎকালীন রাষ্টদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীকে ওএসডি করে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তাঁর কন্যাদের দেশে আসতে দেয়নি জিয়াউর রহমান। কনিষ্ঠা কন্যা শেখ রেহানার মেয়াদ উত্তীর্ণ পাসপোর্ট নবায়ন না করার জন্য লন্ডন দূতাবাসকে অফিসিয়ালি নির্দেশ দেয়া হয়। জ্যৈষ্ঠা কন্যা শেখ হাসিনার পাসপোর্ট নবায়ন করায় ভারতে নিযুক্ত সেই সময়ের রাষ্টদূতকে চাকরিচ্যুত করে।


জিয়াউর রহমান ’৭৫এর ৩১ ডিসেম্বর দালাল আইন বাতিল করে, কারাগারে আটক ও দন্ডিত সকল যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দেয়, ’৭৬ সালে ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতি করার লক্ষ্যে সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদের শর্তাবলী তুলে দেয়। এবং  সংবিধানের ১২২ অনুচ্ছেদ তুলে দিয়ে দালালদের ভোটার হওয়ার সুযোগ দেয়। প্রক্লেমেশন অর্ডার দ্বারা সংবিধানের ১২নং অনুচ্ছেদ তুলে দিয়ে দালালদের রাজনীতি করার সুযোগ দেয়।


রাজাকার শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী, রাজাকার আলীমকে মন্ত্রী বানায়। শহীদ পরিবারের জন্য বঙ্গবন্ধু যে সকল বাড়ি বরাদ্দ করেছিলেন জিয়াউর রহমান জোরপূর্বক ওই সব বাড়ী থেকে শহীদ পরিবারের সদস্যদের পুলিশ বা সেনাবাহিনী দিয়ে উৎত্থাত করে। বঙ্গবন্ধু ৭৩ সালে ১৮ এপ্রিল গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে কুখ্যাত যুদ্ধপরাধী গোলাম আযম গংদের নাগরিকত্ব বাতিল করেছিলেন। জিয়াউর রহমান ৭৮ সালে গোলাম আযমকে দেশে ফিরিয়ে আনে। জিয়াউর রহমান ’৭৭ সালে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা অফিসার ও সৈনিকদের বেছে বেছে হত্যা করে। প্রতিরাতে কারফিউ দিয়ে মানুষ হত্যা করা হত ঐসময়।


জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পরে মেজর জেনারেল হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নেবার পর আত্মস্বীকৃত খুনির দলের বেশ ক’জন দেশে ফেরে এবং তৎকালীন এরশাদ সরকারের প্রশ্রয়ে ফ্রিডম পার্টি নামে একটা রাজনৈতিক দল তৈরি করে এই দেশে রাজনীতি শুরু করে।


’৭৫ এর ১৫ আগস্ট সভ্যতার ইতিহাসে একটি কালো দিন। ’৯৩ সাল থেকে খালেদা জিয়া এই বেদনা বিঁধূর দিনে মিথ্যা জন্মদিন পালন করে, কেক কাটে, এই বর্বরতম কাজ করে খালেদা জিয়া মূলত অমানবিকতার পরিচয় দেয়। ’৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ভোটারবিহীন নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর খুনী রশিদ এবং হুদাকে এমপি বানায় খালেদা জিয়া এবং খুনী রশিদকে জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের নেতা বানিয়ে সংসদকে কলুষিত করে।


’৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সরকার গঠন করার পর ১২ নভেম্বর সংসদে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স রহিতকরণকল্পে বিল আনয়ন করা হয় সেদিন বিএনপি সংসদে অনুপস্থিত ছিল। জিয়াউর রহমান ও তার স্ত্রী খালেদা জিয়া বঙ্গবন্ধুর খুনিদের শুধু সুরক্ষা বা পুরস্কৃতই করেনি, আইনের শাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে জিয়ার স্ত্রী খালেদা জিয়া দায়রা জজ আদালত কর্তৃক বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় ঘোষণার দিন হরতাল পালন করেছে। স্বাধীনতার সুফল ঘরে ঘরে পৌছে দেয়ার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু সরকার যখন যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছিল তখনই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নিশ্চিহ্ন করতে খুনিরা নারকীয় হত্যাযজ্ঞ করেছে।


খুনিরা সসম্মানে বিশেষ মর্যাদায় নিরাপদে ছিল। কিন্তু কোনদিন যদি কেউ বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবি তোলে? কেউ যদি বিচারে আগ্রহ দেখায়? তাই তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান কোনধরনের ঝুঁকি নিতে চাইলেন না। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে সক্রিয় ভূমিকা রাখা এবং খুনিদের সর্বাত্মক পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে নিরাপদে রাখবার এই পুরো ঘটনা নিশ্চিন্ত রাখতে ১৯৭৯ সালে তিনি ছিয়াত্তরে মুশতাকের জারি করা ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সকে আইন হিসেবে অনুমোদন করে সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করেন। অর্থাৎ যে মানুষটি জীবন—যৌবন সব বিলিয়ে দিয়ে, সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করে দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তি এনে দিলেন, তার প্রিয় সে দেশের মাটিতে তারই হত্যার বিচার আইন করে বন্ধ করা হলো। এভাবে সুপরিকল্পিতভাবে এবং নিয়মতান্ত্রিকভাবে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের দরজা রুদ্ধ করা হয়।


কি করা হয়নি বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার ঘটনা ধামাচাপা দেবার জন্য? আজ এতো বছর পর সম্ভবত কল্পনা করতেও কষ্ট হবে যে এই দেশের স্থপতি, এই জাতির জনক, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালিকে সপরিবারে ব্রাশফায়ারে মেরে ফেলার মত চরম পৈশাচিক একটা গণহত্যার কোন ধরনের বিচার যেন না হয় এবং স্বঘোষিত খুনিরা, যারা অসংখ্যবার প্রকাশ্যে এই হত্যাকাণ্ড চালাবার জন্য গর্ববোধ করেছে, তাদের যেন কোন ধরনের শাস্তির মুখোমুখি হতে না হয়, সেজন্য এই দেশের রাষ্ট্রপ্রধান কর্তৃক নির্বাহী আদেশে দায়মুক্তি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছিল।


এদের মধ্যে শিশু শেখ রাসেলকে কোল্ড ব্লাডে পয়েন্ট ব্লাংক রেঞ্জ থেকে গুলি করে মাথার খুলি উড়িয়ে দিয়েছিল এই সাইকোপ্যাথের দল। এমনকি গর্ভবতী নারীকেও নির্বিচারে খুন করেছে এরা। আর রাষ্ট্রক্ষমতায় বসেই সবার প্রথমে সেই খুনিদের সুরক্ষা দিতে এবং নিরাপদ রাখতে রাষ্ট্রীয় নির্দেশে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করা যাবে না এবং খুনিদের কোন ধরনের বিচারের মুখোমুখি করে শাস্তি দেওয়া যাবে না বলে অধ্যাদেশ জারি করেছিল খন্দকার মুশতাক। যে মানুষটার নেতৃত্বে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটা তৈরি হলো, তাকেই নির্মমভাবে খুনের বিচার করা যাবে না বলে অধ্যাদেশ জারি হলো সেই রাষ্ট্রে, রাষ্ট্রপ্রধানের নির্দেশে। কি চরম নির্লজ্জ রসিকতা!


খুনিরা শুধু একজন নেতাকে নয়, বাংলাদেশের ভিত্তিকে হত্যা করার চেষ্টা করেছে। রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিকে হত্যা করতে চেয়েছে। কিন্তু খুনীর দল জানেনা আদর্শকে হত্যা করা যায়না, স্বপ্নকে হত্যা করা যায় না। বঙ্গবন্ধু অমর, অব্যয়, অক্ষয়। পাকিস্তানের মিয়াওয়ালির কারাগারে ভুট্টো—ইয়াহিয়া কবর খুঁড়েছিল বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার জন্য, বাঙালীর প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালবাসার এমনই অপার শক্তি যে বঙ্গবন্ধুকে তাঁর ইপ্সিত লক্ষ্য থেকে একচুলও নড়াতে পারেনি। বাঙালীর মুক্তির প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে প্রস্তুত ছিলেন।


বাঙ্গালী  জাতিগোষ্ঠীকে যারা স্বমূলে ধ্বংসের প্রয়াসে সেদিন জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে যে হত্যাকাণ্ড সংগঠিত করেছিল, অনেক পরে হলেও তাদের বিচার হয়েছে। কিন্তু বিচার হয়নি এই হত্যাকাণ্ডের মূল কুশীলব মোশতাক ও জিয়ার। এদের মরণোত্তর বিচার এখন সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদের বিচারও করতে হবে। এদের বিচার খুব শীঘ্রই হবে, কারণ সেদিন বেঁচে গিয়েছিলেন আমাদের আশার প্রদীপ বঙ্গবন্ধু কন্যা, যিনি ধ্বংস্তুপে দাঁড়িয়ে উড়ান সৃষ্টির পতাকা।


পাঁচ আসামির রায় কার্যকর করা হলেও যারা এ হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের শক্তি হিসেবে কাজ করেছেন, সেই কুশীলবদের শনাক্ত করতে একটি কমিশনও গঠন করা বাঞ্ছনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বর জেলহত্যার তদন্ত করবে এই কমিশন। দণ্ডিত খুনিদের মধ্যে চারজনের অবস্থান এখনো শনাক্ত করা যায়নি। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত ২১ বছরে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় খুনিরা নিজেদের অবস্থান পোক্ত করার সুযোগ পেয়েছে। তাদের অনেক তথ্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে গায়েব করে দেয়া হয়েছে।


উল্লেখ করার মত, ২০০১ সালের অক্টোবরের সংসদ নির্বাচনে বিএনপি—জামায়াত জোট ক্ষমতায় এলে সেই বিচার কাজ বন্ধ করে দেয়। যেখানে হাইকোর্ট থেকে রায় চলে এসেছে, মামলার আনুষ্ঠানিকতাও আর খুব বেশি বাকি নেই, সেখানে দীর্ঘ ৬ বছর আপিল বিভাগের সাতজন বিচারক মামলার শুনানিতে বিব্রতবোধ করেন। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার শুনানিতে উচ্চ আদালতের বিচারকরা বিব্রতবোধ করবেন— এটি অত্যন্ত নির্দয় এবং দুঃখজনক। এখানেও নির্মমভাবে বঞ্চিত হয় নিহতদের পরিবার, তথা জননেত্রী শেখ হাসিনা ও বঙ্গবন্ধু কন্যা, শেখ রেহানা।


একটা দেশের স্থপতি, জাতির জনক, স্বাধীনতা ও মুক্তির মহানায়ক, যে তার পুরো জীবনটাই স্বজাতিকে ভালোবেসে উৎসর্গ করে গেছে জেলে আর রাজপথে, তাকে পুরো পরিবারসহ ব্রাশফায়ারে মেরে ফেলার মত পৈশাচিক অচিন্তনীয় অপরাধের জন্য আসলে কোন শাস্তিই যথেষ্ট না, শতবার ফাঁসিতে ঝোলালেও খুনিদের প্রাপ্য শাস্তি নিশ্চিত হয় না, তবুও ফাঁসিতে ঝোলাবার মত এইটুকু শাস্তি নিশ্চিত করতেও তো যুগের পর যুগ পেরিয়ে গেল। খুনিদের আস্ফালন আর তাদের পুরষ্কৃত করা পৃষ্ঠপোষকদের ক্ষমতার দাপটে একসময় বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার বিচার এই দেশে হবে সেটাই অসম্ভব মনে হচ্ছিল। সেই বিচারের রায় পাওয়া এবং সেটা বাস্তবায়িত হওয়ার পুরো ঘটনাটাই এতটা অনিশ্চয়তায় মোড়ানো ছিল যে সেটা ঘটে যাওয়ার কথা ভাবতেও অবিশ্বাস্য লাগে।


জাতির পিতা হত্যার বিচারের রায় কার্যকর হয়েছে ঠিকই তবে এই হত্যাকাণ্ডের পেছনের কুশীলবদের বের করার স্বার্থে পৃথক তদন্ত কমিশন গঠন এখন সময়ের দাবী। একই সাথে ‘৭৫ এর সেই কালরাতে শেখ ফজলুল হক মণি এবং আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাসায় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের বিচারের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করাও জরুরী।


আগস্টের কালরাতে ইতিহাসের ঘৃণ্য ও নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে ষড়যন্ত্রকারীরা শুধু বঙ্গবন্ধুকে নয়, জনগণের হাজার বছরের প্রত্যাশার অর্জন স্বাধীনতাকেও হত্যা করতে চেয়েছিল। ষড়যন্ত্রকারীরা বাঙালির বীরত্ব গাঁথার ইতিহাস মুছে ফেলতে চাইলেও তাদের সেই ষড়যন্ত্র সফল হয়নি, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ও আদর্শের মৃত্যু ঘটাতে পারেনি। যারা স্বাধীন বাংলাদেশ চায়নি, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস করেনা এবং বাংলাদেশকে পুনরায় পাকিস্তান বানাতে চেয়েছে, তারাই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে এবং বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানানোর জন্য যা যা দরকার তাই করেছে। জাতির জনককে সপরিবারে খুন করা পর দেশ চলছে মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত উগ্র ধর্মান্ধ পাকিস্তানী প্রেসক্রিপশনে।


পরিশেষে বলবো, বঙ্গবন্ধু ছিলেন বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম মহানায়ক। সেরা মুক্তি সংগ্রামী, সেরা রাষ্ট্রনায়ক। জননন্দিত নেতা হিসেবে তার তুলনা ছিলেন তিনি নিজেই। দেশের মাটি ও মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসা ও দায়বোধ তাকে মহীরূহে পরিণত করেছিল। ব্যক্তি শেখ মুজিব হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু। বাঙালি জাতি, বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু সমার্থক শব্দে পরিণত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং অস্তিত্বের শত্রুরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে প্রকারান্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকেই হত্যা করতে চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন কেউ বঙ্গবন্ধুর নাম বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে মুছতে পারবে না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এমন একজন নেতা, যাঁর সঙ্গে বাংলাদেশের ইতিহাসের সম্পর্ক গভীর। ঘাতকের বুলেট তাঁকে হত্যা করলেও সে সম্পর্ক মোটেই ছিন্ন করতে পারেনি। যত দিন যাচ্ছে, ততই ইতিহাসে তাঁর নাম সমুজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।


জাতির পিতা ছিলেন বিশ্বের নির্যাতিত—নিপীড়িত ও শোষিত—বঞ্চিত মানুষের মুক্তির দূত— স্বাধীনতা ও শান্তির প্রতীক। বাংলা ও বাঙালি যত দিন থাকবে, এ পৃথিবী যত দিন থাকবে, পৃথিবীর ইতিহাস যত দিন থাকবে তিনি একইভাবে প্রজ্বলিত হবেন প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে, প্রতিটি মুক্তিকামী, শান্তিকামী, মানবতাবাদীর হৃদয়ে। বঙ্গবন্ধুর জীবনদর্শন চিরকাল বাঙালি জাতিকে অনুপ্রাণিত করবে, পথ দেখাবে। বাঙালি জাতি শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসায় বাংলাদেশের ইতিহাস বিনির্মাণের কালজয়ী এই মহাপুরুষকে চিরকাল স্মরণ করবে। কবির ভাষায়— ‘যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা গৌরী যমুনা বহমান/ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান’।


জাতির পিতা হারানোর শোককে শক্তিতে পরিণত করে তাঁর ত্যাগ—তিতিক্ষার দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনাদর্শ ধারণ করে সবাই মিলে একটি অসাম্প্রদায়িক, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলি। শোকের মাসে এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।


লেখক: শেখ নবীরুজ্জামান বাবু