প্রকাশ: ১৬ আগস্ট ২০২১, ১৬:৫
পনের জনের মতো সামরিক অফিসার, ১৫০ থেকে ৭০০ সৈন্য, ২৮টি গোলাবিহীন ট্যাঙ্ক এবং ১৮টি চাইনিজ মেশিনগান দিয়ে ১৯৭৫ সনের ১৫ই আগস্ট পরিকল্পিত ঠান্ডা মাথায় যাদের হত্যা করা হয়েছিল তাদের সবার নাম কি জানে এই প্রজন্ম?বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বাড়িতে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন, -- শেখ মুজিবুর রহমান, শেখ আবু নাসের, বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, শেখ কামাল, নববধূ সুলতানা কামাল খুকী, শেখ জামাল, পারভীন জামাল রোজী ও ১০ বছর বয়সী শেখ রাসেল।
নিজ বাড়িতে গুরুতর আহত হয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডে এসে আমি সহ আরো কয়েকজন সেবারত স্বাস্থ্যকর্মীর সামনে মারা যান শেখ ফজলুল হক মনি। বেগম আরজু মনি ওরফে বেগম সামসুন্নেসাও হাসপাতালে মারা যান।সেরনিয়াবাতের বাড়িতে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন, আবদুর রব সেরনিয়াবাত, আরিফ সেরনিয়াবাত, বেবী সেরনিয়াবাত, শহীদ সেরনিয়াবাত, সুকান্ত আবদুল্লাহ বাবু, নাঈম খান রিন্টু, দুইজন গৃহকর্ম সহায়ক লক্ষীর মা ও ১২ বছর বয়সী পোটকা।
মর্গে নেয়ার আগে অনেক্ষন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের চত্বরে সবুজ ঘাসের ওপরে বেশ কিছু সময় তাদের লাশ কেন রাখা হয়েছিল জানিনা, সেই দৃশ্য আমি ও অধ্যাপক জিয়াউদ্দিন সাদেক চোখে দেখেছি। বঙ্গবন্ধু হত্যাকে বাধা দিতে গিয়ে নিহত হন পুলিশ কর্মকর্তা সিদ্দিকুর রহমান, সামছুল হক, ও বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা কর্মকর্তা কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদ। খামাখা মারা যান শেরশাহ সুরী রোডের ৮ ও ৯ নং বাড়ি এবং শাহজাহান রোডের ১৯৬ ও ১৯৭ নম্বর বাড়ির বাসিন্দারা। এনারা মর্টারের গোলার আঘাতে সৃষ্ট অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধ হয়ে নিহত হন। এনারা ছিলেন রেজিয়া বেগম, নাসিমা, হাবিবুর রহমান, আনোয়ারা বেগম, আনোয়ারা বেগম (২), ময়ফুল বিবি, সাবেরা বেগম, আবদুল্লাহ, রফিকুল, সাফিয়া খাতুন, শাহাবুদ্দিন, কাশেদা, আমিনউদ্দিন, হনুফা বিবি।জাহিদ, সুমন। (সূত্র উইকিপিডিয়া, শোকাবহ আগস্টে কিছু সরল জিজ্ঞাসা"- চ্যানেল আই ও
"No justice yet in 3 other Aug 15 cases" The Daily Star.) কিন্তু মর্টার গোলা কেমন করে এলো এনিয়ে কোন তথ্য সূত্রটি উল্লেখ করেনি। আর আমি ৭৫' এর সময় এই তথ্য পাইনি। ১৯৭৫ সনে আমরা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের শেষবর্ষের ছাত্র ছিলাম। সেদিন ভোররাতে গোলাগুলির শব্দ শুনে হোস্টেল থেকে হাসপাতালের রোগীবিহীন ইমার্জেন্সীতে এসে অফিসার ডাক্তার ইকবাল ভাই আমাদের প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছিলেন কোন গুলির কেস আসেনি। এর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই শুরু হয়েছিল আহত ও নিহতদের ঢেউ। আমি আর জিয়াউদ্দিন সাদেক সেদিন ভোররাতে কত আহত আর নিহতকে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করেছি। আমাদের অধ্যাপক এটি সিদ্দিকী স্যার ও অধ্যাপক মতিওর রহমান স্যার একের এক সার্জারী করে গেছেন নিরলস সেদিন।
আমি সেদিন কাঁদতে দেখেছি রমনা থানার পুলিশ ওসি আনোয়ার ভাইকে যিনি আহত ও নিহতদের নিয়ে ইমার্জেন্সীতে এসেছিলেন। জানিনা উনি বেঁচে আছেন কিনা অথবা থাকলে কোথায় আছেন। উনি খবর না শুনে প্রথমে মনে করেছিলেন, সর্বহারা পার্টি সবাইকে মেরেছে, আমাকেও তাই বলেছিলেন। উনি জানতেন আমি তখন দৈনিক বাংলার মেডিক্যাল রিপোর্টার ছিলাম।ইমার্জেন্সীর ডাক্তার ইকবাল ভাইকে দেখেছি শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা খুকীর মায়ের প্রশ্নে অসহায় হয়ে কেঁদে দিতে। তিনি জানতে চেয়েছিলেন তাঁর মেয়ে আহত হয়ে বা লাশ হয়ে ঢাকা মেডিকেলে এসেছে কিনা। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের পিওন শরীফ ভাই দৌড়ে এসে আমাদের হাত ধরে কেঁদে দিয়ে খবর দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলেছে।
পরে শুনেছি আর্মী বন্ধু শেখ জামালের দোস্ত ক্যাপ্টেন মনজুর কাদের একা সেদিন ক্যান্টনমেন্টে বিদ্রোহ করে কোর্ট মার্শাল খেয়ে চাকুরী হারিয়েছিলেন। আর শুনেছি কাদের সিদ্দিকী নাকি কোন ধরনের বিদ্রোহ করেছিলেন। এই কয়েকজন খ্যাত-অখ্যাত মানুষের প্রতিবাদ ছাড়া কেউ কোন কথা বলেনি। কিন্তু আজকাল তখনকার অনেক মানুষের কুমির-কান্না সহ কত কত বেদনার কথা শুনে শুনে বিমোহিত ও অবাক হই। সেই সময়গুলোতে আসলে কি ভাবছিলেন আপনারা সেটিও মাঝে মধ্যে জানতে ইচ্ছে হয়। অবিশ্যি বর্তমানে শোকে মুহ্যমান হয়ে জবাবটিও গুছিয়ে বলতে পারবেননা, গলা ধরে আসবে, তাও জানি। একাকী শেখ হাসিনা আর শেখ রেহানা যে কান্নাটি কাঁদছেন তাঁদের সেই চোখের পানি আর বেদনার সাথে বাংলার সাধারণ মানুষেরা সমব্যথী হয়ে আছে ও থাকবে।