প্রকাশ: ৮ জুলাই ২০২১, ১:৩১
হাকিম বাবুল: পানিতে ডুবে গত ১৮ মাসে সারাদেশে ১ হাজার ৪০২ জন পানিতে ডুবে মারা গেছে। তাদের মধ্যে শিশুর স্যংখাই হলো ১ হাজার ১৬৪। যা মোট মৃত্যুর ৮৩ শতাংশ। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য বিশ্লেষণ করে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। ৮ জুলাই বৃহস্পতিবার বিকেলে সাংবাদিকদের নিয়ে আয়োজিত এক ভার্চূয়াল কর্মশালায় এ তথ্য তুলে ধরেছে গণমাধ্যম ও যোগাযোগ বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ‘সমষ্টি’।
ওই কর্মশালায় বিশ্লেষণের ভিত্তিতে প্রাপ্ত প্রবণতাগুলোও উপস্থাপন করা হয়েছে। পরিবারের সদস্যদের যথাযথ নজরদারি না থাকায় সবচেয়ে বেশি সংখ্যক পানিতে ডোবার ঘটনা ঘটে। অধিকাংশ শিশু বড়দের অগোচরে বাড়ি সংলগ্ন পুকুর বা অন্য জলাশয়ে চলে যায় এবং দুর্ঘটনার শিকার হয়। এসময় বলা হয়, সাধারণত পানিতে ডুবে মৃত্যুর সবগুলো ঘটনা গণমাধ্যমে উঠে আসেনা। দেশে জাতীয়ভাবে পানিতে ডুবে মৃত্যু নিয়ে কোনো তথ্যব্যবস্থা না থাকায় এর প্রকৃত চিত্রও উঠে আসেনা।
গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটরের (জিএইচএআই) সহযোগিতায় গণমাধ্যম ও যোগাযোগ বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ‘সমষ্টি’ গণমাধ্যমে প্রকাশিত ঘটনা থেকে পানিতে ডুবে মৃত্যুর এসব তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছে। প্রতিষ্ঠানটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৭ সালে প্রকাশিত প্রিভেন্টিং ড্রাওনিং : অ্যানইমপ্লিমেন্টেশন গাইডের উল্লেখ করে স্থানীয় পর্যায়ের মানুষজনকে সম্পৃক্ত করে দিবাযত্ন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেছে। এছাড়া পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু রোধে পারিবারিক পর্যায়ে সচেতনতা তৈরি ও জাতীয়ভাবে কর্মসূচি গ্রহণ করার উপর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় প্রতিষ্ঠান সুপারিশ করেছে।
এসব ঘটনায় সারাদেশে ১ হাজার ১৬৪ শিশুসহ মোট ১ হাজার ৪০২ জন ব্যক্তি পানিতে ডুবে মারা গেছে। তন্মধ্যে চার বছর বা কম বয়সী ৫১৪ জন, ৫ থেকে ৯ বছর বয়সী ৪৪৮ জন, ৯-১৪ বছরের ১৫৭ জন এবং ১৫-১৮ বছরের ৪৫ জন। ২৩৮ জনের বয়স ১৮ বছরের বেশি। নিহতদের মধ্যে ৫০৬ জন নারী। এদের মধ্যে কন্যাশিশু ৪৫০ জন। পুরুষ মারা যায় ৮৯০ জন, যাদের মধ্যে ৭০৮ জন শিশু। প্রকাশিত সংবাদ থেকে ছয়জনের লৈঙ্গিক পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
দিনের প্রথম ভাগে অর্থাৎ সকাল থেকে দুপুরের মধ্যে ৫৮৮ জন এবং দুপুর থেকে সন্ধ্যার আগে ৫৪৫ জন মারা যায়। এছাড়া সন্ধ্যায় ২৩৫ জন মারা যায়। ২২ জন রাতের বেলায় পানিতে ডোবে। ১২ জনের মৃত্যুর সময় প্রকাশিত সংবাদ থেকে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এ সময়ে ৯৭টি পরিবারের ২৩৮ জন সদস্য পানিতে ডুবে মারা যায়। যাদের মধ্যে শিশুর সঙ্গে ভাই অথবা বোন সহ ১১৮ জন, বাবা-মা সহ ১৯জন, দাদা-দাদি বা নানা-নানি সহ ৪ জন, চাচাত বা খালাতো ভাই বা বোন সহ ৮১ জন, চাচা-খালা সহ ১৭ জন মারা যায়।
সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে ঢাকা বিভাগে ৩২২ জন। এছাড়া চট্টগ্রামে ২৬৭ জন, রংপুরে ১৮৭, রাজশাহীতে ১৮৩, ময়মনসিংহে ১৪৩, বরিশালে ১২৩ ও খুলনা বিভাগে ১০৯ জন মারা যায়। এ সময়ে সবচেয়ে কম মৃত্যু ছিল সিলেট বিভাগে ৬৮ জন। তাছাড়া নেত্রকোনা জেলায় গত ১৮ মাসে সবচেয়ে বেশি ৬৬ জন মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায়। পরবর্তী স্থানগুলোতে রয়েছে ঢাকা, নোয়াখালী, দিনাজপুর, গাজীপুর ও কুড়িগ্রাম জেলা। এসব জেলায় যথাক্রমে ৫৯, ৫৪, ৫০, ৪২ ও ৩৯ জন মারা যায়। বান্দরবান, শরীয়তপুর ও নড়াইলÑএ তিনটি জেলায় উল্লেখিত সময়ে কারো মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, গত ১৮ মাসে ২০২০ সালের জুন থেকে অক্টোবর মাসের মধ্যে সর্র্বোচ্চ সংখ্যক ৫৭৭ জন মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায়। সবচেয়ে বেশি ১৭১ জনের মৃত্যু ঘটে আগস্ট মাসে। জুন মাসে ৯১ জন, জুলাই মাসে ১৬৩ জন। ২০২০ সালের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-জুন) ২১৭ জনের মৃত্যুর বিপরীতে ২০২১ সালের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-জুন) পানিতে ডুবে মারা যায় ৫৭৭ জন, যা গতবছরের ওই সময়ের তুলনায় ২৫৭ শতাংশ বেশি।
এক্ষেত্রে ধারণা করা যায় যে, প্রকৃত অর্থেই পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা বেড়েছে অথবা গণমাধ্যমে এ-সংক্রান্ত ঘটনার খবর আগের তুলনায় বেড়েছে। গত ১৮ মাসে ১ হাজার ২২২ জন কোনো না কোনোভাবে পানির সংস্পর্শে এসে ডুবে যায়। ১৮০ জন মারা যায় নৌযান দুর্ঘটনায়। প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে পানিতে ডুবে মৃতদের মধ্যে ৫৫ জন বন্যার পানিতে ডুবে মারা গেছে। নৌযান দুর্ঘটনার সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটে ২০২০ এর ২৯ জুন। বুড়িগঙ্গা নদীতে এমএল মর্নিংবার্ড নামের একটি ল ময়ূর-২ নামের আরেকটি বড় অঞ্চলের ধাক্কায় ডুবে যায়। এতে ৩২ জন মারা যায়। এছাড়া ৫ আগস্ট নেত্রকোনার মদন উপজেলায় হাওরে নৌকাডুবে ১৭ জন মারা যায়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৪ সালের বৈশ্বিক প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে ৫ বছরের কমবয়সী শিশু মৃত্যুর ৪৩ শতাংশের কারণ পানিতে ডুবে মারা যাওয়া। যুক্তরাষ্ট্রের ইনস্টিটিউট অফ হেল্থ মেট্রিক্স অ্যান্ড ইভালুয়েশন (আইএইচএমই) এর ২০১৭ সালে প্রকাশিত গ্লোবাল বারডেন অব ডিজিজ স্টাডি শীর্ষক প্রতিবেদনে বাংলাদেশে ২০১৭ সালে ১৪ হাজার ২৯ জন মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায়। এ রিপোর্ট অনুযায়ী পানিতে ডুবে মৃত্যুর দিক থেকে কমনওয়েল্থ দেশসমূহের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম।
জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ৫ বছরের নিচে শিশু মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ২৫ নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। রোগ-বালাইয়ের বাইরেও বাংলাদেশে প্রতিবছর বড় সংখ্যক শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। তাই শিশুমৃত্যু নিয়ে এসডিজি’র লক্ষ্য অর্জনে প্রতিরোধযোগ্য এ মৃত্যু কমানো জরুরি। পারিবারিক পর্যায়ে সচেতনতা সৃষ্টি ও সহযোগিতামূলক কার্যক্রমের মাধ্যেিম বহু সংখ্যক শিশুকে পানিতে ডুবে মৃত্যু থেকে রক্ষা করা সম্ভব। এটি করতে পারলে এসডিজি’র লক্ষ্য অর্জন সহজ হবে।
পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুরোধে কাজ করা বেসরকারি সংস্থ সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশের (সিআইপিআরবি) পরিচালক ড. আমিনুর রহমান জানান, দারিদ্র্য, অসচেতনতা ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের অভাবের কারণে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। এছাড়াও উদ্বেগের বিষয় হলো বাড়ির আশেপাশের ডোবা-নালা-পুকুর-খাল-বিল সবকিছু উন্মুক্ত। শিশুরা অন্যদের অলক্ষ্যে অবাধে জলাশয়ে চলে যায় এবং দুর্ঘটনার শিকার হয়। সাম্প্রতিক এক গবেষণা প্রতিবেদনের বরাতে তিনি বলেন, দিনের প্রথমভাগে শিশুদের নিবিড় তত্ত্বাবধানে রাখা হলে বাংলাদেশে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর হার ৭০ শতাংশ রোধ করা সম্ভব। এক্ষেত্রে গ্রামভিত্তিক শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র সফলভাবে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু রোধে কার্যকর।
লেখক: হাকিম বাবুল, শেরপুর; প্রতিনিধি, চ্যানেল আই।