প্রকাশ: ২৮ মে ২০২১, ১০:৫৪
হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার মক্রমপুর ইউনিয়নের নিশ্চিন্তপুর গ্রামে বাড়ীর সীমানা নিয়ে বিরোধকে কেন্দ্র করে ৬৫ বছরের বৃদ্ধা গোলাপ চান বিবিকে টেটা বিদ্ধ করে হত্যার ঘটনার রহস্য উদঘাটন হয়েছে। প্রতিপক্ষকে হত্যা মামলা দিয়ে ফাঁসানোর জন্য বৃদ্ধার ছেলে মোহাম্মদ আলী এই হত্যা করেছে বলে আদালতে ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে দায় স্বীকার করে। বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হবিগঞ্জের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তৌহিদুল ইসলামের আদালতে সে এই স্বীকারোক্তি দেয়।
আদালত পরিদর্শক আনিসুর রহমান এই তথ্য নিশ্চিত করেন। আদালতে মোহাম্মদ আলী জানান, তার চাচাত ভাইয়ের সাথে দীর্ঘদিন যাবত বাড়ির সীমানা নিয়ে বিরোধ চলে আসছিল। এ বিরোধ নিস্পত্তি করার জন্য বুধবার সকালে বাড়িতে শালিস বৈঠক শুরু হয়। শালিসে উভয় পক্ষের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে ধাওয়া পাল্টা হয়।
এ সময় চাচাত ভাই কাদিরকে ফাঁসাতে রাগের মাথায় টেটা দিয়ে মাকে আঘাত করে। এর কিছুক্ষণ পরই তার মা মারা যায়। এরপর আমি মাকে কাদির গং হত্যা করেছে বলে চিৎকার শুরু করি। এ সময় মধ্যে গ্রেফতার এড়াতে কাদির মিয়া ও তার পক্ষের লোকজন বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। সাথে সাথে তার নানা বাড়ির আত্মীয় স্বজনদের নিয়ে বাড়িঘর ভাংচুর ও লুটপাট শুরু করে।
এ ব্যাপারে হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আলী জানান, প্রতিপক্ষকে ফাসাতে গিয়ে গর্ভধারীনীকে টেটা দিয়ে আঘাত করে হত্যা করেছে ঘাতক ছেলে মোহাম্মদ আলী। সে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দি দিয়েছে। তিনি বলেন, এঘটনার সাথে আরো কারা জড়িত রয়েছে সেই বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য পুলিশ তদন্ত করছেন। যেহেতু সংঘর্ষ হয়েছে সেহেতু এ ঘটনার আরো জড়িত থাকতে পারে। তদন্তে যাদেরইকে জড়িত পাওয়া যাবে তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হবে। গতকালই মোহাম্মদ আলীকে গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, নিশ্চিন্তপুর গ্রামের মোহাম্মদ আলী ও তার চাচাত ভাই আব্দুল কাদিরের মধ্যে বাড়ির সীমানা, পানি নিস্কাশনের রাস্তাসহ জমি-জমা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলছিল। এ বিরোধের জের ধরে উভয় পক্ষের মধ্যে চলছে মামলা মোকদ্দমা। স¤প্রতি বানিয়াচং থানা পুলিশ উভয়পক্ষকে ডেকে এ ঘটনাটি নিষ্পত্তি করার আশ্বাস দেন।
এর মধ্যে বুধবার সকালে মোহাম্মদ আলী ও তার চাচাত ভাই আব্দুল কাদিরকে নিয়ে এলাকার মুরুব্বীয়ান সামাজিক বিচারে বসেন। বিচারের মধ্যে উভয়পক্ষের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে উভয়পক্ষ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। এর মধ্যে ফিকলের আঘাতে মোহাম্মদ আলীর মা গোলাপ চান বিবি ঘটনাস্থলেই মারা যান।
এ অবস্থায় মোহাম্মদ আলী তার মাকে কাদির গংরা হত্যা করেছে বলে শোর চিৎকার শুরু করে লোকজন নিয়ে কাদির গংদের বাড়িঘরে হামলা ভাংচুর ও লুটপাট চালায়। পরে খবর পেয়ে পুলিশ সুপার মোহাম্মদ উল্ল্যা, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বানিয়াচং-সার্কেল) পলাশ কুমার রঞ্জন, বানিয়াচং থানার ওসি এমরান হোসেন, ওসি তদন্ত প্রজিত দাশসহ একদল পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করেন।
ঘটনাস্থলে পুলিশের কাছে গোলাপ জান বিবি’র ছেলে মোহাম্মদ আলী জানান, কাদির মিয়া গং তার মাকে ফিকল দিয়ে আঘাত করে হত্যা করেছে। অপরদিকে পুলিশকে জানানো হয়, নিহত গোলাপ চান বিবির ছেলে মোহাম্মদ আলী ফিকল দিয়ে আঘাত করে তার মাকে হত্যা করেছে। এসব তথ্য ও নিহতের আঘাতের চিহ্ন দেখে পুলিশ বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে।
পরবর্তীতে সেখানে পিবিআইয়ের পরিদর্শক আব্দুল মালিকের নেতৃত্বে একটি বিশেষজ্ঞ তদন্ত টিম গিয়ে দিনভর তদন্ত করে। হত্যার ঘটনায় রহস্য সৃষ্টি হওয়ায় নিহতের ছেলে মোহাম্মদ আলী, তার স্ত্রী, মেয়ে ও ছেলেকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। বিকেল ৪টার দিকে ঘটনাস্থলে যান পুলিশ সুপার মোহাম্মদ উল্ল্যা ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শৈলেন চাকমা। গতকাল নিহতের লাশের ময়না তদন্ত শেষে নয়া পাতারিয়া গ্রামের পারিবারিক কবর স্থানে দাফন করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে বানিয়াচং থানার (ওসি) এমরান হোসেন বলেন, প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে মাকে ছেলে হত্যা করেছে বলে নিশ্চিত হয়ে সুপার সুপারের নিদের্শে ঘটনাস্থলে গিয়ে আমার বিষয়টি যাছাই বাছাই করার সময় ঘটনার সত্যতা পেয়ে মোহাম্মদ আলীকে পুলিশ হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করি।
জিজ্ঞাসাবাদে সে নিজেই হত্যা করেছে বলে স্বীকার করলে বৃহস্পতিবার বিকেলে তাকে আদালতে প্রেরণ করা হয় ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি গ্রহণ করা জন্য। আদালতে সে স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দি দেয়। তিনি আরও জানান, আব্দুল কাদির এর বাড়ীঘর লুটপাটের ঘটনায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। ঘটনার সাথে আরো কারা জড়িত এবং কাদের পরোচনায় মোহাম্মদ আলী তার মা গোলাপ চান বিবিকে হত্যা করেছে এ ব্যাপারে তাকে আরো জিজ্ঞাসাবাদ করবে প্রশাসন।
কাদির মিয়া জানান, ইতির্পূবে তাকে কয়েকবার হত্যা চেষ্টা করে। এ বিষয়টি আমি পুলিশকে অবগত করেছি এবং আদালতে এ ব্যাপারে মামলা দায়ের করেছি। এ ঘটনার আগের দিন আমাকে ফাসাবে বলে হুমকি দেয় এবং আত্মীয় স্বজনদের সাথে যোগাযোগ করে সকল পরিকল্পনা গ্রহন করে। পরিকল্পনা মোতাবেক কাজ শেষ করে আমার বাড়িঘরে ভাংচুর ও ব্যাপক লুটপাট করে।
আমার ২টি গরুসহ ঘরে থাকা নগদ ২ লাখ টাকা, স্বর্ণলংকার, ধান, চালসহ কয়েক লাখ টাকার মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে নিহত গোলাপ চান বিবি’র ছেলেকে মক্রমপুর ইউনিয়নের ২ জন জনপ্রতিনিধি সহযোগিতা করেছেন। তাদের ফোনের কল লিস্ট দেখলেই এর সত্যতা নিশ্চিত হওয়া যাবে।