প্রকাশ: ৩ মার্চ ২০২১, ১৩:৫২
বরিশালে দিন দিন বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা। প্রতিদিনই কোন না কোন স্থানে সড়কে ঝড়ছে তাজা প্রাণ। দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে দেখা যায়, সরকারি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে মহাসড়কে থ্রি হুইলার, অটোরিক্সা ও অযান্ত্রিক যানবাহন চলাচল করায় দুর্ঘটনা বাড়ছে।
যদিও সড়কে দুর্ঘটনা কমিয়ে আনার লক্ষ্যে ২০১৫ সালে দেশের ২২টি মহাসড়কে ওই সকল যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। তবে ওই নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে ধীরগতি, অশিক্ষিত ও অদক্ষ চালক, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব ও মানবিকতায় সড়কে তাজা প্রাণ ঝড়া রোধ করা যাচ্ছেনা বলে মত প্রকাশ করেন নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)’র নেতৃবৃন্দ।
অপরদিকে পুলিশের পক্ষ বলা হচ্ছে, করোনার কারণে হার্ডলাইনে যেতে পারছেন না তারা। তবে ওইসব যানবাহন চলাচল বন্ধ করতে তাদের পক্ষ থেকে অভিযান ও প্রচার প্রচারণা অব্যাহত রয়েছে।সড়কে দুর্ঘটনা কমিয়ে নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ২০১৫ সালের ১ আগস্ট থেকে সারা দেশের মহাসড়কগুলোতে থ্রি হুইলার,
অটোরিকশা ও অযান্ত্রিক যানবাহন (নছিমন, করিমন, ভটভটি) চলাচল নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। প্রথম দফায় ২২টি মহাসড়ক নির্ধারণ করে দেয়া হয়। যার মধ্যে ঢাকা-মাওয়া-কাওড়াকান্দি-ভাঙ্গা-বরিশাল-পটুয়াখালী মহাসড়ক ছিল। ঢাকা থেকে পটুয়াখালী পর্যন্ত ৩১৭ কিঃমিঃ মহাসড়ক রয়েছে। এই মহাসড়কে সরকারি নিষেধাজ্ঞাকে পাত্তা না দিয়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত থ্রি হুইলার (ইজিবাইক) ও মোটরচালিত রিকশা চলাচল করছে।
ওই সব যানবাহন ছাড়াও মহাসড়কে দূরপাল্লার পরিবহন, ভারি মালবাহী ট্রাক, পিকআপ, লোকাল বাস, মটরসাইকেল চলাচল করছে। আর দ্রুতগতির প্রতিযোগিতাতো থাকছেই। কখনো কখনো পুলিশের অভিযানের মুখে এগুলোর চলাচল সাময়িক বন্ধ থাকলেও অভিযান থেমে গেলে পরিস্থিতি ফিরছে আগের অবস্থায়। ফলে প্রতিদিনই কোন না কোন সড়কে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ।
নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) কর্তৃক দুর্ঘটনার পরসিংখ্যান সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালে বরিশাল বিভাগে মোট ২৪৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২৪৩ জন শিশুসহ নারী-পুরুষ। এতে আহত হয়েছেন ৪৫৭ জন। বরিশাল বিভাগে ২০২০ সালে সবচেয়ে আলোচিত ও মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে গত ৯ সেপ্টেম্বর বিকেলে।
ওইদিন ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের উজিরপুর উপজেলার আঁটিপাড়া এলাকায় মৃত নবজাতকের লাশ নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে কাভার্ডভ্যান, অ্যাম্বুলেন্স ও যাত্রীবাহী বাসের ত্রিমুখী সংঘর্ষে নবজাতকের বাবাসহ একই পরিবারের পাঁচ সদস্য ও অ্যাম্বুলেন্স চালকের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। এর মধ্যে বরিশাল জেলায় ১০৪ সড়ক দুর্ঘটনায় ৯৩ জন নিহত ও আহত হয়েছেন ২৩৮ জন, ঝালকাঠিতে ২০ সড়ক দুর্ঘটনায় ১৮ জন নিহত ও আহত হয়েছেন ৬০ জন,
পিরোজপুরে ২০ সড়ক দুর্ঘটনায় ২২ জন নিহত ও আহত হয়েছেন ৯ জন, পটুয়ালীতে ৪২ সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৩ জন নিহত ও আহত হয়েছেন ৪৬ জন, বরগুনায় ১৯ সড়ক দুর্ঘটনায় ২২ জন নিহত ও আহত হয়েছেন ৩১ জন, ভোলায় ৩৯ সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৫ জন নিহত ও ৭৩ জন আহত হয়েছেন।
পরিসংখ্যান মতে, বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানী হয়েছে বরিশাল জেলায়। বরিশাল জেলা পুলিশ মোঃ মারুফ হোসেন পিপিএম বলেন, সড়কে থ্রি-হুইলার চলাচল বন্ধে পুলিশের পক্ষ থেকে নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে। অবশ্য করোনার কারণে তাঁরা হার্ডলাইনে যেতে পারছেন না জানিয়ে তিনি বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা এড়াতে নিয়মিত উঠান বৈঠক, সচেতনতামূলক প্রচারণা চলমান আছে।
দুর্ঘটনায় দ্বিতীয় স্থানে থাকা পটুয়াখালী জেলা পুলিশ সুপার মোঃ মইনুল হাসান বলেন, মহাসড়কে থ্রি হুইলার চলাচল বন্ধে সব সময়ই অভিযান চলছে। যা একটি চলমান প্রক্রিয়া উল্লেখ করে তিনি বলেন, শুধু অভিযান চালিয়ে সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব নয়। এজন্য সকলের সচেতনতার পাশাপাশি দুর্ঘটনা এড়াতে সমন্বিত উদ্যোগের কথা বলেন তিনি।
সূত্রমতে, জাতীয় মহাসড়কে ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার, আঞ্চলিক মহাসড়কে ৬০ ও জেলা সড়কে ৪০ কিলোমিটার গতিবেগে গাড়ি চালানোর নিয়ম রয়েছে। কিন্তু চালকেরা এ নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেন না। হাইওয়ে পুলিশের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের অংশের যা অবস্থা, তাতে কোনো অবস্থাতেই ৬০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে গাড়ি চালানো উচিত নয়। কিন্তু দূরপাল্লার গাড়িগুলো এখানে ১০০ থেকে ১১০ কিলোমিটার গতিতে চলে।
জেলা শ্রমিক ইউনিয়নের এক নেতা বলেন, ব্যবসার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে অনেকে বেশি গতিতে গাড়ি চালান। প্রতিনিয়ত চালকদের সঙ্গে সভা করে তাঁরা বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালাতে নিষেধ করছেন। পাশাপাশি সড়কে নছিমন, করিমন, ভটভটি, মাহিন্দ্রা, ইজিবাইকসহ বিভিন্ন যান চলে। এগুলোর চালকেরা দক্ষ নন। এটাও দুর্ঘটনার বড় কারণ বলে মনে করেন তিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক থ্রি হুইলার চালক জানান, লোকাল গণপরিবহনে যাতায়াতে সময় বেশি ব্যয় হওয়ায় যাত্রীরা সিএনজি, আলফা মাহিন্দ্রা ও অটোরিকশায় যাতায়াত করে। এক প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন, পেটের তাগিদে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়েই তারা মহাসড়কে থ্রি হুইলার চালাচ্ছেন।
এদিকে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস-২০২০ উদযাপন অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাদকাসক্ত অবস্থায় গাড়ি চালানো বন্ধে চালকদের ডোপ টেস্ট করানোর ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন। পাশাপাশি জনসচেতনতার কথাও বলেছেন তিনি। তবে তা বাস্তবায়নে শ্রমিক মালিক সংগঠন ও পুলিশের সমন্বয়হীনতার অভাব রয়েছে। তাছাড়া অনেক চালক ও তার সহযোগি যে মাদকাসক্ত তা কেউ প্রকাশ্যে স্বীকার করছে না।
বরিশাল জেলা পুলিশ সুপার মোঃ মারুফ হোসেন পিপিএম বলেন, মহাসড়কে থ্রি হুইলার চলাচলের নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে কাজ করছে পুলিশ। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চালকদের ডোপ টেস্ট কার্যক্রম চালাতে শ্রমিক ও মালিক সংগঠনগুলোর উদ্যোগ নিতে হবে। তারা যদি উদ্যোগ নেন তাহলে পুলিশের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা হবে বলেন তিনি।
বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (ট্রাফিক) জাকির হোসেন মজুমদার বলেন, মহাসড়কে থ্রি হুইলারের চলাচল সম্পূর্ণ অবৈধ। পুলিশ নিয়মিতভাবে এসব যানবাহনের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে। পাশাপাশি মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত প্রচার প্রচারণাও চালানো হচ্ছে বলেন তিনি।
নিরাপদ সড়ক চাই’র (নিসচা)’র চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, অদক্ষ চালক, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব ও নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন না করা সহ বিভিন্ন কারণে প্রতিনিয়ত এসব দুর্ঘটনা ঘটছে। “আমাদের দেশ স্বল্প উন্নত থেকে উন্নত দেশে পরিনত হচ্ছে, দেশের উন্নয়ন হচ্ছে।
” করোনার কারণে মহাসড়কে থ্রি হুইলার বেড়েছে এটা যুক্তিসংগত নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, মহাসড়কে থ্রি হুইলার চলাচল বন্ধে হার্ডলাইনে গেলে পরিবহন সেক্টরে আন্দোলন হতে পারে। আর তেমনটি হলে দেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হতে পারে মনে করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ মূলত: এ বিষয়ে শিথিলতা দেখাচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।
চালকদের ডোপ টেস্ট করানোর ব্যাপারে তিনি বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে আদেশ দিয়েছেন। তবে ডোপ টেস্ট করাতে হলে খরচ কে বহন করবে তা নির্ধারণে চিঠি চালাচালি হচ্ছে বলেন জানান তিনি।