৫টাকা নোটে মুদ্রিত ইতিহাস ও মুসলিম ঐতিহ্যের উজ্জল নিদর্শন কুসুম্বা মসজিদ

নিজস্ব প্রতিবেদক
রিফাত হোসাইন সবুজ, জেলা প্রতিনিধি, নওগাঁ
প্রকাশিত: মঙ্গলবার ২রা মার্চ ২০২১ ০১:০৭ অপরাহ্ন
৫টাকা নোটে মুদ্রিত ইতিহাস ও মুসলিম ঐতিহ্যের উজ্জল নিদর্শন কুসুম্বা মসজিদ

পাঁচ টাকার নোটে মুদ্রিত রয়েছে ঐতিহাসিক মসজিদটির ছবি। বাংলাদেশে সুলতানি আমলের যত নিদর্শন আছে তার মধ্যে এটি একটি। হ্যাঁ, কুসুম্বা মসজিদের কথাই বলা হচ্ছে। সাড়ে ৪০০ বছরের ঐতিহ্য ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে মসজিদটি।



নওগাঁ জেলা শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে মান্দা উপজেলার কুসুম্বা ইউনিয়নের কুসুম্বা গ্রামে অবস্থিত কুসুম্বা মসজিদ। রাজশাহী মহাসড়কের মান্দা ব্রিজের পশ্চিম দিকে ৪০০ মিটার উত্তরে কুসুম্বা মসজিদটির অবস্থান। প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থী আসেন এই মসজিদটি দেখার জন্য।


মসজিদটির উত্তর-দক্ষিণ দিকে রয়েছে ৭৭ বিঘার একটি বিশাল দিঘি। দিঘিটি লম্বায় প্রায় ১২০০ ফুট ও চওড়ায় প্রায় ৯০০ ফুট। গ্রামবাসী এবং মুসল্লিদের খাবার পানি, গোসল ও অজুর প্রয়োজন মেটানোর জন্য এই দিঘিটি খনন করা হয়েছিল।


কুসুম্বা মসজিদটি উত্তর-দক্ষিণে ৫৮ ফুট লম্বা, ৪২ ফুট চওড়া। চারদিকের দেয়াল ৬ ফুট পুরু। তার ওপর বাইরের অংশ পাথর দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। মসজিদের সামনের অংশে রয়েছে তিনটি দরজা। আকারে দুটি বড়, অন্যটি অপেক্ষাকৃত ছোট। দরজাগুলো খিলানযুক্ত মেহরাব আকৃতির। মসজিদের চার কোনায় রয়েছে চারটি মিনার। মিনারগুলো মসজিদের দেয়াল পর্যন্ত উঁচু ও আট কোনাকার। ছাদের ওপর রয়েছে মোট ছয়টি গম্বুজ। যা দুইটি সারিতে তৈরি।


কুসুম্বা মসজিদ দ্বিতীয় সারির গম্বুজগুলো আকৃতির দিক দিয়ে ছোট। ১৮৯৭ সালের এক ভূমিকম্পে তিনটি গম্বুজ নষ্ট হয়েছিল। পরে প্রত্নতত্ত¡ অধিদপ্তর মসজিদটি সংস্কার করে। মসজিদের ভেতর দুটি পিলার রয়েছে। উত্তর দিকের মেহরাবের সামনে পাথরের পিলারের ওপর তৈরি করা হয়েছিল একটি দোতলা ঘর। এই ঘরটিকে বলা হতো জেনানা গ্যালারি বা মহিলাদের নামাজের ঘর। এখানে মহিলারা নামাজ পড়তেন।


মসজিদের ভেতর পশ্চিমের দেয়ালে রয়েছে তিনটি চমৎকার মেহরাবের ওপর ঝুলন্ত শিকল, ফুল ও লতাপাতার কারুকাজ করা। এ কারুকার্যগুলো খুব উন্নতমানের। দক্ষিণ দিকের মেহরাব দুইটি আকারে বড়। উত্তর দিকের মেহরাবটি ছোট। মসজিদটির উত্তর-দক্ষিণ দিকে দুটি করে দরজা ছিল। মসজিদের সম্মুখ ভাগে রয়েছে খোলা প্রাঙ্গণ ও পাথর বসানো সিঁড়ি, যা দিঘিতে গিয়ে নেমেছে। মসজিদের প্রবেশপথের একটু দূরে বাক্স আকৃতির এক খন্ড কালো পাথর দেখা যায়। এটিকে অনেকে কবর বলে মনে করেন।


কুসুম্বা মসজিদ সবরখান বা সোলায়মান নামে ধর্মান্তরিত এক মুসলমান মসজিদটি নির্মাণ করেন। মসজিদের দুটি শিলালিপি এর প্রতিষ্ঠাকাল সম্পর্কে মানুষের মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। তবে মূল প্রবেশপথে শিলালিপি থেকে প্রমাণিত হয় এই মসজিদটি ৯৬৬ হিজরি বা ১৫৫৮ খ্রিষ্টাব্দে তৈরি। শের শাহের বংশধর আফগান সুলতান প্রথম গিয়াস উদ্দীন বাহাদুরের শাসনামলে (১৫৫৪-১৫৬০ সালে) নির্মিত। সে হিসাবে মসজিদটির বর্তমান বয়স ৪৫৮ বছর। সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহের আমলে তার মন্ত্রী বা প্রশাসনিক কর্মকর্তা রামন দল ৯০৪ হিজরি বা ১৪৯৮ খ্রিষ্টাব্দে মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করেন।


মসজিদে ঘুরতে আসা  নজরুল ইসলাম নামের দর্শনার্থীর সাথে কথা হলে তারা  বলেন, ‘পাঁচ টাকার নোটে ছবি দেখে অনেক দিনের ইচ্ছা ছিল এখানে বেড়াতে আসার। চারপাশের পরিবেশ অনেক সুন্দর। এখানে এসে ঘুরতে পেরে ভালো লাগছে। 


খোরশেদ আলম, সৈকত হোসেনসহ কয়েকজন দর্শনার্থী জানান, এখানে ঘুরতে এসে সত্যি খুবই ভালো লাগছে তবে যদি এখানে একটি রেষ্ট হাউস নির্মান করা হয় তবে এখানে ঘুরতে আসা দূর দূরান্তের দর্শনার্থীদের জন্য সুবিধা হতো। 


কুসুম্বা মসজিদের মুয়াজ্জিন মাওলানা ইসরাফিল আলম  জানান, প্রতিদিনই দূরদূরান্ত থেকে অসংখ্য মানুষ আসেন কুসুম্বা মসজিদ ঘুরে দেখতে। এখানে এসে অনেকেই নামাজ আদায় করেন । তবে শুক্রবার জুমার সময় বেশি মুসল্লির আগমন ঘটে।


মান্দা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আব্দুল হালিম জানান, কুসুম্বা মসজিদটি নওগাঁর ঐতিহাসিক স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম। এখানে প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থী আসেন মসজিদটি দেখার জন্য। দর্শনার্থীদের সুযোগ-সুবিধার জন্য অজু ও গোসলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ ছাড়া পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা রয়েছে। দর্শনার্থীদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির জন্য নানা ধরনের প্রকল্প গ্রহণ করার কথা জানান তিনি।