জুলাই ও আগস্ট মাসে রাজধানীতে ৯০ জনের বেওয়ারিশ লাশ দাফন করেছে আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম। দাফন করা ব্যক্তিদের বেশির ভাগই কোটা সংস্কার আন্দোলন ও পরবর্তীতে এক দফার আন্দোলনে মারা যান। সরজমিন রাজধানীর রায়েরবাজার কবরস্থানে দেখা যায়, কবরস্থানটির ৪ নম্বর ব্লকে সারিবদ্ধভাবে অজ্ঞাতনামা লাশ দাফন করা হয়েছে। এসব কবরের কোনোটাতেই নেই কোনো নামফলক, চিহ্ন বা সাইনবোর্ড। নতুন কবরগুলো বাদে বৃষ্টিতে মাটি ধুয়ে বেশিরভাগ কবরেরই উঁচু ঢিবি সমান হয়ে গেছে। কোনো কোনো কবরের মাটি সরে ফাঁকা হয়ে গেছে। গোরস্থানটির দেখভালের দায়িত্বে থাকা মাওলানা ফেরদৌস বলেন, বেওয়ারিশ লাশগুলো সাধারণত গোরস্থানের ৪ নম্বর ব্লকে দাফন করা হয়। অন্যান্য ব্লকের কবরগুলো তাদের স্বজনদের মাধ্যমে দেখাশোনা করা হয়। ফলে সেগুলোর পাশে নামফলক থাকে। স্বজনরা কেউ গাছ লাগান, কেউ দামি ঘাস লাগান।
তবে বেওয়ারিশ লাশের ক্ষেত্রে সেটি হয় না। এ ক্ষেত্রে কবরের ওপর থাকে শুধুই মাটি। তাই বেওয়ারিশ লাশের কবর দেখলেই বোঝা যায়। রহম আলী, নজরুল ইসলামসহ কবরস্থানে কাজ করা বেশ কয়েকজন গোরখোদক ৪ নম্বর ব্লকের কবরগুলো দেখিয়ে বলেন, এগুলো সব বেওয়ারিশ লাশ। আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম থেকে আমাদের কাছে পাঠায়, আমরা দাফন করি। তারাই গোসল করে দাফনের কাপড় পরিয়ে আমাদের কাছে আনে। আমরা শুধু দাফন করি। এজন্য এদের কার শরীরে গুলি লাগা বা কে কীভাবে মারা গেছেন সে সম্পর্কে আমরা বেশি কিছু বলতে পারি না। তারা বলেন, আমাদের জানামতে, এখন পর্যন্ত দাফন হওয়া এসব বেওয়ারিশ লাশের মধ্যে একজনের পরিচয় মিলেছিল। তবে তাকে ওই অবস্থায়ই রাখা হয়েছে।
বাকিদের খোঁজ এখনো মেলেনি। রায়েরবাজার কবরস্থানে বেওয়ারিশ লাশ দাফনের দায়িত্বে থাকা গোলাম রব্বানী বলেন, আমরা লাশ দাফন করি, কারও মৃত্যুর কারণ আমাদের জানা নেই। অজ্ঞাতনামাদের লাশ দাফনের ক্ষেত্রে আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম শুধু কাফনের কাপড় দেয়। বাঁশ, চাটাইসহ অন্যান্য খরচ কবরস্থানের পক্ষ থেকে বহন করা হয়। মাস শেষে এসবের হিসাব সিটি করপোরেশনে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম সূত্র জানায়, গত জুলাই মাসের এক তারিখ থেকে ১৯শে আগস্ট পর্যন্ত মোট ৯১ জনের লাশ দাফন করেছে আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম। এদের মধ্যে একজন বিদেশি নাগরিক। যাকে সেই দেশের অনুরোধে আঞ্জুমান দাফন করেছে। বাকি ৯০ জনের লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়। তাদের মধ্যে ৫৪ জনের লাশ ঢাকা মেডিকেল থেকে দেয়া হয় আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামে। এ ছাড়াও শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ১৫টি, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ১০টি, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ৮টি, কমলাপুর রেলওয়ে থানা থেকে ১টি ও অজ্ঞাত আরও ১টি লাশ পেয়েছে সংগঠনটি। বেওয়ারিশ লাশগুলো সিটি করপোরেশন নির্ধারিত স্থান মোহাম্মদপুরের রায়েরবাজার কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। যাদের বেশিরভাগই ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় নিহত।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের পরিচালক মো. শফিউর রহমান বলেছেন, আমাদের হাসপাতালের মর্গে সব মিলিয়ে অর্ধশতাধিক লাশ এসেছিল। তাদের প্রত্যেকের শরীরেই গুলির চিহ্ন ছিল। সবশেষ আমাদের মর্গে পাঁচটি লাশ ছিল। দুই দিনে দু’টি লাশ স্বজনেরা নিয়ে গেছেন। এরপর আরও দু’টি লাশ শনাক্ত হয়। এখনো একটি লাশ মর্গে আছে। তারও পরিচয় শনাক্তের চেষ্টা চলছে। আর দীর্ঘদিন মর্গে রাখার পরও যাদের পরিচয় শনাক্ত হয়নি তাদের আঞ্জুমানের মাধ্যমে দাফন করা হয়েছে। সে সংখ্যাও কম। তবে বেওয়ারিশভাবে দাফন হওয়াদের মধ্যে তেমন কারও খোঁজ মেলেনি।
ঢাকা মেডিকেলের মর্গ সহকারী রামু চন্দ্র দাস বলেছেন, আমাদের এখানে আসা লাশগুলোর বেশির ভাগই তাদের স্বজনরা শনাক্ত করে নিয়ে গেছেন। আর দীর্ঘদিন মর্গে রাখার পরও যেসব লাশের নাম-ঠিকানা বা পরিচয় পাওয়া যায়নি, তাদের শাহবাগ থানার মাধ্যমে আঞ্জুমানের কাছে দাফনের জন্য হস্তান্তর করা হয়েছে। যে লাশ পাঠানো হয়েছিল তাদের কয়েকজন গুলিবিদ্ধ ছিল, আর কয়েকজনের শরীরে মারাত্মক জখমের আঘাত ছিল। পিটিয়ে মারলে যেরকম হয়, সেরকম আঘাত ছিল কয়েকজনের পিঠে। সবশেষ সোমবার সকালে ৮ জনের লাশ আঞ্জুমানের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
শেরেবাংলা নগর থানার ওসি (তদন্ত) সজীব দে বলেন, আমাদের কাছে যেসব লাশ এসেছিল তার প্রায় সবগুলোই আমরা ইতিমধ্যে হস্তান্তর করেছি। বাকি তিনটি লাশ ছিল তার মধ্যেও দু’জনের লাশ স্বজনেরা শনাক্ত করে নিয়ে গেছে। একজন মহিলার লাশ এখনো মর্গে আছে, তার পরিচয় শনাক্তে চেষ্টা চলছে। আর যেই লাশগুলো বেওয়ারিশভাবে আঞ্জুমানে দেয়া হয়েছে, সেগুলোর ছবি ও আঙ্গুলের ছাপ রেখে দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া প্রত্যেকের ডিএনএ প্রোফাইল সংরক্ষণ করে সংশ্লিষ্ট থানায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট থানায় যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।
শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোস্তাজিরুর রহমান বলেন, এখন পর্যন্ত আমাদের এখানে বেওয়ারিশ লাশের খোঁজ নিতে কেউ আসেনি। বেওয়ারিশ হিসেবে যাদের কবর দেয়া হয়েছে, তাদের ছবি ও আঙ্গুলের ছাপ রেখে দেয়া হয়েছে। নিহতদের ছবি, আঙ্গুলের ছাপ সংগ্রহ করা আছে। এ ছাড়া প্রত্যেকের ডিএনএ প্রোফাইল সংরক্ষণ করা হয়েছে। যদি কেউ খোঁজ নিতে আসে তাহলে অবশ্যই তাদের তথ্য সরবরাহ করা হবে।
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।