দীর্ঘদিনের শাসক শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর বাংলাদেশের ছাত্রনেতাদের উদ্যোগে গঠিত নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) চলতি বছরে যাত্রা শুরুর সময় ব্যাপক জনসমর্থন পেলেও এখন ভোটের রাজনীতিতে টিকে থাকার কঠিন লড়াইয়ে পড়েছে। ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে অর্জিত জনসমর্থনকে নির্বাচনী শক্তিতে রূপান্তর করতেই দলটি এখন সবচেয়ে বড় সংকটে রয়েছে।
রাজপথে সক্রিয় থাকা তরুণেরা গত বছরের ভয়াবহ সরকারবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে নিজেদের পরিচিত করান, যার নেতৃত্বে ছিলেন নাহিদ ইসলাম—বর্তমান এনসিপির আহ্বায়ক। তিনি নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেও সংক্ষিপ্ত সময় দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তবে এখন ২৭ বছর বয়সী এই নেতা কার্যকর সাংগঠনিক কাঠামোর অভাবে স্পষ্টতই উদ্বিগ্ন।
নাহিদ ইসলামের ভাষায়, “আমাদের সংগঠন দুর্বল; কারণ এটিকে গড়ে তোলার জন্য পর্যাপ্ত সময় পাইনি। কিন্তু আমরা চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছি।”
জরিপ বলছে, এনসিপির সামনে পথ আরও কঠিন। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই)-এর ডিসেম্বর জরিপ অনুযায়ী, বিএনপি যেখানে ৩০% ভোট নিয়ে শীর্ষে, জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন ২৬%, সেখানে এনসিপির
নতুনদের দিকে তাকানো অনেক তরুণ ভোটারও এখন হতাশ। বিক্ষোভে থাকা ২৫ বছর বয়সী প্রাপ্তি তাপসী বলেন, “তারা মধ্যপন্থী বললেও সংখ্যালঘু অধিকার বা নারীর অধিকার–কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েই যথাযথ অবস্থান নেয়নি।”
এনসিপির রাজনৈতিক দুর্বলতার বড় প্রমাণ দেখা যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে। সেখানে তারা একটিও আসন পায়নি। বিশ্লেষকরা বলছেন, দলটি যেভাবে দ্রুত জনপ্রিয় হয়েছিল, ঠিক তেমনি দ্রুতই তারা ভোটের বাস্তবতায় ধাক্কা খাচ্ছে।
এদিকে এনসিপির সঙ্গে বিএনপি ও জামায়াত–উভয় দলেরই সীমিত পর্যায়ে যোগাযোগ চলছে। একজন সিনিয়র নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “স্বাধীনভাবে লড়লে হয়তো একটি আসনও জিততে পারব না।” তবে জোট করলে ‘বিপ্লবী’ ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হতে পারে বলে সতর্ক করছেন বিশ্লেষকরা।
তহবিল সংগ্রহও এনসিপির জন্য বড় বাধা। প্রচারণা চালাতে তাদের ভরসা মূলত চাকরিজীবী সদস্যদের বেতন, ছোট অনুদান এবং ক্রাউডফান্ডিং। গ্রামে গ্রামে ঘুরে ভোট চাইছেন হাসনাত আবদুল্লাহ’র মতো তরুণ নেতারা, যিনি বলেন, “একজন নেতার কাজ ভোটারদের টাকা দেওয়া নয়; বরং সরকারি তহবিল সঠিকভাবে ব্যবহার নিশ্চিত করা।”
এদিকে দলের কিছু নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগও এনসিপির ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। যদিও দলটি অভিযোগ সম্পূর্ণ অস্বীকার করে বলছে, তাদের ‘শূন্য সহনশীলতা নীতি’ রয়েছে।
তবু আশার আলো দেখছেন অনেক তরুণ। মনজিলা রহমান নামের এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী বলেন, “তারা তরুণ, তারা বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছে—আমি বিশ্বাস করি তারা পরিবর্তন আনতে পারবে, যদি নিজেরা কর্তৃত্ববাদী না হয়ে যায়।”
দলটি সম্প্রতি নতুন ধরনের প্রার্থী অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু করে। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে দুই দিনে ১,০০০ এর বেশি আবেদন আসে। রিকশাচালক থেকে শুরু করে আংশিকভাবে অন্ধ ছাত্র—সবাইকে সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়।
কেমব্রিজে সফল ক্যারিয়ার ছেড়ে এনসিপিতে যোগ দেওয়া তাসনিম জারা বলেন, “আমরা রাজনীতিকে সাধারণ মানুষের কাছে ফিরিয়ে দিতে চাই। এটি আর অভিজাত পরিবারের মধ্যে আবদ্ধ রাখতে চাই না।”
আগামী নির্বাচনের চাপে দল যখন সংগ্রাম করছে, তখন এনসিপি নেতারা বলছেন, তারা নির্বাচনী ফলের বাইরে আরও দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের লক্ষ্যে কাজ করছেন। হাসনাত আবদুল্লাহর ভাষায়, “জয় বা পরাজয়—আমরা নতুন কিছু অফার করছি দেশকে।”