চরবাড়িয়ায় পতনের অপেক্ষায় সুরুজের দখল সাম্রাজ্য

নিজস্ব প্রতিবেদক
এম. কে. রানা - বার্তা প্রধান ইনিউজ৭১
প্রকাশিত: শনিবার ২৩শে নভেম্বর ২০১৯ ১০:৫৭ অপরাহ্ন
চরবাড়িয়ায় পতনের অপেক্ষায় সুরুজের দখল সাম্রাজ্য

বরিশালে গণপূর্তের জমি দখল করে একের পর এক টাকা বানানোর অসম সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন চরবাড়িয়া ইউপি চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মাহাতাব হোসেন সুরুজ। আর ওই সাম্রাজ্যের বাজার মূল্য ১০০ কোটি টাকা ছাড়াবে বলে গণপূর্ত বিভাগ সূত্র জানিয়েছে। দীর্ঘদিন দখল সন্ত্রাসে মেতে থাকা সুরুজের দুর্নীতির সংবাদ ইতোমধ্যে স্থানীয় ও জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হলে টনক নড়ে কর্তৃপক্ষের। যার ধারাবাহিকতায় খুব শীঘ্রই অবৈধ সাম্রাজ্য গুড়িয়ে দেয়া হবে বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে। আর এমনটা হলে পতনের অপেক্ষায় রয়েছে সুরুজের দখল সাম্রাজ্য।

এদিকে স্থানীয় সূত্র জানায়, গতকাল চেয়ারম্যান সুরুজ নিজেই তার লোকজন নিয়ে অবৈধ স্থাপনাগুলো ভেঙে দিয়েছেন। স্থানীয়দের দাবী, চেয়ারম্যান সুরুজ ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকা’র চেষ্টা করছেন। যাতে কেঁচো খুড়তে গিয়ে সাপ না বের হয়। কেননা সরকারিভাবেই তার দখলে থাকা সম্পত্তি উদ্ধার হবে বলে শুনেছেন তারা। 

সূত্রে জানা যায়, বরিশাল সদর উপজেলার তালতলী বাজার এলাকায় গণপূর্ত বিভাগের ৯ একর ১৪ শতাংশ জমি নামে-বেনামে দখল করে রেখেছেন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মাহাতাব হোসেন সুরুজ। এ জমির বাজারমূল্য ১০০ কোটি টাকার বেশি বলে গণপূর্ত বিভাগ সূত্রে জানা গেছে। কয়েক বছর ধরে ধাপে ধাপে এ জমি দখলে নেন সুরুজ। দখল করার বিষয়টি চেয়ারম্যান সুরুজ অস্বীকার করলেও গণপূর্ত বিভাগ দখলদারদের যে তালিকা জেলা প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করেছে, সেখানে সুরুজ এবং তাঁর ভাইসহ আওয়ামী লীগের অন্তত ১৫ নেতার নাম রয়েছে, যদিও তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই ভাড়াটিয়া।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে গণপূর্ত বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের জমিতে বালু ভরাট করে গরুর হাট ও অস্থায়ী বাজার বসানো, তিনটি পুকুর দখল করে মাছ চাষ, অস্থায়ী দুই শতাধিক দোকান তুলে ব্যবসা পরিচালনার সব কিছুই নির্বাহী প্রকৌশলী জানতেন। স্থায়ী স্থাপনা ও মাছ বাজার করার সময়ও নির্বাহী প্রকৌশলীকে অবহিত করা হয়েছিল; কিন্তু তিনি নীরব ছিলেন। পরে জানতে পেরেছি তাঁকে ম্যানেজ করেই সব কিছু হচ্ছে। এ কর্মকর্তা বলেন, তালতলী বাজার এলাকায় বর্তমানে প্রতি শতাংশ জমি ১১-১২ লাখ টাকায় বেচাকেনা হয়। সেই হিসাবে গণপূর্তের বেদখল হয়ে যাওয়া জমির দাম ১০০ কোটি টাকার বেশি। অবশ্য বরিশাল গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী দখল হয়ে যাওয়া জমির সীমানা নির্ধারণে গণপূর্ত বিভাগ সরেজমিনে লোক পাঠিয়েছিল বলে জানিয়েছেন। কিন্তু স্থানীয় লোকজন বাধা দেওয়ায় তা হয়নি। এখন জেলা প্রশাসন ও মন্ত্রণালয়ের সহায়তা না পেলে ওই সম্পত্তি দখলমুক্ত করা সম্ভব নয়। তবে জেলা প্রশাসন সূত্র বলছে গণপূর্ত বিভাগের পক্ষ থেকে এরকম কোনো চিঠি দেওয়া হয়নি। 

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সদর উপজেলার চরবাড়িয়া মৌজার ৪১ নম্বর জেএলের ৩ নম্বর খতিয়ানের (দাগ নম্বর ১৭৭, ১৭৮, ১৮১, ২৪৪, ২৪৫ ও ২৪৬) গণপূর্ত বিভাগের ৯ একর ১৫ শতাংশ জমিই বেদখল হয়ে গেছে। আগের জরিপে গণপূর্ত বিভাগের নামে পুরো জমিটিই রেকর্ড হয়েছিল। কিন্তু নতুন জরিপে এক একর ১ শতাংশ জমি বেহাত হয়ে গেছে।

জানা গেছে, গণপূর্তের এ ৯ একর ১৫ শতাংশ জমিই নামে-বেনামে চরবাড়িয়া ইউপি চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা মাহাতাব হোসেন সুরুজের দখলে রয়েছে। এর মধ্যে পাঁচ একরই সরাসরি তাঁর দখলে আছে। সেখানে তিনি মাছ বাজার, মার্কেট ও বালুর খলা করে ভাড়া দিয়েছেন এবং নিজেও ব্যবসা করছেন। বাজার লাগোয়া তিন একর জমির ওপর বিশাল একটি পুকুর ছিল, যার দুই একরই ভরাট করে ফেলা হয়েছে। ভরাট করা জমির চারপাশে ৩০০-এর বেশি দোকান রয়েছে। এগুলোও ইউপি চেয়ারম্যান সুরুজ, তাঁর স্বজন ও অনুসারীদের দখলে। এরপর তালতলী ওভারব্রিজের নিচের পুরনো রাস্তার দুই পাশে দুই একর জমির ওপর শতাধিক দোকান তোলা হয়েছে। ওই সব দোকানের পেছনে অন্তত ১০টি বালুর খলা রয়েছে, যার সবই ভাড়া দেওয়া। চেয়ারম্যানের ভাই ৭ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি গোলাম কবিরের দখলে রয়েছে প্রায় দুই একর জমি। যেখানে তিনি দোকান তৈরি করে ভাড়া দিয়েছেন এবং তিনটি বালুর খলা করে নিজে একটি চালাচ্ছেন ও অন্য দুটি ভাড়া দিয়েছেন। এ ছাড়া গণপূর্তের তিনটি পুকুরের আড়াই একর সম্পত্তি ৫ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য ফিরোজ গাজীর দখলে। যদিও তাঁর দাবি, এগুলো তিনি ইজারা নিয়েছেন।

সূত্রে আরো জানা গেছে, বছরখানেক আগে বাজার সংলগ্ন (তালতলী সেতুর পাশে) গণপূর্ত বিভাগের এক একর জমি ভরাট করেন সুরুজ। এরপর স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের (এলজিইডি) কাছ থেকে সাড়ে আট লাখ টাকা বরাদ্দ এনে সেখানে একটি মাছ বাজার বানানোর কাজ শুরু করেন। এ নিয়ে একটি স্থানীয় দৈনিকে সংবাদও ছাপা হয়। এরপর কাজ বন্ধ রাখা হয় ছয় মাস। কিন্তু পরে দুই বিভাগকেই ম্যানেজ করে দুই মাস আগে কাজটি শেষ করা হয়। বাজারের প্রায় ৫০টি দোকান থেকে তিনি ভাড়া তোলেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তালতলী বাজারের একাধিক ব্যবসায়ী বলেন, সব জমিই তাঁদের (চেয়ারম্যান ও তাঁর স্বজন) দখলে। গণপূর্ত বিভাগ ভাড়াটিয়াদেরও দখলদার হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। এ কারণে তাদের তালিকায় দখলদারের সংখ্যা ৫২। ব্যবসায়ীরা জানান, গণপূর্ত বিভাগ সরেজমিনে এলে ভাড়াটিয়াদের দখলদার হিসেবে দেখানো হয়। চেয়ারম্যানের কাছ থেকেই গণপূর্ত বিভাগ তালিকা নেয়। 

অনুসন্ধানে জানা যায়, চরবাড়িয়া ইউনিয়নের মোঃ আজিজ হাওলাদারের ছেলে মাহাতাব হোসেন সুরুজ’র দখলে শতাধিক দোকানপাট, গণপূর্ত বিভাগের ৪টি পুকুর, তিনটি বালুর ঘাট, একটি মাছ ক্রয়/বিক্রয়ের শেড নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি। এছাড়া সরকারি জমিতে চেয়ারম্যান সুরুজের আত্মীয় স্বজনের নামে ১৫/২০টি দোকানঘর রয়েছে বলে জানা যায়।

অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, মাছের বাজার থেকে দৈনিক ২৪ হাজার টাকা, তিনটি বালির খলা থেকে মাসিক ২৪ হাজার টাকা, রাস্তার দুপাশে থাকা দেড়শ দোকান থেকে প্রতিমাসে দেড় লাখ টাকা, শায়েস্তাবাদ যাওয়ার পথে রাস্তার দুইপাশে ৪টি পুকুর নিজে দখলে নিয়ে মাছ চাষ করে লাখ লাখ টাকা উপার্জন করতেন চেয়ারম্যান সুরুজ। যাতে অবৈধভাবে বছরে কোটি কোটি টাকা আয় করতেন তিনি। এছাড়া প্রতি বছর ইলিশ নিষেধাজ্ঞা মৌসুমে প্রতি জেলেকে ৩০ কেজি চাল দেয়ার কথা থাকলেও তিনি বালতি দিয়ে ১৫/১৬ কেজি চাল দিয়ে থাকেন। অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, সরকারি জমিতে ১০টি স্টল নির্মাণ করে প্রায় আড়াই লাখ টাকা অগ্রীম নিয়েছেন চেয়ারম্যান সুরুজ। এভাবেই তিনি কোটিপতি বনে গেছেন।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গতকাল শনিবার চেয়ারম্যান সুরুজ সরকারিভাবে উচ্ছেদ অভিযান ঠেকাতে কৌশলে নিজেই কিছু স্থাপনা উচ্ছেদ করেছেন। যা অনেকটা ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকা’র মতো। তবে সরকারিভাবে উচ্ছেদ অভিযান চলবে বলে জানিয়েছেন বরিশাল জেলা প্রশাসক এস.এম অজিয়র রহমান। তিনি বলেন, উচ্ছেদ অভিযান একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, যা অব্যাহত থাকবে।

অভিযুক্ত জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ইউপি চেয়ারম্যান মাহাতাব হোসেন সুরুজ‘র মুঠোফোনে (নম্বর ০১৭১২ .... ২৯) একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি তা রিসিভ না করায় বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।

ইনিউজ ৭১/টি.টি. রাকিব