বিসিবির সৌজন্য টিকিটে খেলা দেখেছেন তারেক

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: শনিবার ২৮শে সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১১:২৭ পূর্বাহ্ন
বিসিবির সৌজন্য টিকিটে খেলা দেখেছেন তারেক

বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক ও ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সদস্যসচিব লোকমান হোসেন ভূঁইয়া ক্যাসিনো কেলেঙ্কারিতে গ্রেফতার হওয়ার পর থেকেই একের পর চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসছে। চলতি বছর ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ক্রিকেট বিশ্বকাপের খেলা দেখার জন্য জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও তার পরিবারকে অন্তত পাঁচটি ম্যাচের টিকিট দিয়েছেন লোকমান। যুক্তরাজ্যে বসবাসরত ছাত্রদলের সাবেক এক নেতা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে। লোকমান হোসেন ভূঁইয়া বাংলাদেশ-দক্ষিণ আফ্রিকার খেলার আগেই তারেক রহমানের বাসায় গিয়ে নিজ হাতে পাঁচটি টিকিট হস্তান্তর করেন।

এগুলো আইসিসি থেকে পাওয়া বিসিবির সৌজন্য টিকিট ছিল বলেও সূত্রটি জানায়। ক্রিকেট বোর্ডের মিডিয়া কমিটির চেয়ারম্যান জালাল ইউনুস বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘লোকমান সাহেব ইংল্যান্ডে গিয়ে খেলা দেখেছেন। শুধু তিনি নন, বিসিবির প্রায় অধিকাংশ পরিচালকই খেলা দেখেছেন। তবে তিনি কাকে টিকিট দিয়েছেন বা কাকে দেননি সে বিষয়ে আমি জানি না। এটা তো জানার কথাও নয়।’ তারেক রহমান ও তার পরিবার এই টিকিট ব্যবহার করে বাংলাদেশের বেশ কিছু খেলা সরাসরি মাঠে গিয়ে উপভোগ করেন।

লোকমান হোসেন ভূঁইয়া বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের ঘনিষ্ঠ। এ কথা পাপন স্বীকারও করেছেন। তবে লোকমানের অন্ধকার জগৎ সম্পর্কে তার কোনো ধারণা ছিল না। পাপন বলেছেন, ‘আমি যে লোকমানকে চিনি সে জীবনেও মদ খায়নি। সে জীবনে কোনো দিন জুয়া খেলেনি। এটা যেমন সত্যি আবার এও সত্যি যে সে ক্যাসিনো ভাড়া দিয়েছে। এখানে অস্বীকার করার তো কোনো পথ নেই। সে যদি করে থাকে তাহলে তার বিচার হবে। আমরা তাকে যেভাবে চিনি এবং জানি সেটাই বললাম। এখন প্রমাণিত হওয়ার আগে তো আমরা কিছু বলতে পারছি না যে আসলে ঘটনাটি কী। এখন তো অনেক কথা শোনা যাচ্ছে।’

শক্তিশালী বলয়: মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁইয়া ক্রীড়াঙ্গনে শক্তিশালী বলয় গড়ে তোলেন। আর যাদের নিয়ে এই বলয়, এরা প্রত্যেকেই রাজনৈতিকভাবে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জড়িত। একজন রয়েছেন বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ফাঁসির দ প্রাপ্ত আসামি বজলুল হুদার শ্যালক। গোয়েন্দা সূত্রগুলো জানিয়েছে, জেরার মুখে লোকমান তার ঘনিষ্ঠজনদের যে নামের তালিকা প্রকাশ করেছেন, তার মধ্যে এদের নামও রয়েছে।

সূত্র জানায়, ১৯৯৬ সালে খালেদা জিয়া যখন বিরোধীদলীয় নেতা, তখন তাঁর নিরাপত্তা কর্মকর্তা ছিলেন এই লোকমান। এখন তিনি বিসিবির সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের ঘনিষ্ঠ। বিসিবির ফ্যাসিলিটিজ বিভাগেরও প্রধান লোকমান। বিসিবির পরিকল্পনাধীন শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামের প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির পাঁচ সদস্যের একজন তিনি। পূর্বাচলে প্রায় ৩৭.৪৭ একর জায়গা নিয়ে নির্মাণ হবে ৫০-৬০ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতার এই স্টেডিয়াম। এর সম্ভাব্য বাজেট ১০০ কোটি টাকা।

সূত্র জানায়, ১৯৯৩ সালে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য হন লোকমান। লোকমান ১৯৯৩-৯৪ সালের দিকে মোহামেডান ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত হন বিএনপি নেতা মোসাদ্দেক আলী ফালুর হাত ধরে। মোহামেডান ক্লাব নিয়েই ফালুর সঙ্গে তার দূরত্ব তৈরি হয়। দ্রুতই ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক হয়ে যান লোকমান। মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব ২০১১ সালে লিমিটেড কোম্পানি হলে তিনি তার ভারপ্রাপ্ত পরিচালক হন। ২০১৩ সালেও তিনি একই পদে নির্বাচিত হন। এরপর আর নির্বাচন হয়নি। বার্ষিক সাধারণ সভাও হয়নি। অলিখিতভাবে তিনিই ক্লাব চালাচ্ছিলেন। স্পন্সর আনা, দল গঠনসহ সব সিদ্ধান্ত তিনিই নিতেন। ক্লাবে একটা পরিচালনা পর্ষদ থাকলেও তা নিষ্ক্রিয়।

বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের কয়েকজন পরিচালকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, লোকমান প্রথম ক্রিকেট বোর্ডে আসেন ২০১২ সালের অক্টোবরে। আগের কমিটির চার বছরের মেয়াদ শেষ হলে সে সময় বিসিবির একটি অন্তর্বর্তীকালীন কমিটি গঠন করে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। ১৩ সদস্যের এই কমিটির সভাপতি হন বিসিবির বর্তমান সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন। তিনি তার আগেই সরকার কর্তৃক মনোনীত হয়ে সভাপতির চেয়ারে বসে ছিলেন। এই কমিটির একজন সদস্য হিসেবে যুক্ত হন লোকমান। পরে ২০১৩ সালের অক্টোবরে যে ১৯ পরিচালক বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন তার মধ্যে তিনিও ছিলেন। লোকমান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বোর্ড পরিচালক হন ২০১৭ সালের অক্টোবরে বিসিবির সবশেষ নির্বাচনেও। অথচ লোকমান যখন ক্রিকেট বোর্ডে পরিচালক হয়ে আসেন, তখন ক্রিকেটের সঙ্গে তার কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না।

সম্পদ গড়েছেন গত দুই বছরে : নাম প্রকাশ না করার শর্তে র‌্যাবের একজন কর্মকর্তা বলেন, তেজগাঁওয়ে একটি সাত তলা ভবন, উত্তরা ৭ নম্বর সেক্টরের ৮ নম্বর সড়কে একটি বাড়ি, পূর্বাচলে সাত কাঠা ও বেড়িবাঁধে প্রায় দুই বিঘা জমি আছে লোকমানের। অস্ট্রেলিয়ার ব্যাংক ছাড়াও দেশে কয়েকটি ব্যাংকে টাকা রেখেছেন তিনি। ১ কোটি টাকার স্থায়ী আমানত আছে দেশের একটি ব্যাংকে। ট্রাভেল এজেন্সি, কমিউনিকেশন ফার্ম এবং মোবাইল ফোন টাওয়ার ও নির্মাণ খাতের ব্যবসা আছে তার। তবে তিনি মূলত সম্পদ গড়েছেন গত দুই বছরে।

ক্লাবের একটি সূত্র বলছে, দিন দিন জৌলুস বাড়লেও ফুটবলে ক্লাবটি পিছিয়ে পড়ছিল। ২০০২ সালের পর থেকে ১৭ বছরে ফুটবল লিগে মোহামেডান আর চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি। দুই মাস আগে যে ফুটবল লিগ শেষ হলো, তাতে দলটি অষ্টম হয়। টাকার অভাবে ভালো দল গঠন করা যায়নি বলেও অভিযোগ ওঠে। শেষ পর্যন্ত ৫৪ তলা একটি ভবন তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছিল মোহামেডান ক্লাব কর্তৃপক্ষ। সেটি ভাড়া দিয়ে ক্লাবের ব্যয় নির্বাহ করার কথা চলছিল। উল্লেখ্য, লোকমান হোসেন ভূঁইয়াকে মাদক মামলায় দুই দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিয়েছে আদালত। পুলিশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত এ আদেশ দেয়।

ইনিউজ ৭১/এম.আর