ক্যাসিনো কেলেঙ্কারিতে মাহবুবকে দুদকে তলব, লোকমান আটক; বিব্রত বিসিবি

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: বৃহঃস্পতিবার ২৬শে সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০৭:৩৬ অপরাহ্ন
ক্যাসিনো কেলেঙ্কারিতে মাহবুবকে দুদকে তলব, লোকমান আটক; বিব্রত বিসিবি

মিরপুর শের-ই-বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামের গেট দিয়ে ঢুকতেই বিসিবির পরিচিতজনদের উৎসুক দৃষ্টি। ম্যাচের একাদশে কারা থাকছেন সেই খোঁজে সাধারণত সাংবাদিক হিসেবে যাদের কাছে ছুটতাম, তেমনই একজন এদিন এগিয়ে এসে ফিসফিস করে খোঁজ নিলেন-‘লোকমান ভাই তো আটক, তালিকায় আর কে কে আছে?’

বিসিবি’র এপ্রান্ত থেকে ও’প্রান্ত, একাডেমিতে অনুশীলনে চেনা-পরিচিত ক্রিকেটারদের কেউ শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর ক্রিকেট নিয়ে কিছু জানতে চাইলেন না; সবার একটাই খোঁজ-‘ক্যাসিনো কেলেঙ্কারির জালে, এরপর কে?’ বৃহস্পতিবার সকাল থেকে হঠাৎ করেই ক্রিকেট বোর্ডের সবকিছুতেই এমন ‘অক্রিকেটীয়’ আলোচনা। তবে সেই আলোচনা বোর্ডের কোথাও গলা চড়িয়ে হচ্ছে না। নিচু গলায়, পাশের জন ছাড়া আর কেউ যেন শুনতে না পায়-এমন স্বর এবং রাখঢাক নিয়েই চলছে-‘ক্যাসিনো কেলেঙ্কারির পরের রেশ!’ যে কেলেঙ্কারির জালে এখন মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের ডাইরেক্টর ইনচার্জ লোকমান হোসেন ভূঁইয়া আটক। লোকমান ভূঁইয়ার আরেকটি বড় পরিচয় হলো তিনি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) পরিচালক। তিনি আবার বিসিবির ফ্যাসিলিটিস ম্যানেজমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যানও। পূর্বাচলে শত কোটি টাকা বাজেটের যে এক্সক্লুসিভ শেখ হাসিনা আর্ন্তজাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম নির্মাণের পরিকল্পনা করছে বিসিবি, সেই স্টেডিয়াম নির্মাণ কমিটির অন্যতম সদস্য তিনি।

বিসিবির এত গুরুত্বপূর্ণ একজন পরিচালক এখন অসহায় ভঙ্গিতে স্বীকার করছেন-মতিঝিল ক্যাসিনো কেলেঙ্কারিতে তিনিও জড়িত। র‌্যাব জানিয়েছে, তাদের কাছে জিজ্ঞাসাবাদে লোকমান হোসেন স্বীকার করেছেন-ক্লাবের আঙিনায় ক্যাসিনো বসানোর ভাড়া হিসেবে তিনি মাসে ২১ লাখ টাকা পেতেন। এই অর্থের সিংহভাগই লোকমান তার নিজের বিদেশি ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে পাচার করেছেন। সেই সূত্রেই অস্ট্রেলিয়ার দুই ব্যাংকে তার জমা আছে প্রায় ৪১ কোটি টাকা! লোকমান ক্লাবকে ব্যবহার করে কোটি কোটি টাকায় ভাসছেন, আর সেই মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব টাকার অভাবে ভালো দলই গড়তে পারছে না। খেলোয়াড়দের বেতনাদি দিতে পারছে না! লোকমানের বাসায় বুধবার রাতে র‌্যাব তল্লাশি চালিয়ে তাকে আটক করে। র‌্যাব জানায়, তার বাসায় বেশ কয়েক বোতল বিদেশি মদ পাওয়া গেছে। পরদিন সকালে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। ক্যাসিনো কেলেঙ্কারি থেকে বিদেশে অর্থ পাচার-নিজের সব কৃতকর্ম স্বীকার করেন লোকমান।

র‌্যাব সদরদপ্তরের উঠানে দুপাশে অস্ত্রধারী তাকে ঘিরে রেখেছে। লোকমান হোসেনের এমন ছবি, ক্যাসিনো কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকা, বিদেশে টাকা পাচারের স্বীকারোক্তি-এমনসব ঘটনা ও পরিস্থিতি বিসিবি’র জন্য চরম অস্বস্তিকর। মাত্র ক’দিন আগেও যাকে দেখা গেছে আর্ন্তজাতিক ম্যাচের পুরস্কার বিতরণের মঞ্চে; সেই তিনি আজ আইনের চোখে আসামী! লোকমানের এভাবে আটক হওয়া এবং ক্যাসিনো কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার স্বীকারোক্তির এই ঘটনায় বিসিবি ভীষণ বিব্রত। তবে বিসিবির কোনো পরিচালক এব্যাপারে কথা বলতে না কোনো মন্তব্য করতে রাজি হলেন! তবে প্রায় সবাই এমন কেলেঙ্কারির জেরে ভীষণ বিব্রত।

বিসিবির প্রধান নির্বাহী নিজামুদ্দিন চৌধুরী সুজন জানান,‘আমরা তো আগে কখনো এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হইনি। তাই ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না, এমন পরিস্থিতিতে এখন কি বলা উচিত!’ তিনি আরো জানান-‘বিসিবির শীর্ষ পর্যায়ের সঙ্গে কথাবার্তা বলে এই প্রসঙ্গে বিসিবির যদি কিছু বলার বা বক্তব্য দেয়ার থাকে, তবে সেটা জানানো হবে।’ আইন ভাঙ্গার অপরাধে বা কোনোধরনের কেলেঙ্কারিতে এর আগে কোনো ক্রিকেটার জড়িয়ে পড়লে বিসিবির ভাষ্য ছিলো-আইনের শাসন সবাইকে মানতে হবে। কেউ এমন জটিলতায় পড়লে তাকে দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ীই সেই বিষয়ের সমাধান করে আসতে হবে। লোকমান হোসেন ভূঁইয়াকেও এখন সেই ‘কঠিন ইনিংস’ খেলে আসতে হবে!

বিসিবির আরেক পরিচালক মাহবুব আনামও এখন ক্রিকেট ছেড়ে অন্য চিন্তায় মগ্ন। তার সম্পদের হিসেবে গরমিল পাওয়ায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তাকে তলব করেছে। দুদুক জানিয়েছে-তাদের প্রাথমিক অনুসন্ধানে মাহবুবুল আনামের নামে ৪ কোটি ৭৭ লাখ ৯৮ হাজার টাকার স্থাবর এবং ৫৬ কোটি ৭৬ লাখ ৮৪ হাজার ৯৪৪ টাকার অস্থাবর সম্পদ সব মোট ৬২ কোটি ৫৪ লাখ ৮২ হাজার টাকার সম্পদের তথ্য মিলেছে। এই সম্পদ অর্জনের যথাযথ ও গ্রহনযোগ্য উৎস কি সেটা জানতে চেয়ে দুদক তাকে নোটিশ দিয়েছে। গত বুধবারের ঐ নোটিশে বলা হয়েছে আগামী ২১ কার্যদিবসের মধ্যে মাহবুব আনামকে স্বীয়, নির্ভরশীল ব্যক্তিবর্গের যাবতীয় স্থাবর/অস্থাবর সম্পত্তি, দায়- দেনা, আয়ের উৎস ও তা অর্জনের বিস্তারিত জানাতে হবে। লোকমান হোসেনকে র‌্যাব আটক করেছে। মাহবুব আনামকে তলব করেছে দুদক। দুজনের অন্য পরিচয় আছে। তবে তারা বিসিবির পরিচালক-এই পরিচয়টাই বেশি স্বীকৃত। তাই বিসিবি বিব্রত!