মশা মারার টাকায় মশক নিবারণ দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (উপসচিব) নিজেই বিদেশ সফরে আছেন বলে অভিযোগ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। শুধু তিনিই নন, মশা মারার টাকায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রায় ১২ জন কর্মকর্তা গত চার বছরে বিদেশ সফর করেছেন বলে অভিযোগ এসেছে কমিশনের কাছে। এসব অভিযোগ পেয়ে অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক। তারা চার বছরে দুই সিটি করপোরেশনের মশা মারার ব্যয়ের নথি সংগ্রহ করেছে। এতে দেখা যায়, দুই সিটিতেই মশার ওষুধ সরবরাহ করেছে ‘দি লিমিট এগ্রো প্রোডাক্ট লিমিটেড’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান, যাদের ওষুধ এক বছর আগেই অকার্যকর ঘোষণা করেছিল আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি)।
দুদক সূত্রে জানা যায়, মশার ওষুধ কেনায় শক্তিশালী সিন্ডিকেট ও বড় ধরনের দুর্নীতির তথ্য পেয়েছে কমিশন। তারা জানতে পেরেছে, মশা মারার টাকায় উচ্চতর প্রশিক্ষণের নামে বিদেশ সফরও করেছেন দুই সিটির বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা। এর পরিপ্রেক্ষিতে দুদক দুই সিটির কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরের নথিপত্র সরবরাহ করতে বলেছে। একই সঙ্গে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকেও জানতে চাওয়া হবে সিটি করপোরেশনের কতজন কর্মকর্তা কোন খাতের টাকায় কী কারণে বিদেশ সফর করেছেন।এ বিষয়ে ডিএসসিসিতে অভিযান পরিচালনাকারী কর্মকর্তা ও দুদকের সহকারী পরিচালক মামুনুর রশীদ চৌধুরী গতকাল বুধবার দেশ
রূপান্তরকে বলেন, ‘মশা মারার টাকায় সিটি করপোরেশন কর্মকর্তারা বিদেশ সফর করছেন এ রকম একটি অভিযোগ আমরা পেয়েছি। অভিযোগ পাওয়ার পর কমিশন সেটি আমলে নিয়েছে। তদন্তের প্রাথমিক পর্যায়ে আমরা ডিএসসিসি ও ডিএনসিসির কাছে নথিপত্র চেয়েছি। তারা এখনো আমাদের কাছে কোনো নথি সরবরাহ করেনি। এছাড়া স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কাছে করপোরেশনের কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরের নথিপত্র চাওয়া হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ডিএসসিসির মশক নিবারণ দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিজেই বিদেশ সফরে আছেন। ওই দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা একজন উপসচিব।’
অভিযোগের বিষয়ে মামুনুর রশীদ বলেন, ‘অভিযোগ রয়েছে ডিএসসিসির বিভিন্ন ওয়ার্ডে ডেঙ্গুবাহী এডিস ও কিউলেক্স মশা মারার ওষুধের জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে প্রতি বছর প্রায় শতকোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। ওষুধের বাজেটের এ টাকায় ডিএসসিসির বেশকিছু কর্মকর্তা বিদেশে গিয়েছেন। তারা কেন বিদেশে গিয়েছেন, কত টাকা খরচ হয়েছে, সেই দেশে গিয়ে মশক নিধনের কী উপকার হয়েছে, এসব প্রশ্নের জবাব খুঁজবে দুদক।’ দুদকের উপপরিচালক প্রণব কুমার ভট্টাচার্য জানান, দুই সিটি করপোরেশনে মশা মারতে চার বছরে কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়েছে, দুদকের পৃথক দুটি দল তার নথিপত্র সংগ্রহ করেছে। সেগুলো পর্যালোচনা চলছে। এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে বিস্তারিত জানানো হবে।
মশার ওষুধের টাকায় কর্মকর্তাদের বিদেশ যাওয়ার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় ডিএসসিসির ভান্ডার ও ক্রয় কর্মকর্তা (পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ) লিয়াকত হোসেনের কাছে। তিনি বলেন, ‘বিদেশে প্রশিক্ষণে যাদের পাঠানো হয়েছে, তারা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে দেশের বাইরে গেছেন। কোন খাতের টাকা ব্যয় হয়েছে বিষয়টি আমার জানা নেই। মশা মারার ওষুধ সঠিকভাবে কেনা হয়েছে এবং প্রয়োগ করা হয়েছে।’
এদিকে গত মঙ্গলবার মশক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করার অভিযোগে ডিএসসিসিতে এবং মশক নিবারণ দপ্তরে (লালবাগ, ঢাকেশ্বরী মন্দির এলাকায়) দুটি অভিযান চালিয়েছে দুদক। অভিযান চলাকালে মশক নিবারণ দপ্তরের প্রধান কর্মকর্তাকে তার দপ্তরে উপস্থিত পাওয়া যায়নি। দপ্তরে মজুদ মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত ওষুধের ড্রাম খালি অবস্থায় পাওয়া যায়, যার মধ্যেই মশা জন্ম নিচ্ছে। অভিযানে দুদক কর্মকর্তারা জানতে পারেন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কাছ থেকে মশার ওষুধ ধার নিয়ে ব্যবহার করছে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন।
দুদক ডিএনসিসি থেকে মশার ওষুধ ক্রয়ের জন্য ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে যতগুলো টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছিল তার সব তথ্য সংগ্রহ করেছে। গত মঙ্গলবারের অভিযানের পর দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রণব কুমার ভট্টাচার্য জানান, এডিস মশার ওপর কার্যকারিতা পরীক্ষা না করেই এর আগে ওষুধ আমদানি করেছে ডিএনসিসি। দেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের জন্য এই বিষয়টিকেও দায়ী হিসেবে দেখছে দুদক। একই সঙ্গে অকার্যকর ওষুধ সংগ্রহের বিষয়ে অনুসন্ধান করছে কমিশন। অকার্যকর ওষুধ ক্রয় ও প্রয়োগের বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের জিজ্ঞাসাবাদ করবে দুদক।
দুদকে দেওয়া নথি অনুযায়ী, গত অর্থবছরে দুই সিটি করপোরেশনে মশা মারার ওষুধ সরবরাহ করেছে লিমিট এগ্রো লিমিটেড এবং ‘নোকন লিমিটেড’। লিমিট এগ্রো প্রোডাক্ট ১৮ বছর ধরে ঢাকা সিটি করপোরেশনে গড়ে প্রতি বছর ৪০ কোটি টাকার মশার ওষুধ সরবরাহ করে। আর নোকন লিমিটেড ঢাকা উত্তর সিটিতে গত অর্থবছরে সরবরাহ করে ১১ কোটি টাকার ওষুধ। চলতি বছরও তারাই কার্যাদেশ পেয়েছে। ভেজাল ওষুধ সরবরাহের অভিযোগে লিমিট এগ্রোকে কালো তালিকাভুক্ত করে ডিএনসিসি। এছাড়া ওষুধ সংগ্রহের জন্য উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বানের নিয়ম থাকলেও ডিএসসিসি সেটা অনুসরণ করেনি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, মশার ওষুধ ক্রয়ের ক্ষেত্রে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের নিয়মনীতিও অনুসরণ করেছে ডিএসসিসি। ১৯৯০-৯৫ সালে অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনে মশার ওষুধ সরবরাহ করত এসিআই ফার্মাসিউটিক্যালস নামে একটি প্রতিষ্ঠান। পরে তাদের বাদ দেওয়া হয়। ২০০০ সালের পর ওষুধ সরবরাহকারী হিসেবে দরপত্র জমা দেয় লিমিট এগ্রো প্রোডাক্ট। এসিআইয়ের সরবরাহ করা ওষুধের দামের অর্ধেক মূল্যে দরপত্র জমা দিয়ে কাজ পায় প্রতিষ্ঠানটি। এরপর টানা ১৮ বছর মশার ওষুধ সরবরাহ করে এই প্রতিষ্ঠান। ২০১৮ সালে লিমিট এগ্রোর ওষুধের মান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হওয়ায় কালো তালিকাভুক্ত করে ডিএনসিসি। এরপর ওষুধ সরবরাহের কাজ পায় পাকিস্তানভিত্তিক কোম্পানি নোকন লিমিটেড।
ইনিউজ ৭১/টি.টি. রাকিব
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।