নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যা সেই অধ্যক্ষের মুক্তি চেয়ে,মিছিলের নেপথ্যে ছিল কারা!

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: বৃহঃস্পতিবার ১১ই এপ্রিল ২০১৯ ১১:২৪ পূর্বাহ্ন
নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যা সেই অধ্যক্ষের মুক্তি চেয়ে,মিছিলের নেপথ্যে ছিল কারা!

ফেনীর সোনাগাজী ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা সিরাজউদদৌলা যৌন হয়রানির অভিযোগে ২৭ মার্চ গ্রেফতার হন। গ্রেফতার হওয়ার পর তাকে রক্ষা করতে তার মুক্তির দাবিতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের ইন্ধনে গত ২৮ মার্চ এলাকায় মিছিল বের করা হয়েছিল। একই সময়ে গ্রেফতার অধ্যক্ষের বিচার চেয়ে অন্য বিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী মানববন্ধন করেছিল।এরই মধ্যে গত ৬ এপ্রিল ওই মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি (১৮)-কে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়। পাঁচদিন জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে বুধবার (১০ এপিল) রাত সাড়ে ৯টার দিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নুসরাত মারা যান। তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছিল। এদিকে, নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যাচেষ্টার ঘটনাটি নিয়ে দেশব্যাপী তোলপাড় শুরু হয়। এ অবস্থায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অধ্যক্ষের মুক্তি চেয়ে করা সেই মিছিলের ছবি ছড়িয়ে পড়লে বিষয়টি ফের সামনে আসে। প্রশ্ন ওঠেছে, অধ্যক্ষের পক্ষে এই মিছিলের আয়োজক ছিল কারা এবং মিছিলে অংশ নিয়েছিল কারা। অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে অধ্যক্ষের পক্ষে-বিপক্ষে এই কর্মসূচির নেপথ্যে ছিলেন বিভিন্ন সময়ে অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলাকে সহায়তাদানকারী দুই ওয়ার্ড কাউন্সিলর।

জানা গেছে, গত ২৭ মার্চ নুসরাত মাদ্রাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেন। এরপর তার মা মামলা দায়ের করলে ‍পুলিশ অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলাকে গ্রেফতার করে।  প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, ২৭ মার্চ  সিরাজউদ্দৌলা গ্রেফতার হওয়ার পরদিন ২৮ মার্চ তার মুক্তি চেয়ে মিছিল করেছিল মাদ্রাসার সুবিধাপ্রাপ্ত বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীরা। আর তাদেরকে উৎসাহিত করেছে পরিচালনা কমিটি ও কলেজের কিছু ‘শুভাকাঙ্ক্ষী’। এদের মধ্যে অন্যতম হলেন পৗর কাউন্সিলর মাকসুদুল আলম মাকসুদ, যিনি নুসরাত হত্যাচেষ্টা মামলায় বর্তমানে পলাতক।আর অধ্যক্ষের বিপক্ষে মানববন্ধনের আয়োজন করেছিলেন আরেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর শেখ মামুন, যিনি আগে অধ্যক্ষের কাছের লোক হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

২৭ মার্চ থেকে যা ঘটেছে গত ২৭ মার্চ মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাতকে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগ ওঠে  অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে। ওই দিনই মামলা হলে অধ্যক্ষ গ্রেফতার হন। গ্রেফতার হওয়ার পর তার পক্ষে-বিপক্ষে দু’টি গ্রুপ কর্মসূচি পালন করে। অধ্যক্ষকে বাঁচানোর জন্য পৗর কাউন্সিলর মাকসুদুল আলম  মাকসুদ নেপথ্যে কাজ করছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ২৮ মার্চের সেই মিছিলের নেতৃত্বে মোকসুদ ছিলেন কিনা প্রশ্নে মাদ্রাসার বর্তমান পরিচালনা কমিটির সহ-সভাপতি রুহুল আমিন সরাসরি স্বীকার না করলেও ওই সময় এই অভিযুক্ত ব্যক্তি সেখানে উপস্থিত ছিলেন একথা স্বীকার করেন।ঘটনার বিবরণীতে রুহুল আমিন বলেন, ‘২৭ মার্চ ভিকটিম ছাত্রীর (নুসরাত) সঙ্গে যা ঘটেছে, সেটা আমি রাস্তায় বসে শুনে মাদ্রাসায় যাই। আমি সেখানে উপস্থিত হয়ে পুলিশ ডেকে এনে অধ্যক্ষকে থানায় পাঠিয়ে দিই। অধ্যক্ষ প্রথমে থানায় যেতে রাজি হননি। পরে আমি তাকে বলি, আপনি যান আমিও আসছি। সে সময় ভিকটিমের পরিবারকেও পাঠাই এবং বলি, যা অভিযোগ সেটা থানায় গিয়ে জানাতে।’

অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলাউল্লেখ্য, গত ৬ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৯টার দিকে আলিম (এইচএসসি) পর্যায়ের আরবি প্রথমপত্র পরীক্ষা দিতে সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে যান নুসরাত। এরপর কৌশলে তাকে পাশের ভবনের ছাদে ডেকে নেওয়া হয়। সেখানে ৪/৫ জন বোরকা পরা ব্যক্তি তার শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। সেদিনই নুসরাতকে প্রথমে ফেনী সদর হাসপাতালে ও পরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এনে ভর্তি করানো হয়। মৃত্যুর আগে নুসরাত ঢামেকের বার্ন ইউনিটে লাইফ সাপোর্টে ছিলেন।

কারা করেছিল পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি মাদ্রাসার বর্তমান পরিচালনা কমিটির সহ-সভাপতি রুহুল আমিন বলেন, ‘২৮ মার্চ দুটি মিছিল হয়েছে, সেটি আমি ফেসবুকে দেখেছি। সেখানে অধ্যক্ষের পক্ষে ও বিপক্ষে দুজন কাউন্সিলর ছিল। তাদের মধ্যে একজন মাদ্রাসার আগের কমিটির সদস্য শেখ মামুন অন্য স্কুলের শিক্ষার্থীদের নিয়ে অধ্যক্ষের ফাঁসি চেয়ে জিরো পয়েন্টে মানববন্ধনের আয়োজন করেন। এর বিপরীতে অধ্যক্ষের পক্ষে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা ওই জিরো পয়েন্টেই মিছিল নিয়ে যায়। পরিস্থিতি দেখে আমি কাউন্সিলর মাকসুদকে ফোন দিই। সেও তখন জিরো পয়েন্টেই ছিল।’এরপর সবাই স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ব্যস্ত হয়ে যান উল্লেখ করে রুহুল আমিন বলেন, ‘পরে সেদিন (৬ এপ্রিল) পরীক্ষাচলাকালীন আগুনের ঘটনাটি ঘটলো।’ এই অধ্যক্ষ যে এত খারাপ, এ বিষয়টা আগে কেন ফুটে উঠলো না বলে বিস্ময় প্রকাশ করেন তিনি। রুহুল আমিনের বিরুদ্ধে অধ্যক্ষের পক্ষ নেওয়ার অভিযোগ আছে বলে জানানো হলে তিনি বলেন, ‘এসব যারা বলে তারা আমাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করতে পারে না কেন। আমি অধ্যক্ষকে পুলিশের কাছে তুলে দিলাম।’

২৮ মার্চ অধ্যক্ষের পক্ষের মিছিলের জন্য মাকসুদকে সরাসরি দায়ী করে ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শেখ মামুন  বলেন, ‘অধ্যক্ষের পক্ষে মাদ্রাসার ছাত্ররা মিছিল বের করলেও এর পেছনে ছিলেন বর্তমানে পলাতক মাকসুদুল আলম। পুরো কর্মসূচি আয়োজনে অধ্যক্ষের সাবেক ও বর্তমান ছাত্র এবং মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটি যুক্ত ছিল। আমরা অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে যখন মানববন্ধন করি, সেখানে মাকসুদ আমার ওপর চড়াও হয়েছিল। আমি কিছু বলিনি, সরে এসেছি।’ আপনার সময়েও অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠেছে বলে অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, এ তথ্য জানানো হলে শেখ মামুন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সে সময় অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অর্থলুণ্ঠনসহ নানা অভিযোগ উত্থাপনের চেষ্টা করেছি, প্রতিকার পাইনি।’

অধ্যক্ষকে রক্ষা করে আসছিল যারা অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে,অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলা সোনাগাজী উপজেলা জামায়াতের আমির ছিলেন। তার বিরুদ্ধে আগেও অনৈতিক কাজের অভিযোগ এবং একাধিক মামলা আছে। তিন বছর আগে তাকে জামায়াত থেকে বহিষ্কার করার পরেও তিনি এই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হিসেবে টিকে ছিলেন। স্থানীদের ভাষ্য— সেসময় জামায়াত থেকে বের হয়ে এই অধ্যক্ষ ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মামুনের সহায়তায় টিকে যান। যদিও কিছুদিনের মধ্যেই শেখ মামুনের সঙ্গে তার সখ্যতা কমতে থাকে। এসময় তিনি আরেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাকসুদুর রহমানের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। এই দুই ওয়ার্ড কাউন্সিলরই ২৮ মার্চ অধ্যক্ষের পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নেন।এতদিন অধ্যক্ষের বিষয়ে অভিযোগগুলো আমলে না নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে মাদ্রাসার বর্তমান সভাপতি ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব)পি কে এনামুল হক বলেন, ‘তার বিরুদ্ধে এখন বেশিরভাগ যে অভিযোগগুলো তোলা হচ্ছে, সেগুলো আপনারদের মতোই আমিও এখন শুনছি। তার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ ও যৌন হয়রানির অভিযোগ আগেও ছিল— সেটি তিনি জানেন কিনা প্রশ্নে এনামুল হক বলেন, ‘অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় অডিট কমিটি করা হয়। পরে অধ্যক্ষকে কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। সেটিতো নিষ্পত্তি হওয়া জিনিস। পেছনের অনেক বিষয় এখন উঠে আসছে। তবে যৌন হয়রানির অভিযোগে এ দফা মামলা এবং মামলার পরে যা যা এই অধ্যক্ষ ঘটিয়েছেন, তাতে আমি তাকে মানুষ মনে করি না, সে নরপশু।