বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ‘সেফ এক্সিট’ শব্দটি যতটা নতুন শোনায়, বাস্তবে এর প্রয়োগ ততটাই পুরনো। সাম্প্রতিক আলোচনায় এনসিপি নেতা নাহিদ ইসলামের মন্তব্যে এই শব্দটি আবারও ফিরে এসেছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। কিন্তু এর শিকড় ছড়িয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময় থেকে বর্তমান পর্যন্ত।
১৯৭৫: প্রথম সেফ এক্সিটের নজির
১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যার পর অভিযুক্ত সেনা সদস্যদের বিচারের আওতার বাইরে রাখতে ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ জারি করা হয়। তাদের মধ্যে অনেকে পরে কূটনৈতিক পদে বিদেশে নিয়োগ পান।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, “অপরাধ করেও দায়মুক্তি পাওয়ার ঘটনাই মূলত বাংলাদেশের প্রথম সেফ এক্সিট।”
২০০৭–২০০৮: এক–এগারোর সরকার ও সেফ এক্সিট চুক্তি
২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর দুর্নীতির অভিযোগে শতাধিক রাজনীতিবিদকে গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রশাসনিক সংকট দেখা দেয়। তখন সরকার ও সেনা কর্মকর্তারা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদের ভাষায়, “তারা শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার কাছে এক ধরনের ‘এক্সিট প্ল্যান’ চেয়েছিল। শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার সম্মতিতেই এক প্রকার সেফ এক্সিট হয়।”
২০০৮ সালের অক্টোবরে সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাদের বৈঠকে ওই এক্সিট পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়। নির্বাচনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দীন আহমদ ও সেনাপ্রধান মঈন উ আহমেদ দেশ ছাড়েন।
২০২৪: তৃতীয় সেফ এক্সিট—হাসিনার দেশত্যাগ
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মুখে দেশ ছাড়েন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ দেওয়ার অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও তাঁকে নিরাপদে দেশত্যাগে সহায়তা করা হয়।
বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, “তিনি তো প্রাণে বাঁচলেন, সেই অর্থে এটি নিঃসন্দেহে সেফ এক্সিট।” জানা গেছে, সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে সামরিক বিমানে করে তাঁকে ভারতে পৌঁছে দেওয়া হয়।
সেফ এক্সিট কেন ও কাদের জন্য?
বিশ্লেষকরা বলছেন, জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সংঘাত এড়াতে বা রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা রক্ষায় কখনো কখনো সেফ এক্সিটকে ‘মৌন সমঝোতা’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এতে অভিযুক্ত ব্যক্তি যেমন নিরাপদ থাকেন, তেমনি নতুন সরকারও অস্থিরতা এড়াতে পারে।
মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, “যারা এ সুযোগ দেন এবং যারা নেন—দু’পক্ষই একই গোয়ালের গরু।”
এখন উপদেষ্টাদের সেফ এক্সিট নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হলেও বিশ্লেষকদের মতে, ইতিহাস বারবার দেখিয়েছে—বাংলাদেশের রাজনীতি যতই পরিবর্তিত হোক, ক্ষমতার নিরাপদ প্রস্থান নিয়ে সমঝোতার ধারাটি এখনো অটুট।