গুলিস্তানে বিস্ফোরণ: বাঁচা-মরার সন্ধিক্ষণে দগ্ধরা, বাইরে বিমর্ষ স্বজনরা

নিজস্ব প্রতিবেদক
ইনিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত: বৃহঃস্পতিবার ৯ই মার্চ ২০২৩ ১১:৪০ পূর্বাহ্ন
গুলিস্তানে বিস্ফোরণ: বাঁচা-মরার সন্ধিক্ষণে দগ্ধরা, বাইরে বিমর্ষ স্বজনরা

দগ্ধ শরীরে কেউ পড়ে আছেন নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে, কেউ বা পুড়ে যাওয়া শরীরের জ্বালা-যন্ত্রণা নিয়ে কাতরাচ্ছেন পোস্ট-অপারেটিভ ওয়ার্ডে। বাইরে বিমর্ষ আপনজনরা সময় গুনছে, কখন শেষ হবে এই দুঃসহ অপেক্ষার পালা। 


গতকাল বুধবার এমন দৃশ্য দেখা যায় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে গিয়ে। গত মঙ্গলবার রাজধানীর সিদ্দিকবাজারে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় আহত ১০ জন এই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এ ছাড়া গতকাল বিকেল পর্যন্ত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন ২০ জন।


বার্ন ইনস্টিটিউটে পাশাপাশি পোস্ট-অপারেটিভ ১৮ ও ১৯ নম্বর  বেডে চিকিৎসাধীন দুই ভাই ওলিল শিকদার (৫০) ও জলিল শিকদার (৪৫)। রিকশাভ্যানচালক দুই ভাই সিদ্দিকবাজারের বিস্ফোরণের ঘটনায় দগ্ধ হয়ে এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। দুজনেরই শ্বাসনালি পুড়ে গেছে।


১৯৮৭ সালে শিশু দুই ভাই হাতে হাত ধরে মাদারীপুরের কুনিয়া থেকে রাজধানী ঢাকায় আসেন কাজের সন্ধানে। সেই থেকে একসঙ্গে করেছেন জীবিকার লড়াই। এখন একসঙ্গে দগ্ধ হয়ে করছেন বেঁচে থাকার লড়াই। 


ওয়ার্ডের বাইরে অপেক্ষমাণ স্বজনদের মধ্যে খলিল ও ওলিল শিকদারের ছোট ভাই দবির শিকদার (৩৫) বলেন, ‘আমার জন্মের আগে ওলিল ভাই আর খলিল ভাই ঢাকায় আসছে। এরপর আমাগো আরেক ভাই তবির শিকদারও এই শহরে আসে কাজের জন্য। ছোট থেকে এই পর্যন্ত ভাইয়েরাই দেখে রাখছে। এখন তাদের এমন অবস্থা মেনে নিতে পারছি না।’


তিনি বলেন, ‘মেজো ভাই (ওলিল) বাঁচার জন্য সবার কাছে দোয়া চাইছে। খলিল ভাই বলছে, ওই বিল্ডিংয়ের সামনে খাওয়াদাওয়া কইরা আইসা ভ্যানের ওপর বসছিল। হঠাৎ গরম হাওয়া দুইজনরে দুই দিকে উড়াইয়া নেয়।’


খলিল শিকদারের স্ত্রী কোহিনুর আক্তার বলেন, ‘সকালেও তার লগে কথা কইলাম, এহন কী হইল, বুঝলাম না। সকালে কইলো মা-বাবার মিলাদের লাইগা টাকা পাঠাইব। আসরের নামাজের পর হুনি এই ঘটনা!’


১০ মিনিটের ব্যবধানে সব শেষ : বার্ন ইনস্টিটিউটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) ১১ নম্বর বেডে চিকিৎসা নিচ্ছেন মো. হাসান (৩২)। তাঁর শ্যালক মো. জালাল উদ্দিন (২৮) রয়েছেন তাঁর শারীরিক অবস্থা জানার অপেক্ষায়। চিকিৎসক অবশ্য ভালো কোনো খবর দেননি।


জালাল জানান, দুর্ঘটনার ১০ মিনিট আগে গুলিস্তানের বিআরটিসি বাস কাউন্টারের পাশের লালমিয়া মসজিদে নামাজ আদায়ে যান তিনি। দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত একটি ভবনের সামনে ফুটপাতে দোকান চালাতেন তিনি এবং তাঁর দুলাভাই হাসান।


তিনি বলেন, ‘নামাজে যাওনের সময় দুলাভাইরে কইছিলাম দোকানটা দেইখা রাখতে। শেষ রাকাতের সময় আতকা (হঠাৎ) মসজিদ কাঁইপা ওঠে। তাড়াতাড়ি বাইর হইয়া দেখি আমার দোকান (পর্দার দোকান), দুলাভাইয়ের ব্যাগের দোকান কোনোটাই নাই। দুলাভাইও নাই। ১০ মিনিটের মইধ্যে সব পাল্টাইয়া গেছে!’


আইসিইউয়ের পাশে ছেলের অপেক্ষায় মা : বার্ন ইনস্টিটিউটের পঞ্চম তলায় আইসিইউয়ের পাশের সিঁড়িতে বসে কাঁদছেন ঝর্না বেগম নামের এক মা। সিদ্দিকবাজারে দুর্ঘটনায় তাঁর ছেলে ইয়াসিন আরাফাত (২৬) গুরুতর দগ্ধ। শ্বাসনালিসহ আরাফাতের শরীরের ৫৫ শতাংশ পুড়ে গেছে। আইসিইউয়ের ১৭ নম্বর বেডে আছেন তিনি। আরাফাত ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের পাশের এক মার্কেটে স্যানিটারি দোকানে কাজ করতেন।


খবর পেয়ে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ থেকে সন্তানের কাছে ছুটে আসা মা ঝর্না বেগম বলেন, ‘আমার চার ছেলেমেয়ের মধ্যে আরাফাত তৃতীয়। আরাফাতই সংসার চালাত। পোলাডা গতকালও (সোমবার) কইল বাড়িত যাইব। এখন আল্লাহ জানে আমার পোলাডারে বাড়িতে ফিরাইতে পারমু কি না। ডাক্তাররা তো কিছু কয় না।’


ছেলের সুস্থতায় বাবার মোনাজাত : সিদ্দিকবাজারে জুতার স্টিকার লাগানোর একটি দোকানে কাজ করতেন বাবলু (২৫)। বার্ন ইনস্টিটিউটের পোস্ট-অপারেটিভ ওয়ার্ডের ১৪ নম্বর বেডে চিকিৎসাধীন তিনি। বাইরে বারান্দায় বসে ছেলের জন্য মোনাজাত করছিলেন লক্ষ্মীপুর থেকে আসা বাবা ইসমাইল হোসাইন।


তিনি বলেন, ‘আমগো লগের (পাশের) বাড়ির এক লোক ফোন দিয়া কইল আমার পোলাডার অবস্থা খারাপ। তিন দিন আগে বাবলুর লগে কথা হইছে তার মায়ের। হেইদিন বাড়িতে টিনের ঘর করার কিছু টাকা পাঠায়। আগেও পাঠাইছে। তার টাকা দিয়া বাড়িতে ঘর উঠতাছে। আর আমার পোলাডা হাসপাতালে!’


কেউ শঙ্কামুক্ত নন

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘সিদ্দিকবাজারের দুর্ঘটনায় আমাদের এখানে ১১ জন রোগী আসে। এর মধ্যে একজনকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ট্রান্সফার করা হয়। কারণ তার বার্ন ছিল না। যে ১০ জন আছেন, তাঁরা কেউ শঙ্কামুক্ত নন। যেহেতু সবারই শ্বাসনালি পুড়েছে, তাই আমরা শঙ্কামুক্ত বলতে পারব না।’


জানা গেছে, সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণের ঘটনার পর একের পর এক অ্যাম্বুল্যান্স আসছিল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। অ্যাম্বুল্যান্সগুলো থেকে সাদা ব্যাগে ভরা মরদেহ নামানো হচ্ছিল একে একে। আনা হচ্ছিল আহতদের। তাদের আর্তনাদ ও স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে হাসপাতালের জরুরি বিভাগের পরিবেশ।


হাসপাতাল সূত্র জানায়, বিস্ফোরণের ঘটনায় অনেকে চিকিৎসা নিয়েছে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ড ও বার্ন ইউনিটে ২০ জন রোগী ভর্তি আছে। এর মধ্যে একজন শিক্ষানবিশ চিকিৎসকও রয়েছেন।