সামি মাহমুদের গল্প "আত্নকথন"

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: শনিবার ২৭শে জুন ২০২০ ১১:২৭ পূর্বাহ্ন
সামি মাহমুদের গল্প "আত্নকথন"

ভার্সিটি জীবনের প্রেমগুলো কেন যেন প্রথম ক্লাস থেকেই শুরু হয়। প্রেম না হোক, অন্তত একপাক্ষিক ভালো লাগাটা সেই প্রথম দিনের পাওয়া। হয়তবা," love at first sight" বলতে সত্যিই কিছু আছে।তাই,  আমার এই গল্পে প্রথম দিন থেকেই ভালো লাগা না দেখিয়ে আমি চিরায়ত প্রথার বিরুদ্ধাচরণ করতে চাইনা।একগাদা লোক চক্ষুর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি উপেক্ষা করার ক্ষমতা ভার্সিটি পরীক্ষা দেয়ার মাধ্যমেই পেয়ে গেছি। সেদিনও ভেবেছিলাম সেভাবেই মাথা নিচু করে শেষ বেঞ্চে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করব। কিন্তু,  ক্লাসে গিয়ে দেখি শেষ বেঞ্চটাও তৃতীয় বেঞ্চ। 

মাথা নিচু করার ঠিক আগের মুহুর্তে একজোড়া চোখে আমার দৃষ্টিসীমা আটকে গেল। এতকাল জেনে ও ভেবে এসেছি নেকাবে ঢাকা চোখ, প্রত্যেকটা চোখে ভীষণ মায়া থাকে। কিন্তু, আমার ভুল ভাঙলো সেদিন। একজোড়া বাদামি  চোখে আটকে গিয়েছিলাম। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাধ্য হয়ে আমি দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলাম। পাছে আমায় নির্লজ্ব উপাধি পেতে হয় প্রথম দিনই!

বড় ভাই পর্ব,  স্যার - ম্যাম পর্ব,  পরিচয় পর্ব সেরে আমি চলে এসেছিলাম। বেআইনি ভাবে তার একটি স্থিরচিত্রও তুলে এনেছিলাম। ব্যাচেলার লাইফে নিয়ম করে তিন বেলা না খেলেও আমি নিয়ম করে সেই স্থিরচত্রটি দেখতাম। এত করে দেখতাম তবু যেন বিরক্তি আসেনা। 

সময় গড়ালো৷ দেখতে দেখতে একমাস পেরিয়ে গেল। অসামাজিক আমি একটু একটু করে প্রয়োজনের তাগিদে সবার সাথে মিশতে লাগলাম। কিন্তু, কি অদ্ভুত! আমার সেই সুকণ্ঠীর সাথে পরিচয় হলনা৷ কত শত বার চোখাচোখি হত! মনে হত এই বুঝি কিছু বলবে বা আমি কিছু বলি!? কিন্তু না, হৃদয়ের ভেতর কোন এক বিব্রতবোধ আমাকে আটকে দিত। আমার গলা টিপে ধরত। শেষমেশ তার সাথেও কথা হল। 

বান্ধবকূলে আমি সর্বদাই উপভোগ্য হতাম৷ কিন্তু, একান্ত ব্যক্তিগত জীবনে আমি একদমই চুপচাপ। এ আমার আত্ম-প্রশংসা নয়, বাস্তবিক আমি।কিছু প্রেমগুরু বন্ধু জুটল, কিছু মেধাবী বন্ধু জুটল, কিছু "অলওয়েস চিল" টাইপ বন্ধু জুটল। কিছু জুটল যারা ছিল একান্তই সাধারণ। প্রেমগুরু বন্ধুরা বলল," বলে দে ওকে। হলে হবে নয়ত বাদ।  কিন্তু যদি না বলিস, তাহলে অন্য কেউ নিয়ে যাবে।"

আমি তাদের বলতাম, " হলে হবে না হলে বাদ দিয়ে আমার হবে না। আমার মন তো আর লোকাল বাস না!" ওরা হাসত। বলত তুই অনেক আবেগী।আমি সত্যিই অনেক আবেগী। এই আবেগের বশেই কবিতার নামে দু-চার টি শব্দ জুড়ে কিছু একটা বানিয়েছিলাম। তাকে আর দেয়া হয় নি৷ হবে কিনা জানিও না। সেই সুকণ্ঠী যখন কথা বলে, মনে হয় হৃদয়ের কোথাও যেন সুরের ঢেউ খেলে গেল। যখন হেসে ওঠে, চোখ জোড়া কিছুটা কুঁচকে যায়, কি অপরুপ লাগে দেখতে।

তার ঘোলাটে সেই স্থিরচিত্র দেখে আর আমার৩ ঘণ্টার ক্লাসে দেখে তার রুপের কিছু বিবরণ যেন আঁকতে পেরেছি। সেটা বলা যাবে না! যদি কোন দিন সেই সুকণ্ঠী জানাতে পারি আমি তাকে.........,  নাহ,  আমার তাকে ভালো লাগে৷ কেবল সেদিনই তাকে সেই শব্দমালা পড়তে দেব। দিয়ে জানতে চাইব, " কিছুটা আঁকতে পেরেছি তোমায়? নাকি আমি বরাবরের মতই ব্যর্থ?"

যখন বাস্তবতার মুখোমুখি হই, তখন ভাবি " এ তো সম্ভব না। শুধু শুধু কেন আমি আমার জগতটাকে আবার দুঃখ-সাগরে ফেলব! আবার কেন হৃদয়ের আয়নায় আরেকটি ফাটল জুড়ব! "

এসব ভেবেও কোন লাভ হয়নি। আমি আবার তাকে নিয়ে ভাবি। ভেবে যাই, এক মুহুর্ত অবসরেও।মাঝে মাঝে আমি নিজেকেই জিজ্ঞাসা করি," আমি কি তাকে সত্যিই ভালোবাসি? নাকি এ কোন মোহ, যা একটা সময় কালের বিবর্তনে কেটে যাবে?" আবার ভেবে উঠি, নাহ। মোহ কেন হবে। এতকাল এত রমণী পাশ কাটালো, কই! কারও জন্যে তো আমার এমন হয়নি।  

কোন এক ব্যক্তি আমায় বলেছিল, " ভালোবাসার সংজ্ঞায় মেপে নাও ভালোবাসো কিনা!" আমি তাকে বলেছিলাম," অতিবাহিত এই মহাকালের কত মহামনীষীই তো মেপে গেল! কেউই তো মেপে কোন কুল পায়নি। কেউ তো বলতে পারেনি যে ভালোবাসার সংজ্ঞা দিয়ে ফেলেছি৷ তবে আমি কোন অথর্ব যে ভালোবাসার সংজ্ঞা দিয়ে ফেলব কিংবা কোন তথাকথিত সংজ্ঞায় আমার ভালোবাসা মেপে দেখব!"

ভালোবাসা এক অপার্থিব জিনিস। না এর কোন সীমানা নির্ধারিত হয়, আর না একে কোন শব্দমালায় বেঁধে দেওয়া যায়! আমি বরং যাদের ভালোবাসি, তাদের বিচারেই স্বয়ং ভালোবাসাকে মেপে নেই। এ গবেষণা আর কোন একদিন বলা যাবে। সে যাই হোক, আমি কখনও সাহস করে তাকে বলে উঠতে পারিনি,

"এক জোড়া চায়ের কাপে আমার সঙ্গি হবে?

কথা দিচ্ছি বিলটা আমিই দিয়ে দেব।
এক মুহুর্তের ভুলে আমার হাত ধরবে!? 
কোন ভয় কিংবা আতঙ্কে?
কথা দিচ্ছি চিরকাল ধরে রাখব।
এক কিলো রাস্তায় আমার পায়ে পা মেলাবে?
কথা দিলাম ক্লান্ত হলে কোলে তুলে নেব।
কিংবা দোকান থেকে ঔষধ " নাপা' কিনে আনব।
তুমি কি আমায় সঙ্গ দেবে? 
এক কাপ চায়ে সঙ্গি হবে?"

বলতে গিয়ে পরক্ষণেই ভাবি, যদি আমার নরম গালে তার হাত ছুঁয়ে দেয় খুব করে। আমার তো নিজের ইজ্জত নিয়ে পালাতে হবে! সেই ভয়ে আমি সাহস করতে পারিনি। অবশেষে সুহাসিনী,  তুমি যদি পড়ে থাক তাহলে এই ইশারার মানে বুঝে নিও। বুঝে নিও এক ভীতু যুবক তোমাকে খুব করে চায়। একবার আমায় ভার্চুয়ালে বলে দিও, "তোমার সেই কবিতাখানা আমি আরেকবার পড়তে চাই।"এ কোন প্রেম-উপাখ্যান নয়৷ ইচ্ছে হল তাই ডায়রীর এক টুকরো কী-বোর্ডের তালে লিখে দিয়েছি৷

শিক্ষার্থী
বাংলা বিভাগ,জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।