সবশেষ ২০১৬ সালে পশ্চিম ইউরোপ সফরে গিয়েছিলেন মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সু চি। অর্ধ-শতাব্দীর সামরিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর তিনি সেখানে গিয়েছিলেন গণতন্ত্রের পতাকা হাতে। ৩ বছরের ব্যবধানে এবার তিনি ইউরোপে যাচ্ছেন গণহত্যার অভিযোগ মাথায় নিয়ে। যে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে তিনি দুনিয়াব্যাপী নন্দিত হয়েছিলেন, এবার তার ইউরোপ সফরের উদ্দেশ্য তাদের গণহত্যার পক্ষে সাফাই গাওয়া। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে ‘রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল’ করতেই নেদারল্যান্ডসের হেগ-এ যাচ্ছেন তিনি।
২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর পর পূর্বপরিকল্পিত ও কাঠামোগত সহিংসতা জোরদার করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। হত্যাকাণ্ড, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগের বাস্তবতায় জীবন বাঁচাতে নতুন করে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। এই নৃশংসতাকে ‘গণহত্যা’ আখ্যা দিয়ে গত ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালত ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস (আইসিজে)-এ মামলা করে গাম্বিয়া। ওই মামলার শুনানিতে অংশ নিতে আগামী ১০ ডিসেম্বর হেগ-এ যাবেন সু চি।
জাতিসংঘসহ বিভিন্ন মানাবাধিকার সংগঠন রোহিঙ্গা নিধনের ঘটনায় খুঁজে পেয়েছে গণহত্যার আলামত। তবে এইসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। সু চি’ও রোহিঙ্গাদের পক্ষে কোনও ইতিবাচক ভূমিকা নিতে সক্ষম হননি। বরং গণহত্যাকে আড়াল করার চেষ্টা করেছেন তিনি। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে নিতেও কোনও উদ্যোগ নেননি সু চি। তার কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, ‘জাতীয় স্বার্থ রক্ষায়’ আগামী ১০ ডিসেম্বর গাম্বিয়ার দায়েরকৃত মামলার প্রথম শুনানিতে অংশ নেবেন তিনি। সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি পার্টির মুখপাত্র মিও নায়ান্ট বলেছেন, ‘মিয়ানমার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। রাখাইনের উত্তরাঞ্চলে আসলে কী ঘটেছিল জাতিসংঘের আদালতে তার ব্যাখ্যা দেবেন রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা।’
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মামলার শুনানিতে মিয়ানমারের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বে সু চি থাকায় অনেকেই অবাক হয়েছেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শক্তিশালী যোগাযোগ রয়েছে সু চির এমন ঘনিষ্ঠজনরা এতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা বলছে, এতে করে বিদেশে তার ভাবমূর্তি আরও ক্ষুণ্ন হতে পারে। তবে মিয়ানমারের বাস্তবতা একেবারেই উল্টো। গত সপ্তাহে সু চির সমর্থনে বিশাল মিছিল হয়েছে সেখানে। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপে নিযুক্ত মিয়ানমারের পরামর্শক রিচার্ড হর্সে রয়টার্সকে বলেন, ‘মিয়ানমারের অধিকাংশ মানুষ রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগকে পক্ষপাতমূলক ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত বলে মনে করে। আর এর বিরুদ্ধে জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় সর্বোচ্চ ভূমিকা নেওয়া উচিত বলে মনে করেন সু চি।’
এর আগে ২০১৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর সু চি যখন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে যান তখন তাকে মানবতার নেত্রী হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়। তবে পরে রোহিঙ্গা ও জাতিগত সংঘাত ইস্যুতে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। জাতিসংঘের ওই তদন্তের পর মিয়ারমার তীব্রভাবে প্রতিবাদ করে বলেছিল, রোহিঙ্গা ‘জঙ্গিরা’ নিরাপত্তা বাহিনীর ১৩ সদস্যকে হত্যা করেছে। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে সু চি বলেছিলেন, সহিংসতা সম্পর্কে ভুয়া তথ্য ছড়ানোর পেছনে সন্ত্রাসীরা রয়েছে। উল্লেখ্য, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে রোহিঙ্গারা রাখাইনে থাকলেও মিয়ানমার তাদের নাগরিক বলে স্বীকার করে না। সেনাবাহিনীর পাশাপাশি বেসামরিক সরকার প্রধান সু চিও ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি ব্যবহারই করেন না। বরং তাদের বাংলাদেশ থেকে সেখানে যাওয়া সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যা দেয় তারা। এখনও সু চির দলের মুখপাত্র মিও নায়ান্ট বলছেন, বাড়িঘর ছেড়ে তাদের চলে যাওয়াকে মিয়ানমারের অধিকাংশ মানুষ পছন্দ করে না। তবে এই বাঙ্গালিদের চলে যাওয়ার বিষয়টি আলাদা।
৮২-তে প্রণীত নাগরিকত্ব আইনে পরিচয়হীনতার কাল শুরু হয় রোহিঙ্গাদের। এরপর কখনও মলিন হয়ে যাওয়া কোনও নিবন্ধনপত্র, কখনও নীলচে সবুজ রঙের রশিদ, কখনও ভোটার স্বীকৃতির হোয়াইট কার্ড, কখনও আবার ‘ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড’ কিংবা এনভিসি নামের রং-বেরঙের পরিচয়পত্র দেওয়া হয়েছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানুষকে। এসবের মধ্য দিয়ে বরং ধাপে মলিন হয়েছে তাদের পরিচয়। ক্রমশ তাদের রূপান্তরিত করা হয়েছে রাষ্ট্রহীন বেনাগরিকে। উগ্র বৌদ্ধবাদকে ব্যবহার করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে স্থাপন করেছে সাম্প্রদায়িক অবিশ্বাসের চিহ্ন। ছড়িয়েছে বিদ্বেষ। সে কারণে মিয়ানমারের সাধারণ মানুষও ‘রোহিঙ্গা’দের বাংলাদেশি সন্ত্রাসী হিসেবে দেখে থাকে। গত সপ্তাহে সু চির হেগে যাওয়ার বিষয়টি সমর্থন করে মিছিল হয়েছে। আগামী সপ্তাহে আরও মিছিল হবে বলে আশা করা হচ্ছে। সু চির সাবেক মিত্র কো কো জিই বলেন, ‘এখন সারাদেশে মিছিল হচ্ছে। এটা তার ভাবমূর্তিকে শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা। তবে অনেকেই মনে করছেন, এর সবটাই রাজনীতি।’
মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নিপীড়নের অভিযোগে কয়েকজন সেনা সদস্য ও কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোর্ট মার্শাল শুরু করেছে দেশটির সেনাবাহিনী। তদন্তের পর ২৬ নভেম্বর নিজস্ব আদালতে এই কথিত বিচার শুরু করেছে তারা। রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞের ঘটনায় আন্তর্জাতিক আদালতে (আইসিজে) মিয়ানমারের বিরুদ্ধে শুনানি শুরু হওয়ার কয়েকদিন আগে এই বিচার শুরু করে দেশটি। আগেই মিয়ানমারের ইন ডিন গ্রামে ১০ রোহিঙ্গাকে হত্যার দায়ে ৭ সেনা সদস্যকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। তবে এক বছরেরও কম সময় কারাভোগের পর গত নভেম্বরে তারা মুক্তি পায়। মিও নায়ান্ট বলছেন, ‘ইন ডিন এবং গু দার পিন গ্রামের গণহত্যার অভিযোগের বিষয়ে যতোদূর জানা যায়, তা হলো সেখানে গণহত্যার মতো তেমন কিছুই ঘটেনি।’
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সু চিও জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালতের শুনানিতে গণহত্যার অভিযোগ খণ্ডন করবেন। দক্ষিণপূর্বাঞ্চলীয় কারেন রাজ্য কর্তৃপক্ষ তিন সেনার সঙ্গে সু চির হাস্যোজ্জল চেহারার ছবি দিয়ে কয়েক ডজন বিলবোর্ড প্রদর্শন করেছে। এতে নিচে লেখা রয়েছে, ‘আমরা আপনার সঙ্গে আছি’। খোদ মিয়ানমারেরই অনেক ভিন্নমতাবলম্বী তাই মনে করছেন স্রেফ রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য সু চি সেনাবাহিনীর পক্ষে সাফাই গাইতে হেগে যাচ্ছেন।
সাবেক সামরিক জান্তা সরকারের খসড়া আইন অনুযায়ী, আইনপ্রণেতাদের এক চতুর্থাংশের মনোনয়ন দেয় সেনাপ্রধান। এবং তাদের সাংবিধানিক পরিবর্তনের ভেটো ক্ষমতা দেওয়া রয়েছে। রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী বছর মিয়ানমারের জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনে দেশটির সংখ্যাগুরু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সমর্থন ধরে রাখতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমালোচনার তোয়াক্কা না করেই সেনাবাহিনীর পক্ষে লড়বেন সু চি।
ইনিউজ ৭১/টি.টি. রাকিব
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।