
প্রকাশ: ১৫ অক্টোবর ২০১৯, ২১:৪৯

মেসি, ম্যারাডোনার দেশ খ্রিস্টান অধ্যুষিত আর্জেন্টিনার দ্বিতীয় প্রধান ধর্ম হচ্ছে ইসলাম– যদিও তা দেশের মোট জনসংখ্যার মাত্র ২ শতাংশ। লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মুসলমান বাস করে এ দেশটিতে।
আন্দিস পর্বতমালা দেশটির পশ্চিম সীমানা নির্ধারণ করেছে, যার অন্য পাশে চিলি অবস্থিত। উত্তরে বলিভিয়া ও প্যারাগুয়ে, উত্তর-পূর্বে ব্রাজিল, পূর্বে দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগর এবং দক্ষিণে ড্রেক প্রণালি। আর্জেন্টিনার মোট জনসংখ্যা প্রায় ৪ কোটি। তবে মুসলমানদের সঠিক পরিসংখ্যান বের করা বেশ কঠিন, কারণ দেশের আদমশুমারিতে ধর্মভিত্তিক কোনো পরিসংখ্যান করা হয় না। যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক ‘ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম’-এর ২০১০ সালের রিপোর্ট অনুসারে আর্জেন্টিনার মুসলমানদের সংখ্যা প্রায় ৫ লাখ। অন্যদিকে, ‘দ্যা পিউ রিসার্চ সেন্টার’-এর ২০১০ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী আর্জেন্টিনার মুসলিম জনসংখ্যা প্রায় ১০ লাখ। ‘অ্যাসোসিয়েশন অফ রিলিজিয়াস ডাটা আর্কাইভ (এআরডিএ)’-এর তথ্য মতে আর্জেন্টিনার মোট জনসংখ্যার প্রায় ২ শতাংশ মুসলমান।
আর্জেন্টিনায় মুসলমানদের আগমন লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশের মতোই। একসময়ে স্প্যানিশ উপনিবেশ ছিল আর্জেন্টিনা। তখন বহু পশ্চিম আফ্রিকান কালো মানুষদের আর্জেন্টিনায় আনা হতো দাস হিসেবে। এর মধ্যে আফ্রিকার দেশ মরক্কোর বহু বাসিন্দা ছিল, আর তাদের অধিকাংশই ছিল মুসলমান। এদের হাত ধরেই মুসলিম জনগোষ্ঠীর আগমন আর্জেন্টিনায়।
এরপর উনবিংশ শতাব্দীর বিভিন্ন সময় আরবদেশ, তথা বর্তমান লেবানন-সিরিয়া থেকে অনেকে অভিবাসী পাড়ি জমান লাতিন আমেরিকার এই দেশটিতে। মূলত উসমানী খিলাফতের পতনের পরে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ আরব অভিবাসী আর্জেন্টিনায় আশ্রয় নেয়। এর মধ্যে অধিকাংশ ছিলো আরব-খ্রিস্টান, এছাড়া কিছু মিজরাহি গোত্রীয় ইহুদী ও সংশয়বাদী ইহুদীও ছিল। পাশাপাশি অনেক আরব-মুসলিমও তখন আর্জেন্টিনায় আশ্রয় গ্রহণ করে, আনুমানিক প্রায় ১ লাখ মুসলিম তখন আর্জেন্টিনায় অভিবাসী হয়।
কিং ফাহাদ ইসলামী সংস্কৃতি কেন্দ্র, আর্জেন্টিনা
রাজধানী বুয়েন্স আয়ার্সে স্থাপিত প্রথম মসজিদ হচ্ছে আত-তাওহীদ মসজিদ। আর্জেন্টিনায় অবস্থিত ইরান দূতাবাসের সহায়তায় ১৯৮৩ সালে এই মসজিদটি নির্মিত হয়। এটি মূলত শিয়া সম্প্রদায়ের মসজিদ হিসাবে গণ্য হয়। এরপর ১৯৮৫ সালে সুন্নি মুসলমানদের জন্য আল-আহমাদ মসজিদ নির্মিত হয়। আর্জেন্টিনার মুসলিম স্থপতি আহমাদ এর ডিজাইন করেন। তার নামানুসারে মসজিদটির নামকরণ করা হয়। এছাড়াও দেশটির বিভিন্ন স্থানে অনেকগুলো মসজিদ নির্মিত হয়েছে। এর মধ্যে কর্ডোবায় ২টি, মার দেল প্লাতায় ২টি এবং এল বলসনের সূফি মসজিদ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
লাতিন আমেরিকান মুসলমানদের সংগঠন ‘ইসলামিক অর্গানাইজেশন অফ লাতিন আমেরিকা (আইওএলএ)’-এর সদর দপ্তর আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েন্স আয়ার্সে অবস্থিত। এই সংগঠনটি লাতিন অঞ্চলের মুসলমানদের জন্য সবচেয়ে সক্রিয় সংগঠন। সংগঠনটি এখানকার মুসলমানদের জন্য শিক্ষা-দীক্ষা, সামাজিক আন্দোলন ও দাওয়াতি কর্মকাণ্ড করে থাকে। স্বভাবতই আর্জেন্টিনায় এই সংগঠনটির বিশেষ অবদান ও প্রভাব রয়েছে। আর্জেন্টিনার স্থানীয় সংগঠনের মধ্যে ‘ইসলামিক সেন্টার অফ দ্যা আর্জেন্টাইন রিপাবলিক (সিআইআরএ) সবচেয়ে প্রভাবশালী। ১৯৩১ সালে আর্জেন্টিনায় বসবাসকারী আরব-মুসলিমদের দ্বারা এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রখ্যাত আল-আহমাদ মসজিদটিও এই সংগঠনের অবদানে প্রতিষ্ঠিত হয়।

সেখনকার মুসলমানেরা এখন কেমন আছেন এই অনুসন্ধানে ‘দ্যা আর্জেন্টাইন ইন্ডিপেনডেন্ট’ পত্রিকার এক নিবন্ধে বলা হয়, ‘আর্জেন্টাইন মুসলিমরা কোন ধরনের বৈষম্যের শিকার হন না’। আরো বলা হয়, ‘একজন আর্জেন্টাইন মুসলিম কোনো ধরনের বাঁধা ছাড়াই তার ধর্ম বিশ্বাস পালন ও অনুশীলন করতে পারেন’। পত্রিকার সাথে ‘সিআইআরএ’-এর প্রতিনিধি আলেক্সিস আই সায়ের বলেন, ‘সারাবিশ্বের মুসলমানরা যখন বৈষম্যের শিকার তখন আর্জেন্টিনার মুসলমানরা বেশ ভালো আছেন। তবে এখানকার মুসলমানদের ইসলামি জ্ঞানের অভাব রয়েছে’। আলেক্সিস বলেন, নাইন ইলেভেনের বিপর্যয়ের পরে আর্জেন্টিনার মুসলমানরা কিছুটা আতঙ্কে থাকলেও সেরকম কোনো সমস্যা তাদের হয়নি। তিনি বলেন, ‘তখন অনেক মুসলিম নিজেদেরকে মুসলিম হিসাবে পরিচয়ই দিত না’।
আর্জেন্টাইন মুসলিমদের চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করে আলেক্সিস বলেন, ‘মুসলমানরা কর্মক্ষেত্রে থাকার কারণে সবসময়ে ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায়ের সুযোগ পান না। রমজান মাসে সবাই রোজা রাখার সুযোগ পান না। তবুও আমরা ভালো আছি’।সারাবিশ্বে চলমান হিজাব বিতর্কে, আর্জেন্টিনার আদালত মুসলিম নারীদের হিজাব পরিধানের অনুমতি দিয়েছে। ২০১১ সালের ২৬ জানুয়ারি আদালতের এক রায়ে বলা হয়, জাতীয় পরিচয় পত্রেও মুসলিম নারীরা হিজাব পরিহিত অবস্থায় ছবি দিতে পারবেন। আদালত এটাকে ধর্মীয় স্বাধীনতা হিসাবে উল্লেখ করেছে।
উল্লেখ্য, ১৯৮৯ সালের নির্বাচনে বিজয়ী আর্জেন্টাইন প্রেসিডেন্ট কার্লোস মেনেম একজন সাবেক মুসলিম ছিলেন। তিনি আর্জেন্টিনার প্রথম আরব বংশোদ্ভূত প্রেসিডেন্ট। তার বংশের আদি নিবাস ছিলো সিরিয়ায়। ক্ষমতার জন্য তিনি খ্রিস্ট ধর্মে ধর্মান্তরিত হন। তার সাবেক স্ত্রী জুলিমা ইয়মা বলেন, ‘মেনেম ১৯৬৬ সালে ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেন, এর একমাত্র কারণ ছিলো তিনি দেশের প্রেসিডেন্ট হতে চেয়েছেন’। তবে তিনি ক্ষমতায় থাকাকালীন অবস্থায় মুসলমানদের নানা ভাবে সহায়তা করেন। বিশেষত সৌদি সরকারের সহায়তায় মসজিদ ও ইসলামিক সেন্টার নির্মাণ উল্লেখ্য।
বর্তমানে আর্জেন্টাইন মুসলমানদের সবচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে, ধর্মীয় শিক্ষার অভাব। স্প্যানিশ ভাষায় ইসলামি উপকরণের অভাব। স্থানীয় মুসলিম নেতারা স্প্যানিশ ভাষায় ইসলামি বইপত্র অনুবাদ করাকে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখছেন। জ্ঞানের অভাবে অনেক মুসলিম তাদের আত্মপরিচয় ভুলে যাচ্ছেন। এমনকি তারা ‘নিধর্মী’ হিসাবে পরিচয় দিচ্ছেন। ‘কাউন্সিল অন হেমসিগ্রিক অ্যাফেয়ার্স’-এর গবেষণা সহযোগী ভিনসেন্ট লোফাসোর মতে, আর্জেন্টাইন মুসলিমদের সমস্যা হচ্ছে, প্রথমত ‘তারা তাদের অনেক প্রথা (ইবাদাত) ভুলে গেছে। তারা তাদের ধর্ম সম্পর্কে জানে না। আরবি ভাষাও তারা জানে না। এমন অনেক মুসলিম পরিবার আছে যেখানে একজন মাত্র আরবি পারেন (তিনি দাদা/দাদি হবেন), বাকিরা শুধুমাত্র স্প্যানিশ পারেন’।
দ্বিতীয় কারণ হিসাবে তিনি বলেন, ‘মাতৃভাষা স্প্যানিশে খুব কম ইসলামি বইপত্র পাওয়া যায়, বিশেষত পবিত্র কোরআন পাওয়া যায় না (পবিত্র কোরআনের স্প্যানিশ অনুবাদ হলেও তা সহজলভ্য নয়)’।
তৃতীয় ও শেষ কারণ হিসাবে তিনি বলেন, ‘সেখানে মাদরাসা বা ইসলামিক স্কুল ও ইসলাম প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের অভাব রয়েছে। ফলে অনেক মুসলিম স্থানীয় প্রথা (খ্রিস্টান ধর্ম) দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছেন, এমনকি অনেকে তার মূল ধর্ম (ইসলাম) ভুলে যাচ্ছেন’। সম্প্রতি চলমান সিরিয়া সংকটের তেমন কোন প্রভাব লাতিন আমেরিকায় পড়েনি, ফলে আর্জেন্টাইন মুসলিমদের ওপরেও এর তেমন কোনো প্রভাব নেই। সর্বোপরি, ভালো থাকুক মেসি, ম্যারাডোনার দেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকেরা।
ইনিউজ ৭১/এম.আর