২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় সংঘটিত বিডিআর হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নৃশংস অধ্যায় হিসেবে রয়ে গেছে। হত্যাকাণ্ডের পর থেকে এর নেপথ্যের সত্য উদ্ঘাটনে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও অনেক প্রশ্ন আজও রহস্যাবৃত। সম্প্রতি, এ ঘটনার বিষয়ে মুখ খুলেছেন তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) মইন উ আহমেদ। ফ্লোরিডা থেকে টেলিফোনে নিউইয়র্কের একটি গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি নিজের অভিজ্ঞতা ও মতামত তুলে ধরেন।
তদন্ত কমিশন গঠন এবং সরকারের ভূমিকা
বিডিআর হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে সরকারের তদন্ত কমিশন গঠনের সিদ্ধান্তের প্রশংসা করে জেনারেল মইন বলেন, এই কমিশন জাতির প্রত্যাশা পূরণ করবে। তার মতে, এই হত্যাকাণ্ড ছিল সেনাবাহিনীকে দুর্বল করার একটি ষড়যন্ত্র। তিনি উল্লেখ করেন, কমিশনের প্রথম বৈঠকে কমিশনের প্রধান এ.এল.এম. ফজলুর রহমান বলেছিলেন, “হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র চিহ্নিত করে তা জাতির সামনে উপস্থাপন করা হবে।”
হত্যাকাণ্ডের সময় সেনাবাহিনীর প্রস্তুতি ও ভূমিকা
জেনারেল মইন তার স্মৃতিচারণে জানান, বিডিআরের তৎকালীন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদের সঙ্গে ২৫ ফেব্রুয়ারি সকালেও অস্ত্র বিতরণ নিয়ে আলোচনা হয়। সেই সময় বিদ্রোহের কোনো আভাস ছিল না। তবে সকালে দরবার হলে সশস্ত্র সৈনিকদের গণ্ডগোল শুরু হওয়ার পর পরিস্থিতি দ্রুতই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
তিনি উল্লেখ করেন, সকাল ৯টা ৪৭ মিনিটে বিডিআরের ডিজি তাকে ফোনে পরিস্থিতির কথা জানান। সেনাবাহিনীর ৪৬ ইনডিপেনডেন্ট পদাতিক ব্রিগেডকে প্রস্তুত করার নির্দেশ তিনি তৎক্ষণাৎ দেন। ব্রিগেডটি দ্রুত পিলখানার দিকে অগ্রসর হয়।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ ও সিদ্ধান্ত
সকাল ৯টা ৫৪ মিনিটে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে জেনারেল মইনের কথা হয়। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে জানান, ব্রিগেড প্রস্তুত করতে সাধারণত ছয় ঘণ্টা সময় লাগে, তবে তা দুই ঘণ্টায় সম্পন্ন করা সম্ভব। শেখ হাসিনা সেনা অভিযানের অনুমতি দেন। তবে বিদ্রোহীরা পরে আলোচনার দাবি জানায় এবং সেনাবাহিনীকে সরে যাওয়ার শর্ত দেয়।
ব্রিগেডের অভিযান এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় বাধা
৪৬ ব্রিগেড যখন পিলখানার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, তখন বিদ্রোহীরা গেটের সামনে ভারী অস্ত্র মোতায়েন করে। এক পর্যায়ে বিদ্রোহীরা সেনাবাহিনীর একটি পিকআপ লক্ষ্য করে রকেট হামলা চালায়। এতে একজন চালক নিহত হন।
সাবেক সেনাপ্রধান উল্লেখ করেন, সকাল ১১টার মধ্যে বিডিআর বিদ্রোহীরা অধিকাংশ অফিসারকে হত্যা করে। সেনাবাহিনীর সদস্যরা পিলখানার এলাকায় পৌঁছানোর আগেই হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন হয়।
আলোচনা এবং সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা
সেদিন বিকেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদ্রোহীদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করেন। বিদ্রোহীরা সাধারণ ক্ষমা চেয়ে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দেয়। প্রধানমন্ত্রী তাঁদের আত্মসমর্পণ করার আহ্বান জানান এবং সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। তবে জেনারেল মইন এর তীব্র বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন, “অপরাধীদের কোনো শর্ত মানা যাবে না। হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে হবে, আটক অফিসার ও তাঁদের পরিবারকে মুক্তি দিতে হবে এবং অস্ত্র সমর্পণ করতে হবে।”
শেষমেশ বিদ্রোহের অবসান
২৬ ফেব্রুয়ারি সেনাবাহিনী ট্যাংক এবং অন্যান্য যুদ্ধপ্রস্তুতি গ্রহণ করলে বিদ্রোহীরা আতঙ্কিত হয়ে আত্মসমর্পণে রাজি হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপে বিদ্রোহীরা সাদা পতাকা টানিয়ে আত্মসমর্পণ করে। রাত ১২টায় বিদ্রোহীদের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে ৩৩ ঘণ্টার এই নৃশংস ঘটনাবলীর অবসান ঘটে।
নতুন তথ্য প্রকাশের প্রতিশ্রুতি
জেনারেল মইন বলেন, “সেনাবাহিনী ও সরকারের ভূমিকা নিয়ে যে বিতর্ক আছে, তা নিরসন হওয়া প্রয়োজন।” তিনি এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে একটি বই লিখেছেন, যেখানে আরও অজানা তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। শিগগিরই এটি প্রকাশিত হবে বলে জানান।
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।