ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী ওমরপুর মোড়ে মারজম হালসোনার চায়ের দোকান। সেখানে গিয়ে এক প্যাকেট সিগারেট চাইলে ফিরতে হবে খালি হাতেই। সিগারেট কিনতে চাইলে একটা-দুটো পাওয়া যাবে। কিন্তু গোটা প্যাকেট বিক্রি নিষিদ্ধ। কারণ, গরু পাচারের জন্য কাজে লাগে সিগারেটের খালি প্যাকেট। আর সেই প্যাকেট বিক্রি হয় ৪ থেকে ৭ টাকা দামে। কিন্তু সিবিআই অভিযানের জেরে সিগারেটের খালি প্যাকেট বিক্রির সেই ব্যবসায় এখন ভাটা!
ভূ-ভারতে সিগারেটের ফাঁকা প্যাকেটের ঠাঁই হয় ডাস্টবিনে। কিন্তু এর ঠিক উল্টো ছবি মুর্শিদাবাদের বাংলাদেশ সীমান্তে। সারা রাজ্যে যে দামে খোলা সিগারেট মেলে, মুর্শিদাবাদের সীমান্তবর্তী ওই দোকানগুলিতে তার থেকে একটু কম দামে পাওয়া যায় খোলা সিগারেট। কারণ ফাঁকা প্যাকেট বিক্রির মধ্যেই লুকিয়ে দোকানদারের বাড়তি মুনাফা। কারণটা, জানালেন মারজম। তিনি বলেন, ‘‘গরুর দালালরা অগ্রিম বুকিং করে রাখেন দোকানে। অনেক সময় আগাম পয়সাও দিয়ে যান আমাদের কাছে। ৪-৫ টাকা দাম পাওয়া যায় একটি সিগারেটের প্যাকেটের। কখনও চাহিদা বেশি থাকলে ৭ টাকা করেও খালি প্যাকেটের দাম পাওয়া যায়।’’
সিগারেটের ফাঁকা প্যাকেট দিয়ে কী হয়? সাগরদিঘির গরু ব্যবসায়ী আকমান শেখ উত্তরটা দিলেন। তিনি বলেন, ‘‘গরুর হাট থেকে গরু কিনে এক ডিলারের মাধ্যমে অন্য ডিলারের কাছে পর্যন্ত পৌঁছনোর জন্য চার থেকে পাঁচটি থানা পেরোতে হয়। প্রতিটি থানার আলাদা আলাদা পাস, প্রতিটি গাড়ির আলাদা চিহ্ন এবং প্রতিটা দালালের নিজস্ব প্রতীক থাকে। এ সবের জন্য ব্যবহার করা হয় সিগারেটের ফাঁকা প্যাকেট।’’ কথার ফাঁকেই পকেট থেকে আকমান বার করে দেখালেন একটি বিশেষ থানার পাস। সিগারেটের প্যাকেট ছিঁড়ে তার ভিতরে সিলমোহরের মতো ওই নির্দিষ্ট ছাপ দেওয়া। যা দেখালে নাকি অনায়াসেই গরুর হাট থেকে সীমান্তে পৌঁছে দেওয়া যায় যত খুশি গরু।
বীরভূমের লোহারপুর থেকে সাগরদিঘির হাটে গরু নিয়ে আসা ব্যবসায়ী আমজাদ শেখ বলেন, ‘‘প্রতিটা থানায় এক জন করে ‘ডাক মাস্টার’ থাকে। তাঁরাই মূলত এই লেনদেনের বিষয়টি দেখভাল করেন।’’ কারা এই ডাক মাস্টার? আমজাদের উত্তর, ‘‘এঁরা কোনও পুলিশকর্মী নন। এমনকি সরকারি কর্মচারিও নন। পুলিশের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কোনও স্থানীয় ব্যক্তি যাঁর মাধ্যমে থানার আধিকারিকেরা আর্থিক রফা করেন।’’
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, মুর্শিদাবাদের সীমান্তবর্তী এলাকায় একাধিক কেন্দ্র আছে। পড়শি জেলা এমনকি ভিন্ রাজ্য থেকে গরু নিয়ে এসে মজুত করা হয় এই কেন্দ্রগুলিতে। সিবিআই সূত্রে খবর, ‘বোঝাপড়া’ চূড়ান্ত হলে এই কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশে পাচারের উদ্দেশ্যে ট্রাক ভর্তি করে গরুগুলি নিয়ে আসা হয়। ট্রাকের আকার এবং গরুর সংখ্যা অনুযায়ী থানায় দিতে হয় ‘মাসোহারা’। ১০ চাকার একটি ট্রাকে গরু থাকে ৫৫ থেকে ৬০টি। সে জন্য ট্রাকপিছু প্রতিটি থানায় প্রতি মাসে দিতে হয় ২৫-৩০ হাজার টাকা। ২০ থেকে ২৫টি গরু বহনকারী ছোট ট্রাকের জন্য থানা পেয়ে থাকে প্রতি মাসে ১০-১৫ হাজার টাকা। ইঞ্জিনভ্যানে সাত-আটটি গরু নিয়ে যেতে গেলে দিতে হয় ভ্যানপিছু মাসিক এক হাজার টাকা। টাকার অঙ্ক স্থির হয় দর কষাকষি করে। দর চূড়ান্ত হলে সিগারেটের প্যাকেটের উল্টো পিঠে ছাপ দেওয়া নির্দিষ্ট প্রতীক দেওয়া হয়। আসলে তা গরু পাচারের ‘অনুমতিপত্র’ বলেই জানালেন গরু ব্যবসায়ীরা।
দীর্ঘ দিনের গরু ব্যবসায়ী ইসমাইল হকের কথায়, ‘‘বীরভূমের ইলামবাজার হাট থেকে মুর্শিদাবাদে গরু নিয়ে আসার দু’টি রাস্তা। লোহারপুর ধরে এলে পার করতে হয় তিনটি থানা। আবার মুরারইয়ের দিক দিয়ে এলে দু’টি থানা পড়ে। থানার ‘কমিশন’ এড়াতে গরু ব্যবসায়ীরা সাধারণত মুরারইয়ের পথকেই বেছে নেন মুর্শিদাবাদ পৌঁছনোর জন্য।’’
সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে এমন কারবারের কথা অবশ্য মানতে চাননি মুর্শিদাবাদের পুলিশসুপার কে শবরী রাজকুমার। তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য, ‘‘এই ধরনের কার্ড সিস্টেম অথবা থানায় মাসোহারা দেওয়ার কথা এই প্রথম শুনলাম। এ ধরনের অদ্ভুত প্রশ্নের উত্তর দেওয়া মুশকিল।’’
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।