ডেঙ্গু জ্বরে গতকাল বুধবার রাজধানীতে এক নারী চিকিৎসকের মৃত্যু হয়েছে। কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালের রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগের জুনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. নিগার নাহিদ দিপু নামের ওই চিকিৎসক ১ জুলাই থেকে প্রথমে পপুলার ও পরে স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। রক্তে প্লাটিলেটের দ্রুত ওঠা-নামার এক পর্যায়ে স্কয়ার হাসপাতালে করুণ মৃত্যু হয় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ৩২ ব্যাচের এই ছাত্রীর। এর আগে গত ২৫ এপ্রিল রাজধানীর বিআরবি হাসপাতালে ৫৩ বছর বয়সী এক নারী ভর্তি হন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৯ এপ্রিল তিনি মারা যান। এছাড়া আসগর আলী হাসপাতালে গত ২৮ এপ্রিল ভর্তি হয়ে ৩২ বছর বয়সী এক যুবক একই দিন মারা যান। এই তিন ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যুর কারণ ব্যাখ্যা করে চিকিৎসকরা বলছেন, এই তিনজনের রক্ত পরীক্ষায় ডেঙ্গু পজিটিভ ধরা পড়ে। খুব ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় তারা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। এরা সবাই ডেঙ্গুর সর্বশেষ ধাপ সেরোটাইপ-২ (শক সিনড্রোম) নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। গত বছর থেকেই দেশে ডেঙ্গুর এই নতুন টাইপ দেখা দিচ্ছে।
এবার সেরোটাইপ-৩ (শক সিনড্রোম) ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি জানালেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. এ কে এম শামসুজ্জামান। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, এতদিন বাংলাদেশে ডেঙ্গু সেরোটাইপ-১ ও সেরোটাইপ-২-এর প্রকোপ ছিল। প্রথমটি সাধারণ ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু। দ্বিতীয়টি ঝুঁকিপূর্ণ হেমোরেজিক (রক্তক্ষরণ) ডেঙ্গু। সাধারণত ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু রোগী দ্বিতীয়বার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে হেমোরেজিক ডেঙ্গু দেখা দেয়। এ ক্ষেত্রে রোগীর শরীরের ভেতর বা বাইরে রক্তক্ষরণ হয়। গত বছর থেকে ডেঙ্গুর নতুন ধরন (সেরোটাইপ-৩) দেখা দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে রোগীদের ইন্টারনাল রক্তক্ষরণের পাশাপাশি শক সিনড্রোম দেখা দেয়। এটা শুরুতেই জানা গেলে রোগীদের চিকিৎসায় এবং মৃত্যুঝুঁকি রোধে বিশেষ ভূমিকা রাখা সম্ভব।
এই চিকিৎসক জানান, শক সিনড্রোমের উপসর্গ হলো শ্বাস-প্রশ্বাসে অসুবিধা হওয়া কিংবা শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বেড়ে যাওয়া। ত্বক শীতল হয়ে যাওয়া। অবিরাম অস্বস্তি, ত্বকের ভেতরের অংশে রক্তক্ষরণের কারণে ত্বকের ওপরের অংশে লাল ছোপ সৃষ্টি হওয়া। বমি, মল কিংবা প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত যাওয়া, প্রচ- পেটব্যথা ও অনবরত বমি হওয়া, নাক ও দাঁতের মাড়ি থেকে রক্তক্ষরণ ও অবসাদ। এ উপসর্গগুলো চোখে পড়লে আক্রান্ত রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। সেরোটাইপ-৩ বা শক সিনড্রোম ডেঙ্গুর কথা স্বীকার করেন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেবরিনা ফ্লোরা। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, হেমোরেজিক বা রক্তক্ষরণ ডেঙ্গুর সঙ্গে সেরোটাইপ-৩ বা শক সিনড্রোম ডেঙ্গুর মিল রয়েছে। শক সিনড্রোমের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত উপসর্গ হিসেবে শ্বাস-প্রশ্বাসে অসুবিধা হওয়া কিংবা শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বেড়ে যায়। চিকিৎসা একই। তাই ভয় পাওয়ার বা ঝুঁকির কিছু নেই।
এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আরও বলেন, এখন জ¦র হলে প্রথম দিনই পরীক্ষা করে ডেঙ্গু ভাইরাস শনাক্ত করা সম্ভব। তাই কারও মধ্যে ডেঙ্গুর উপসর্গ দেখা দিলেই তার উচিত দ্রুত রক্ত পরীক্ষা করা। সাধারণত ডেঙ্গু দেরিতে ধরা পড়লে ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গুই শক সিনড্রোমে রূপ নিতে পারে। সে ক্ষেত্রে রোগীর ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও নিয়ন্ত্রণ কক্ষের তথ্যানুযায়ী, এ বছরের ১ জানুয়ারি থেকে গতকাল (৩ জুলাই) পর্যন্ত ২ হাজার ২৭৭ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ৩৮, ফেব্রুয়ারিতে ১৮, মার্চে ১৭, এপ্রিলে ৫৮, মে’তে ১৯৩, জুনে ১ হাজার ৬৯৯ এবং গত তিন দিনে ২৫৪ রোগী আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। চিকিৎসা শেষে হাসপাতাল ছেড়ে গেছেন ১ হাজার ৯৩৯ জন। এর মধ্যে গতকাল পর্যন্ত মারা গেছেন তিনজন। এখনো ৩৩৬ জন ডেঙ্গু রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু জ¦রে আক্রান্ত হয়ে নতুন করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৮৩ জন।
এবার কিছুটা আগেভাগেই ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব জানালেন অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেবরিনা ফ্লোরা। তিনি বলেন, সাধারণত জুলাই থেকে শুরু হয়ে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুর মৌসুম। এবার জুনেই শুরু হয়েছে। এবার বর্ষা মৌসুমে থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে ডেঙ্গুর প্রকোপ তাড়াতাড়ি শুরু হয়েছে। বর্ষায় বৃষ্টিপাত হলে ডেঙ্গুর জীবাণুবহনকারী এডিস মশার লার্ভা পানিতে ভেসে যায়। লার্ভা থেকে মশা হতে পারে না। এবার বৃষ্টিপাত নেই। তাই এডিস মশার প্রজনন বেড়েছে। গ্রামের তুলনায় শহরে, বিশেষ করে রাজধানীতে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি বলে জানালেন এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। তিনি বলেন, এডিস মশার প্রজননের সব পরিবেশই শহরে বিদ্যমান। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য জমে থাকা পানি। গ্রামে পানি বহমান। কিন্তু শহরে ফুলের টবে, টায়ারে, নির্মাণাধীন স্থাপনায়, এসিতে, ফ্রিজে জমে থাকা পানিতে সহজেই এডিস মশা ডিম পাড়ে ও সে ডিম থেকে মশা হয়। সাধারণত একটি এডিস মশার ডিম থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে বাচ্চা হয়। সেজন্য আমরা বলি দেড় থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে জমে থাকা পানি পরিষ্কার করতে। এতে মশা ডিম পারতে পারে না। পারলেও ওই ডিম থেকে বাচ্চা হতে পারে না।
এই মৌসুমে যেকোনো জ¦র হলেই প্রথমে রক্ত পরীক্ষা করে ডেঙ্গু কি না তা নিশ্চিত হওয়ার পরামর্শ দিলেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়–য়া। তিনি ডেঙ্গু উপসর্গ তুলে ধরে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ডেঙ্গু জ¦রে সাধারণত তীব্র জ¦র এবং সেই সঙ্গে শরীরে প্রচ- ব্যথা হয়। জ¦র ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত হয়। শরীরে বিশেষ করে হাড়, কোমর, পিঠসহ অস্থিসন্ধি ও মাংসপেশিতে তীব্র ব্যথা হয়। এছাড়া মাথাব্যথা ও চোখের পেছনে ব্যথা হয়। জ¦র হওয়ার চার বা পাঁচ দিনের সময় সারা শরীরে লালচে দানা দেখা যায়। এর সঙ্গে বমিভাব এমনকি বমি হতে পারে। রোগী অতিরিক্ত ক্লান্তি বোধ করে এবং রুচি কমে যায়। এ অবস্থাটা যেকোনো সময় জটিল হয়ে উঠতে পারে। যেমন অন্য সমস্যার পাশাপাশি যদি শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে রক্ত পড়া শুরু হয়। যেমন চামড়ার নিচে, নাক ও মুখ দিয়ে, মাড়ি ও দাঁত থেকে, কফের সঙ্গে রক্তবমি, পায়খানার সঙ্গে তাজা রক্ত বা কালো পায়খানা, চোখের মধ্যে ও বাইরে রক্ত পড়তে পারে।
ইনিউজ ৭১/এম.আর
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।