মৌলভীবাজারে তীব্র হচ্ছে খাদ্য, পানি-ওষুধ সংকট, অবর্ণনীয় দুর্ভোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক
এহসান বিন মুজাহির জেলা প্রতিনিধি , মৌলভীবাজার
প্রকাশিত: শুক্রবার ২৩শে আগস্ট ২০২৪ ০৬:০৩ অপরাহ্ন
মৌলভীবাজারে তীব্র হচ্ছে খাদ্য, পানি-ওষুধ সংকট, অবর্ণনীয় দুর্ভোগ

মৌলভীবাজারে হঠাৎ ভয়াবহ বন্যায় ব্যাপক মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে।ভেঙেছে বাঁধ, ভেসেছে ফসল, তলিয়ে গেছে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, প্রতিষ্ঠান।


টানা চারদিনের ভয়ানক বন্যায় জেলার সদর, রাজনগর, কমলগঞ্জ, জুড়ী, কুলাউড়া ও বড়লেখা উপজেলার বন্যার্ত প্রায় তিন লাখ মানুষ অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। 


অধিকাংশই নিত্য অনাহারে-অর্ধাহারে দিশেহারা। অনেকেই আশ্রয়টুকু হারিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্র বা রাস্তাঘাটে ঠাঁই নিয়েছেন। বানভাসিদের খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি, অসুস্থদের ওষুধ-পথ্যের সংকট তীব্রতর হচ্ছে। 


সরকারি কিংবা বেসরকারি জরুরি ত্রাণ সহায়তা অনেকের ভাগ্যে জোটেনি। কাজকর্ম বিশেষত বন্যার কারণে এলাকায় দিনমজুর ও কৃষিকাজ না থাকায় বন্যার্তরা কোনো আয়-রোজগারও করতে পারছেন না। গোচারণ ভূমি ডুবে থাকায় গবাদি পশু নিয়ে বিপাকে পড়েছে দুর্গতরা। 


বন্যায় তলিয়েছে শরৎকালীন সবজি, আমনের বীজতলাসহ প্রায় ৪৪ হাজার হেক্টরেরও বেশি জমির ফসল ও দুই হাজারের বেশি ঘেরের মাছ ভেসে গেছে। 


শুক্রবার (২৩ আগস্ট) বন্যাকবলিত বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বৃষ্টি না থাকায় মৌলভীবাজার শহর এলাকা এবং মনু নদীর পানি কিছুটা কমেছে। উঁচু অঞ্চল থেকে পানি ধীরগতিতে কমতে শুরু করলেো নিম্নাঞ্চলের অনেক নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। রাজনগর সরকারি কলেজ পয়েন্টে বুকসমান পানি। 


এছাড়া কুলাউড়া-মৌলভীবাজার সড়ক এবং মাতারকাপন-শমসেরনগর সড়কে বইছে পানি। এর আশপাশ এলাকার বাড়িঘরে পানি বাড়ছে। গতকাল রাতে শেরপুর-সিলেট সড়কে যানচলাচল ছিল সাময়িক বন্ধ। রাজনগর উপজেলার  কদমহাটা ও কুলাউড়া উপজেলার টিলাগাঁও ইউনিয়নে মনু নদীর প্রতিরক্ষাবাঁধ গতকাল বুধবার মধ্যরাতে  ভেঙে গেছে। এতে আশপাশের প্রায় ২ শতাধিক এলাকায় পানি প্রবেশ করেছে।


এখনো বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে ধলই নদীর পানি। এদিকে মৌলভীবাজারের রাজনগর, জুড়ী, কমলগঞ্জ কুলাউড়া বন্যাকবলিত বিভিন্ন ইউনিয়নের মানুষের বসতবাড়ি ও ঘর থেকে পানি নামেনি। অনেকের ঘরে কোমর-বুকসমান পানি। এছাড়া কয়েকটি ইউনিয়নে ধীরগতিতে পানি কিছুটা কমলেও দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন বন্যাদুর্গতরা।


কমলগঞ্জের পতনঊষার ইউনিয়নের চারদিকে পানি আর পানি। রাজনগর  উপজেলার কাউয়াদীঘি হাওরপাড়ের পাঁচগাঁও, ফতেপুর ও উত্তরবাগ ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলের বেশ কিছু গ্রামের চারপাশে পানি আর পানি। এসব এলাকাসহ অনেক দুর্গত এলাকায় দেখা দিয়েছে তীব্র খাদ্যসংকট। বানভাসিদের অনেকেই অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন। বন্যার্তদের অভিযোগ সরকারি এবং ব্যক্তি উদ্যোগে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হলেও তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। 


নৌকা নিয়ে ত্রান সহায়তায় পতনঊষার ইউনিয়নের রুপসপুর এলাকা যাচ্ছিলেন একতা সমাজ কল্যাণ পরিষদ এর নেতাকর্মীরা। তাদের কাছে ওই এলাকার বন্যার্তরা বলেন আমাদের এলাকার অনেকেই খাদ্য, ওষুধ এবং পানি সংকটে রয়েছেন। ওই এলাকায় নৌকা ছাড়া যাওয়ার সুযোগ নেই। বানের স্রোতও প্রবল। এছাড়া একই অভিযোগ করেন  জুড়ী, কুলাউড়া, রাজনগর ও কমলগঞ্জের  স্থানীয় কয়েকজন। তাঁরা বলেন, গত চারদিনে দিনে কিছু এলাকায় কেউ ত্রাণসামগ্রী নিয়ে যাননি।


বন্যার্তদের মাঝে স্থানীয় মানুষের অধিকাংশ দিনমজুরি বা কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। বন্যার কারণে চারদিন ধরে এসব পরিবারের পুরুষ সদস্যরা কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। এখন তাঁরা তিন বেলা ঠিকমতো খেতে পারছেন না। অনেকেই গবাদিপশু নিয়ে বিপাকে আছেন। মাঠের জমি পানির নিচে তলিয়ে আছে। এ কারণে গোখাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে।


বন্যাকবলিত আরও কয়েকটি পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ক্ষতিগ্রস্ত বেশিরভাগ মানুষ হতদরিদ্র। অনেক পরিবার বেশ কয়েকবার নদী-বাধ ভাঙনের শিকার হয়েছেন। তাঁরা নিঃস্ব এখন। 


বন্যাদুর্গত এলাকা পরিদর্শন :

গতকাল রাতে রাজনগর উপজেলার কদমহাটায় বন্যাদুর্গত এলাকা পরিদর্শন করেছেন মৌলভীবাজার ডিসি ড. উর্মি বিনতে সালামসহ সেনাবাহিনী ও বিজিবির ঊর্ধতন কর্মকর্তারা। এ সময় উপস্থিত ছিলেন,বিএ-৩৭৭৬ মেজর জেনারেল চৌধুরী মোহাম্মদ আজিজুল হক হাজারী, ওএসপি (বার), এসজিপি, এনডিসি, পিএসসি, এমফিল।


উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতা  :

বন্যাদুর্গত উপজেলাগুলোতে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমে ইতোমধ্যে জেলার জেলা প্রশাসন, সেনাবাহিনী, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থী, সেনাবাহিনী, বিএনপি, জামাত, ছাত্রশিবির, খেলাফত মজলিস, ছাত্র মজলিস, যু্ব মজলিস, মৌলভীবাজার মুসলিম কমিউনিটি, আল খলীল, একরামুল মুসলিমীন মৌলভীবাজার, কমলগঞ্জ একতা সমাজকল্যাণ পরিষদ, বরুণা মাদরাসাসহ অন্যান্য অনেক স্বেচ্ছাসেবি সংগঠন কার্যক্রম চালাচ্ছেন।


ত্রাণ সহায়তা :

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার কার্যালয়ের সূত্রে জানা গেছে, বন্যার্তদের সহায়তায়  সরকারিভাবে ৭ উপজেলায় চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২শ৩৫ মেট্রিক টন। এরমধ্যে বড়লেখা উপজেলার ৪০ মে.টন চাল, জুড়ী উপজেলায় ৩০ মে. টন, কুলাউড়া উপজেলায় ১৫ মে. টন, রাজনগর উপজেলায় ৩০ মে. টন, মৌলভীবাজার সদর ৫০ মে. টন, শ্রীমঙ্গল উপজেলায় ২০ মে. টন, কমলগঞ্জ ৫০ মে, টন চাল বরাদ্দ প্রদান করা হয়। বন্যাক্রান্ত ৭ উপজেলায় ১২ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।


জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, মৌলভীবাজার জেলার ৭২টি ইউনিয়নের ৪৫০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। জেলায় মোট ৯৮টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এখন পর্যন্ত আশ্রয়কেন্দ্রে গেছেন প্রায় ৬ হাজার মানুষ। 


মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্য অনুযায়ী শুক্রবার (২৩ আগস্ট) বেলা ৩টার আপডেট অনুযায়ী জেলার মনু নদী (রেলওয়ে ব্রীজ) এর পানি বিপদসীমার ২২ সে.মি. নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, মনু নদী (চাঁদনীঘাট) এর পানি বিপদসীমার ১১১ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, ধলাই নদী (রেলওয়ে ব্রীজ) এর পানি বিপদসীমার ১৩২ সে.মি, নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, কুশিয়ারা নদী (শেরপুর) এর পানি বিপদসীমার ১১ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, জুড়ী নদী (ভবানীপুর, জুড়ী) এর পানি বিপদসীমার ১৯৫ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।


প্রসঙ্গত, মৌলভীবাজার জেলার মানুষ এর আগেও কয়েকবার বন্যার সাক্ষী হয়েছে। বিশেষ করে ১৯৬৬, ১৯৮৮, ১৯৯৮, ২০০৪, ২০০৮, ২০১৭, ২০২২ সালে। কিন্তু এবারের বন্যা অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে বলে ভোক্তভুগিরা বলেন।