আমাকে নিয়ে বাজার গরম ...

নিজস্ব প্রতিবেদক
বিনোদন ডেস্ক
প্রকাশিত: শুক্রবার ১লা এপ্রিল ২০২২ ০৮:৫২ অপরাহ্ন
আমাকে নিয়ে বাজার গরম ...

অস্কারের মঞ্চে বডি শেমিংয়ের অভিযোগ উঠেছে, তাই এত হইচই৷ শরীর, গায়ের রং নিয়ে রসিকতা ভারতের সমাজে এবং ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে স্বাভাবিক ঘটনা, মনে করেন অভিনেত্রী শ্রীলেখা মিত্র৷


ডয়চে ভেলে: অস্কারের মঞ্চে ক্রিস রক যা বলেছেন, আপনি কি তা সমর্থন করেন?

শ্রীলেখা মিত্র: ক্রিস রক যা বলেছেন, তা বডি শেমিংয়ের নামান্তর৷ ফলে সমর্থন করার প্রশ্নই ওঠে না৷ একজন মানুষের অসুস্থতা কখনো রসিকতার বিষয় হতে পারে না৷ তবে তার প্রতিবাদে উইল স্মিথ যা করেছেন, তা-ও সমর্থনযোগ্য নয়৷ প্রকাশ্য মঞ্চে ওভাবে চড় মারা যায় না৷ মুখে কথা বলেই তিনি প্রতিবাদ জানাতে পারতেন৷ তবে গোটা ঘটনায় একটি বিষয় চোখে পড়ার মতো৷ ক্রিস রক যখন বলছেন আর উইল স্মিথ যখন চড় মারছেন, দুই সময়েই দর্শক একইরকমভাবে হেসে যাচ্ছিল৷ এরা কিন্তু সকলেই বড় বড় মানুষ৷ তাই অস্কারের সভায় যেতে পেরেছেন৷ বডি শেমিং এবং তার উত্তরে সহিংসতা দুটোই তাদের কাছে রসিকতা৷ এটাই সমাজের সমস্যা৷


বডি শেমিং কি তাহলে সমাজের মজ্জায় গেঁথে আছে?

অবশ্যই৷ মানুষের শরীর, চেহারা নিয়ে রসিকতা করা তো সমাজের আদিতম চর্চাগুলির একটি৷ সমাজ এসব নিয়ে মজা পায়৷ এগুলি যে অন্যায়, সে বোধ সমাজের নেই৷


মালয়েশিয়ায় জেল, জরিমানার আইন

মালয়েশিয়ায় সামাজিক মাধ্যমে কারো শরীর নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্য করলে সর্বোচ্চ সোয়া ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা সর্বোচ্চ এক বছরের জেল, কিংবা উভয় শাস্তি হতে পারে৷ ২০১৯ সালে দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বডি শেমিংয়ের প্রভাব নিয়ে একটি সচেতনতামূলক পোস্টার প্রকাশ করেছিল৷ এতে বলা হয়, বডি শেমিংয়ের কারণে চাপ ও মানসিক সমস্যা, আত্মবিশ্বাস হারানো, খাওয়া-দাওয়ায় সমস্যা, বিষাদ ও আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা দিতে পারে৷


আপনি এখন বডি শেমিংয়ের বিরুদ্ধে এত কথা বলছেন, কিন্তু আপনিও কি এধরনের বিষয়কে উসকে দেননি? মিরাক্কেল নামে একটি জনপ্রিয় অনুষ্ঠানে আপনি তো নিয়মিত জাজ হিসেবে বসতেন! সেখানে তো এ ধরনের রসিকতা অনেক হতো!


প্রথমত, আমি আর ওই অনুষ্ঠানে যোগ দিই না৷ দ্বিতীয়ত, একটি কথা বলে নেওয়া ভালো৷ টেলিভিশন শোয়ে সব নিজের হাতে থাকে না৷ বরাবর সেক্সিস্ট এবং বডি শেমিং জাতীয় রসিকতার বিরোধিতা করেছি৷ খুব কড়া ভাষায় প্রতিবাদ করেছি৷ কিন্তু টেলিকাস্টের সময় দেখেছি, ওই অংশগুলি কেটে দেওয়া হয়েছে৷ টিআরপি-র জন্য টেলিভিশন সব করতে পারে৷ বডি শেমিং নিয়ে তাদের বিশেষ মাথা ব্যথা নেই৷ একটা কথা এখানে স্পষ্ট করে বলতে চাই, সেক্সুয়াল বা যৌনতা বিষয়ক জোক নিয়ে আমার কিন্তু কোনো আপত্তি নেই৷ কিন্তু সেক্সিস্ট অথবা বডি শেমিং জাতীয় জোক নিয়ে আছে৷ যে জোক অন্যকে দুঃখ দেয়, কষ্ট দেয়, তা কখনো সত্যিকারের রসিকতা হতে পারে না৷


বেশ কয়েকবছর আগে বডি শেমিং বিষয়টি নিয়ে উত্তাল হয়েছিল কলকাতা৷ মীরের সঙ্গে ঋতুপর্ণ ঘোষের বিতর্ক সাড়া ফেলে দিয়েছিল৷ আপনি কীভাবে দেখেন বিষয়টি?


যারা স্ট্যান্ড আপ কমেডি করেন, কিংবা মিমিক্রি করেন, সমাজ থেকেই তাদের রসদ জোগাড় করে নিতে হয়৷ মীর ঋতুপর্ণের কথা বলা নকল করেছিল বা সেটা নিয়ে মিমিক্রি করেছিল৷ ঋতুপর্ণের বক্তব্য ছিল, মীর অত্যন্ত চটুল মিমিক্রি করতে গিয়ে ট্রান্সজেন্ডারদের আঘাত করছেন এবং একটি কমিউনিটিকে অসম্মান করছেন৷ আমার মনে হয়, সমাজ থেকে রসদ নেওয়া এবং সেটাকে রসিকতার পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার মাঝখানে একটি খুব সূক্ষ্ণ লাইন থাকে৷ সেই লাইন পেরিয়ে গেলে সেটা বডি শেমিং বা কমিউনিটি শেমিংয়ের জায়গায় চলে যায়৷ সেক্সিস্ট হয়ে যায়৷ ঋতুপর্ণ সম্ভবত সে কথাটিই বলতে চেয়েছিলেন৷


আপনাকেও তো বডি শেমিংয়ের শিকার হতে হয়েছে ইন্ডাস্ট্রিতে৷

একবার নয়, একাধিকবার৷ কিছুদিন আগে রিমঝিম মিত্র আমাকে ‘থলথলে বৌদি’ বলে বাজার গরম করেছিলেন৷ আমি তীব্র প্রতিবাদ করেছিলাম৷ মিডিয়া কিন্তু তখন আজকের মতো প্রতিবাদ করেনি৷ তারা আমাদের বিতর্ক বিক্রি করে টিআরপি তুলছিল৷ একবারও তখন মিডিয়ার মনে হয়নি, বডি শেমিং নিয়ে সিরিয়াস আলোচনা করা দরকার৷


ভারতের বিজ্ঞাপন, সিনেমা, সিরিয়াল, সিরিজ সবের মধ্যেই কি বডি শেমিং, সেক্সিস্ট বিষয়গুলি কোথাও গেঁথে থাকে বলে মনে হয়?


থাকে তো! ভিলেনের গায়ের রং কখনো ফর্সা দেখেছেন? নির্বোধ বোঝানোর জন্য মোটা মানুষদের কাস্ট করা হয়৷ খারাপ মনের নারী মানেই তাকে সিগারেট খেতে হবে, মদ খেতে হবে, শরীর দিয়ে প্রমাণ করতে হবে যে সে খারাপ৷ কিন্তু হিরো মদ খেলে কিন্তু তাতে দোষ নেই৷ এমনকি, ছোটদের ছবিগুলিতেও এমন জিনিস দেখা যায়৷ দুষ্টু বাচ্চা মানেই সে কালো৷ হাবাগোবা বাচ্চা মানেই সে মোটা, লেথারজিক৷ বলছি না, মজ্জায় ঢুকে আছে এসব৷ আমাদের সমাজ-সংস্কৃতি-অর্থনীতি-রাজনীতি সবকিছুর মধ্যে এসব ঢুকে বসে আছে৷


রাজনীতিতেও?

নিশ্চয়৷ খেয়াল করবেন, কোনো নারী রাজনীতিবিদের বিরোধিতা করতে হলেই তার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলার একটি অদ্ভুত প্রবণতা আছে৷ আমি নিজে রাজনীতিমনস্ক৷ তার জন্য আমায় চরিত্র, শরীরের গঠন নিয়ে কথা শুনতে হয়েছে৷ পুরুষদের ক্ষেত্রেও এ কথা সত্যি৷ বহু রাজনীতিকের শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে রসিকতা করা হয়৷ আসলে সমাজ এগুলোই ‘খায়’৷ পপুলিস্ট হতে হলে সমাজের কাছে এসব বেচা সহজ৷ সে কারণেই দিনে দিনে এসব আরো বাড়ছে৷