মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে মোতাহির আলী নামে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে বসতঘরের আঙিনায় সাতপীরের নামে স্বপ্নের ভুয়া মাজার প্রতিষ্ঠা করে দীর্ঘদিন যাবত সরলমনা মুসলমানদের সাথে প্রতারণা করে আসছেন। কোনো কবরস্থান নেই, কিন্তু প্রবাস থেকে স্বপ্নে দেখে বাড়ির আঙিনায় বানিয়েছেন সাত পীরের ভুয়া মাজার। চাঞ্চল্যকর ঘটনাটি শ্রীমঙ্গল উপজেলার ৩ নং সদর ইউনিয়রের পূর্ব লালবাগ এলাকায়।
৭ পীরের নামে কল্পিত এ মাজারকে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ভুয়া বলে প্রতিবাদ করে আসছেন এলাকাবাসী। জুলাই বিপ্লবের পর ভুয়া মাজার অপসারণরে দাবিতে আরও সোচ্চার হন এলাকাবাসী। সম্প্রতি এলাকার তাওহিদি জনতার পক্ষ থেকে মো. আবুল হোসেন স্বাক্ষরিত একটি লিখিত অভিযোগ শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর দেওয়া হয়েছে। এতে ভুয়া মাজার অপসারণসহ সকল কার্যক্রম বন্ধ করতে প্রশাসনের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে।
গতকাল সরেজমিন পূর্ব শ্রীমঙ্গল আবাসিক এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, মাজারের প্রবেশ পথের গেটে লেখা রয়েছে ‘নূরে দরবারিয়া মাজার শরিফ’ এবং ভেতরে লেখা ৭ পীর। মাজারের ভেতেরে প্রবেশ করে দেখা যায়, কবরের আকৃতিতে পাশাপাশি ৭টি কবর। এরমধ্যে একটি কবরের সামনে সাইনবোর্ডে লেখা নুরে দরবারিয়া মাজার শরিফ। সামনে রয়েছে একটি দানবাক্স ও মোমবাতি জ্বালানোর পাকা স্থাপনা। ৭ কবরের মাঝে বড় কবরটিতে দুইপাশে সাদা ও মধ্যখানে লাল রঙের কাপড় দিয়ে মোড়ানো। আর এখানে দেখা গেলো কিছু মহিলা ও পুরুষ মাজার জিয়ারত করছেন।
পাশে ছোট একটি মহিলাদের ও একটি পুরষের নামাজ ঘর রয়েছে। বিভিন্ন সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে, মাজারের ভেতরে বাকি জ্বালানোর সময় খাদেমের সাথে কথা বলা নিষেধ। খাদেমের অনুমতি ছাড়া দান বাক্সের উপরে পানি, তেল ও তাগা রাখা নিষেধ। এছাড়া লেখা রয়েছে খাদেমের সাথে দেখার করার সময় সকাল ১১টা হতে বিকেল ৪টা পর্যন্ত। এলাকাবাস জানান, স্বপ্নের ভুয়া মাজার যে স্থানে তৈরি করা হয়েছে সেই স্থানে আগে বড় একটি বাঁশঝাড় ও গাবরের গর্ত ছিলো।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সাত পীরের মাজার এর খাদেম মোতাহির আলী সৌদি আরবের মক্কা নগরীতে হজ্ব পালনরত অবস্থায় ২০০১ সালে ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় স্বপ্নে নির্দেশ পান যে, শ্রীমঙ্গল থানাধীন পূর্ব শ্রীমঙ্গল এলাকায় নিজ বসতঘরের আঙিনায় সাতটি কবরের আকৃতি করে মাজার স্থাপন করার জন্য। পরবর্তীতে তিনি ২০০২ সালে দেশে এসে নজ বাড়িত ৭টি কবর আকৃতি করে মাজার স্থাপন করেন। উক্ত কবরের ৫টি উত্তর-দক্ষিণ এবং ২টি পূর্ব পশ্চিম শিয়রী অবস্থায় নির্মাণ করা হয়।
তবে উক্ত নির্মিত কবরে কোন মৃত মানুষকে সমাহিত করা হয়নি। নির্মিত ৭টি কবরের চারপাশে পাকা দেয়াল। ৭টি কবরের স্থানই বর্তমানে সাত পীরের মাজার নামে এলাকায় পরিচিত।
মাজারের সামনে দেখা হয় খাদেম মোতাহিরের প্রতিবেশি জেসমিন বেগমের সাথে। মাজার সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যেখানে মাজার করা হয়েছে সেখানে আমরা ছোট বেলায় পায়খানা করতাম এবং ময়লা-আবর্জনার স্তুপ ছিল। এখানে একটি কবরও নেই, যেখানে কবরস্থান নেই এখানে মাজার হয় কিভাবে?
এলাকার সবাই জানে এটা ময়লার ভাগাড় ছিল। মোতাহির ভুয়া মাজার দাবি করে এলাকাবাসি এবং সরলমনা মুসলমানদের সাথে প্রতারণা করে অনেক টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এলাকার বাসিন্দা ও পূর্ব শ্রীমঙ্গল জামে মসজিদের মোতয়াল্লি মোঃ মকবুল মিয়া জানান, সাতপীরের মাজারের বাড়িটি ১৯৫৬ সালের রেকর্ড অনুযায়ী আমার বাবার ছিল।
পরর্বতীতে খাদেম মোতাহির আলীর বাবা নূর মিয়ার কাছে তিনি বিক্রি করেন। সেখানে মোতাহির আলী রাতের বেলা একেক করে ভুয়া সাতটি কবরস্থান তৈরি করেন। আমার জানামতে এই ভূমিতে কোন ধরণের কবর অথবা মাজারের কোন চিহৃ ছিল না। সে নিজের মনগড়া ৭ পীরের ভূয়া মাজার তৈরী করে এলাকাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে আগত সরলমনা মুসলমানদের সাথে প্রতারণা করে আসছে। আমরা শুরু থেকে এখন পর্যন্ত মাজার অপসারণে ও কার্যক্রম বন্ধের দাবিতে সোচ্চার। ভূয়া মাজারের খাদিমের বিরোদ্ধে আইনী ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাচ্ছি।
পূর্ব শ্রীমঙ্গল লালবাগ গ্রামের আবুল হোসেন বলেন, পূর্ব শ্রীমঙ্গলের লালবাগ এলাকায় জনৈক মোতাহির আলী তার বসতঘরের আঙিনায় কোনো কবরস্থান না থাকা সত্তে¡ও ৭ পীরের মাজার নামে এলাকাবাসী এবং সরলমা মুসলমানদের সাথে দীর্ঘদিন যাবত প্রতারণা করে আসছেন। তিনি বিদেশে বসে স্বপ্নে দেখে দেশে এসে মাজার বানানোর সিদ্ধান্ত নেন। এলাকার মানুষদের সাথে সম্পূর্ণ ধোকাবাজি ও প্রতারণা করে ৭পীরের নাম নাম দিয়ে ২০১১ সালে ভুয়া মাজার প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে তিনি খামি এর দায়িত্ব পালন করছেন। যারা এই মিথ্যা ৭ পীরের মাজারের প্রচার প্রসারের কাজে নিয়োজিত তাদেরকে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছেন তিনি।
মাজারের বিভিন্ন কার্যক্রমে তার আপন বোন মমতা ও ছোট শ্যালক সহযোগী হিসেবে কাজ করছে। এছাড়া মাজার পরিচালনা কমিটিতে রাখা হয়েছে তার ছেলে, তার আপন বোন জামাই, ভাগনা, ভাতিজাকে। পরিবারের সদস্যরাই কমিটিতে স্থান পেয়েছেন এবং আয়-ব্যয় তাদের হাতেই। তিনি বলেন, ২০১৭ সাল হতে এখন এলাকাবাসী বিভিন্নভাবে প্রতিবাদ ও মানববন্ধন করে আসলেও তার অর্থশক্তির কাছে এলাকাবাসি পরাজিত। ভুয়া মাজার অপসারণ ও কার্যক্রম বন্ধে এলাকার মানুষেরা গণস্বাক্ষর সম্বলিত স্বারকলিপিজেলা প্রশাসক ও শ্রীমঙ্গল থানা বরাবর লিখিত অভিযোগ দেওয়ার ভিত্তিতে প্রশাসন ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা তদন্ত করে।
তদন্তের প্রতিবেদনে এটি সম্পূর্ণরূপে ভুয়া মাজার প্রমাণিত হয় এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়। ২০২৭ সালের আগস্ট মাসে শ্রীমঙ্গল তথানা প্রশাসন থেকে মোতাহির আলীকে মাজারের সকল প্রকার কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়। তা সত্তে¡ অর্থশক্তির কারণে মাজারের সকল কার্যক্রম এখনো চালিয়ে আসছে। এখানে কোন মাজার নেই, অথচ ওরসের নামে বেহায়াপনাসহ ইসলাম বিরোধী বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান করে পরিবেশকে মারাত্মকভাবে বিঘিœত করা হচ্ছে বলে স্বারকলিপিতে উল্লেখ করেন তারা। সামাজিক অবক্ষয় ও অপকর্ম রোধে তথাকথিত ৭ পীরের মাজারের নামে জনৈক মোতাহিরের তৈরি মাজার আকৃতির স্থাপনা অপসারণ ইউএনও’র সদয় দৃষ্টি কামনা করেন এলাকাবাসি।
সদর ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ডের সাবেক মেম্বার আব্দুস সালাম রাজা বলেন, এখানে পূর্বে কোনো কবরস্থান বা মাজার ছিল না। বরং বর্তমানে যেখানে মাজার করা হয়েছে সেখানে ছিল গরুব গোবর ফেলার স্থান। আমরা ছোটবেলায় মানুষ পায়খানা করতো, গরুর গোবর ফেলতো। এর পাশে ছিল বাশঝাড়। মোতাহির প্রথমে ওয়েলিন্ডং এর কাজ করতো। তার অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো না থাকায় তার পরিবার সৌদি পাঠায। সৌদি থেকে দেশের বাড়িতে শূন্য হাতে ফিরে এসে বাড়ির সামনে একটি ছোট টং দোকান তৈরী করে কোনরকম সংসার চালাতেন।
অভাবেরর তাড়নায় ২০১১ সালে সারি সারি ভুয়া কবর সাজিয়ে ৭ পীরের মাজার বানিয়ে ভন্ডামি চালিয়ে শুরু করে প্রতারণা করে আসছে। নিজের পিতার নামে মাজারের নামকরণ করা হয়েছে নূরে দরবারিয়া শরীফ এবং বেনামী ৭ পীরের ভূয়া মাজার। কাউকে সে এই পীরদের নাম জানাতে চায় না। মোতাহিরের প্রতারণার ফাঁদ থেকে সরলমনা মুসলমানদেে বাঁচাতে কয়েক বছর ধরে অনেক প্রতিবাদ করেও লাভ হয়নি বলেও তারা জানান। তবে জুলাই বিপ্লবের পর তাদের এ আন্দোলণ সফল হওয়ার আশাবাদী তারা।
এ বিষয়ে শ্রীমঙ্গল সদর ইউনিয়ন পরিষদের ৫ নং ওয়ার্ডের সদস্য গিয়াস দাস বলেন, মাজার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে মোতাহির আলী ও এলাকাবাসির সাথে ঝামেলা চলছে। তবে আমি এলাকাবাসি সুত্রে জেনেছি যেখানে বর্তমানে মাজার করা হয়েছে, এখানে কারো কোনো খবর নেই। এটা নিয়ে অনেক প্রতিবাদ সর্বশেষ মামলা পর্যন্ত গড়িয়েছে। এ বিষয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশ শ্রীমঙ্গলের ফিল্ড সুপার ভাইজার আব্দুল বারি বলেন, ৭ পীরের মাজার বিষয়ে তদন্ত করার জন্য ইউএনও স্যার আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন, চলতি মাসেই আমি তদন্তের প্রতিবেদন স্যারের কার্যালয়ে প্রেরণ করেছি। তবে তদন্ত করে ৭ পীরের মাজারে কবরস্থানের কোনো অস্তিত্ব মিরেনে এবং এটি ভুয়া মাজার বলে প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন তিনি। শ্রীমঙ্গল থানার এসআই (ডিএসবি) জিয়া উদ্দিন বলেন, ওসি স্যারের নির্দেশে সাত পীরের মাজার নিয়ে তথ্য নিয়ে জানতে পেরেছি এটি ভুয়া। এখানে কোনা কবর নেই। সাতটি কবর আকৃতি হলেও কাউকে সমাহিত করা হয়নি।
মাজারের স্থানে কোনো কবরস্থান নেই স্বীকার করে নূরে দরবারিয়া সাতপীরের মাজার শরীফের খাদেম অভিযুক্ত মোতাহির আলী বলেন, আমি ২০০১ সালে হজ্ব করি। হজ্ব পালনকালে আমার গায়ে হালকা বাতাস লেগে আমার ঘুম এসে যায়। তখন স্বপ্নে দেখি আমার বাড়িতে নূরে দরবারিয়া মাজার শরীফের আকৃতি। স্বপ্নের ধারাবাহিকতার ২০১১ সালে মাজার তৈরি করি। সাত পীরের নাম জানতে চাইলে তিনি বলেন, সাতপীরের নাম আমার কাছে এখনো আসে নাই। শুধু নূরে দরবারিয়া মাজার শরীফ এর নাম এসেছে। যখন তিনি জানবেন সকলের সামনে তুলে ধরবেন।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ ইসলাম উদ্দিন দৈনিক খোলা কাগজকে জানান, এ বিষয়ে এলাকার মানুষজন আমার কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন। যারা অভিযোগ নিয়ে এসেছিলেন আমি তাদের বলে দিয়েছি, যদি মাজার কেদ্রিক কোনো ধরণের অসামাজিক বা অনৈসলামিক কার্যকলাপ হয় অথবা প্রতারণার অভিযোগ পাওয়া যায় তাহলে তদন্ত সাপেক্ষে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়া আমি এ বিষয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার দায়িত্ব দিয়েছিলাম ইসলামিক ফাউন্ডেশ শ্রীমঙ্গল এর ফিল্ড সুপারভাইজার আব্দুল বারিকে। পরবর্তীতে তদন্ত প্রতিদেন এর আলোকে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হবে।
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।