প্রকাশ: ২৯ জুলাই ২০২৪, ১৫:২৩
" আন্দোলন আমার বুকের ধনকে কেড়ে নিল " সেদিন (২০ জুলাই) কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ও পুলিশের মধ্যে ধাওয়া পাল্টাধাওয়া চলছিল। এসময় মুহুর্মুহু গুলির আওয়াজ ও ককটেল বিস্ফোরণ, টিয়ারসেলে পুরো এলাকা প্রকম্পিত ও অন্ধকার হয়ে পড়ে। আতঙ্কিত বাসা- বাড়ির লোকজন দরজা- জানালা বন্ধ করে কেউ ঘরে, কেউবা ছাদের উপর থেকে গোলাগুলির দৃশ্য দেখছে।এসময় মানুষের শূরগোল আর আর্তনাদ চলছিল। আমি আমার মানিক ধন হোসাইনকে বলি বাবা ঘর থেকে বের হয়োনা। দুপুরের দিকে খাবার খাইয়ে দেই। সে আমাকে বলে,- মা’ খেলনার গোলাগোলি হচ্ছে, পটকা ফুটাচ্ছে, ফাঁকা গুলি ছুড়ছে, কিছু হবেনা, ভয় পেয়োনা। কিছুক্ষন পর আমার ছেলেকে আর খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তখন তার বাবা বাসার বাহিরে ছিল। পরে বুঝলাম, সে এ অবস্থার মধ্যদিয়ে পপকর্ন, আইসক্রিম ও চকলেট ফেরি করে বিক্রি করতে বেড়িয়ে গেছে।
এমতাবস্তায় বিকেল গড়িয়ে আসলেও ছেলে হোসাইন বাসায় ফেরেনি। বিকেল সাড়ে পাঁচটা অব্দি বাসায় না ফেরায় সন্তানের খোঁজে তার বাবা মানিক মিয়া বের হন। সংঘর্ষের কারণে প্রায় ২ ঘন্টা পর্যন্ত উল্টো পথে ঘুরে বাসায় এসে দেখেন, তখনো তাঁর ছেলে বাসায় ফেরেনি। বাসায় ছোট দুই মেয়ে মাহিনুর আক্তার (৮) ও শাহিনুর আক্তার (৬)কে ঘরে তালাবন্দী করে মানিক মিয়া ও স্ত্রী মালেকা বেগমকে সঙ্গে নিয়ে সন্তানের খোঁজে বের হন। চিটাগাং রোডসহ আশপাশের এলাকা তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কোথাও খুঁজ মেলেনি হোসাইনের।
সেদিন রাত নয়টার দিকে কেউ একজন এসে মুঠোফোনে আহত হোসাইনের ছবি দেখালে তাঁরা জানতে পারেন, হোসাইনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাৎক্ষণিক স্বামী-স্ত্রী একটি পিকআপে করে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত যান। সেখানে সড়কে কোনো গাড়ি নেই। কিছু সময় হেঁটে, কিছু সময় জিরিয়ে নিয়ে এগিয়ে চলেন ঢামেকের পথে। পরে এক রিকশাওয়ালাকে হাতে-পায়ে ধরে রাত সাড়ে ১২টায় ঢাকা মেডিকেলে পৌঁছে মেডিকেলের সব জায়গা খুঁজে হোসাইনকে না পেয়ে। চিকিৎসকদের কাছে গেলে তাঁরা বলেন, চিটাগাং রোড এলাকা থেকে গুলিবিদ্ধ অনেককেই আনা হয়েছে। আহত সবার চিকিৎসা চলছে। পরে চিকিৎসকের কথায় হাসপাতালের বারান্দায় বসে অপেক্ষা করছিলেন, চিকিৎসা শেষ হলে সন্তানকে দেখতে যাবেন। রাত ২টা একজন নার্স এসে জিজ্ঞাসা করেন, আপনারা কেন এখানে বসে আছেন? পরে নিজের সন্তানের কথা বলেন। তখন ওই নার্স বলেন, ছেলের নাম কি হোসাইন? তারা উত্তরে বলেন, হ্যা। তখন তাঁদের লাশ ঘরের কাছে নিয়ে যান। অনেকগুলো মরদেহের সঙ্গে ছোট্ট হোসাইনের মরদেহ মিলল সেই লাস ঘরে।
গত ২০ জুলাই দুপুরে রাজধানীর চিটাগাং রোড এলাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সাথে আইনশৃংখলা বাহিনীর গোলাগুলি ও সংঘর্ষ চলাকালে ১০ বছরের শিশু হোসাইনের বুকে ও তলপেটে ২টি গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হোসাইনের সেদিনকার মর্মান্তিক ঘটনার এভাবেই বর্ণনা দিয়েছেন এ প্রতিবেদককে নিহত হোসাইনের মা' মালেকা বেগম। পরে ২২ জুলাই সোমবার রাত ২টায় নিহতের মামার বাড়ি কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলার রাজামেহার ইউনিয়নের বেতোরা গ্রামে তার দাফন সম্পন্ন হয়। কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিহত ১০ বছর বয়সী শিশু হোসাইনের বাড়িতে এখনও চলছে শোকের মাতম। রবিবার (২৮ জুলাই) বিকেলে সরেজমিনে বেতোরা গ্রামে যেয়ে দেখা যায় শোকার্ত মানুষের ঢল। স্বজন প্রতিবেশীরা নিহত হোসাইনের বাবা-মা’কে শান্তনা দেয়ার চেষ্টা করছেন।
নিহত হোসাইনের বাবা মানিক মিয়া বলেন, তাঁর বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার বরিশল গ্রামে। সেখানে তাঁর স্বজন বলতে কেউ নেই। বিয়ের পর থেকে তিনি কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলার বেতোরা গ্রামে শ্বশুরবাড়িতে থাকতেন। বছর পাঁচেক আগে ঢাকায় যান। চিটাগাং রোড মুক্তিনগর এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় থাকেন। ঢাকায় বাবা- ছেলে মিলে সারা দিন ফেরি করে চিপস, চকলেট, পপকর্ন, আইসক্রিম বিক্রি করেন। সংসারে ২ কণ্যা সন্তান ও ১ পুত্র সন্তানের মধ্যে নিহত হোসাইন ছিল তাদের বড় ছেলে।
দেবীদ্বার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিগার সুলতানা বলেন, নিহত শিশুর বাড়িতে গিয়ে শোকার্ত পরিবারকে শান্তনা দেয়ার চেষ্টা করেছি এবং নগদ ২০ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে কোন ধরনের সমস্যায় পড়লে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পরিবারটিকে সহায়তার আশ্বাস প্রদান করা হয়েছে।