প্রকাশ: ৩০ জুলাই ২০২২, ২৩:৫৮
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলবাসীর স্বপ্নের পদ্মা সেতুতে যানবাহন চলাচল শুরুর পর এ অঞ্চলের মহাসড়কে যেন মৃত্যুর মিছিল শুরু হয়েছে। গত এক মাসে এ অঞ্চলের মহাসড়কে দুর্ঘটনায় নারী ও শিশুসহ ২৯ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত ৫৭ জন। বিশ্লেষকদের মতে, সরু সড়কে যানবাহনগুলোর অসুস্থ প্রতিযোগিতা, যাত্রীদের অসাবধানতা, মহাসড়কে অবৈধ যানবাহন, অদক্ষ চালক, প্রশিক্ষণের অভাব, ফিটনেসবিহীন যানবাহন দুর্ঘটনার প্রধান কারণ।
তাদের মতে, এমন পরিস্থিতিতে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের ভাঙ্গা থেকে পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটা পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়েসহ ফোর লেন সড়কে উন্নীত করার পাশাপাশি মহাসড়ক সিসি ক্যামেরার আওতায় নিয়ে আসা জরুরি। পাশাপাশি মহাসড়কের পাশের হাটবাজার, সড়কের উপর নির্মিত বাস ও পরিবহন কাউন্টার, থ্রি-হুইলারের স্ট্যান্ড নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নেয়া উচিত বলে মনে করেন তারা।
সূত্রমতে, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলবাসীর স্বপ্নের পদ্মা সেতুতে যানবাহন চলাচল শুরু হয়েছে গত ২৬ জুন। সেতু উদ্বোধনের পর দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন সড়কে যানবাহনের চাপ বেড়েছে কয়েক গুণ। কিন্তু বাড়েনি মহাসড়কগুলোর প্রশস্ততা। ফলে সরু রাস্তায় যানবাহন চলাচল করতে গিয়ে বাড়ছে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির সংখ্যা। পদ্মা সেতুতে যানবাহন চলাচল শুরুর পর গত ২৫ জুলাই পর্যন্ত দক্ষিণাঞ্চলের মহাসড়কে ছোট-বড় দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন নারী এবং শিশুসহ ২৯ জন। যার মধ্যে ২০ ও ২১ জুলাই ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে বড় দুটি দুর্ঘটনা ঘটেছে বাকেরগঞ্জ ও উজিরপুরে। ওই দুটি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ১২ জন। আহত হয়েছেন অন্তত ১২ জন। তাছাড়া যত দুর্ঘটনা ঘটেছে তার বেশির ভাগ বরিশাল জেলার সীমান্ত গৌরনদীর ভুরঘাটা থেকে বাকেরগঞ্জের লেবুখালীর মধ্যবর্তী স্থানে।
জানা গেছে, গত ২৪ জুলাই ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের সদর উপজেলার ছয়মাইল নামক এলাকায় যাত্রীবাহী বাস ও থ্রি-হুইলারের মুখোমুখি সংঘর্ষে অজ্ঞাত এক যাত্রী নিহত ও ৫ জন আহত হন। এর আগে গত ২১ জুলাই রাত সাড়ে ১০টার দিকে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের গৌরনদী উপজেলার খাঞ্জাপুর নামক এলাকায় বেপরোয়া গতির অজ্ঞাতনামা ট্রাকের চাপায় সাইফুল ইসলাম নামে এক মোটরসাইকেল চালক ঘটনাস্থলে নিহত হন। এ সময় আহত হন এক আরোহী। একই দিন দুপুর সোয়া ১২টার দিকে মহাসড়কের উজিরপুর উপজেলার নতুন শিকারপুর এলাকায় থামিয়ে রাখা মাইক্রোবাসকে মোল্লা ট্রাভেলসের একটি বাস ধাক্কা দিলে মাইক্রোবাসে থাকা কুয়াকাটার ছয় পর্যটকের মৃত্যু হয়। বাসযাত্রীসহ আহত হন অন্তত ১০-১২ জন।
২০ জুলাই একই মহাসড়কের বাকেরগঞ্জ উপজেলার ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের সামনে বিআরটিসি বাসের চাপায় ব্যাটারিচালিত ইজিবাইকের চালক, ১৮ মাসের এক শিশুসহ একই পরিবারের তিনজনসহ ৬ যাত্রী নিহত হন। এ ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন আরো একজন।
এর আগে গত ১৫ জুলাই ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের গৌরনদী মাহিলারা ইউনিয়ন পরিষদের সামনে পাজেরোর ধাক্কায় মো. আব্দুল মালেক (৬০) নামে এক ভ্যানচ্যালক নিহত হন। ১২ জুলাই সকাল পৌনে ৭টার দিকে একই মহাসড়কের গৌরনদী টরকি বাজারসংলগ্ন ব্রিজের উত্তর প্রান্তে বাস ও তেলের লরির মধ্যে সংঘর্ষে লরির চালক মোক্তার মোল্লা (৫০) নিহত হন। আহত হন বাসের ছয় যাত্রী।
গত ১১ জুলাই বিকালে উজিরপুরের নতুন শিকারপুর মহাসড়কে বাসচাপায় মৃত্যু হয় মো. আলমগীর (৫০) নামে এক ভ্যানচালকের। ৮ জুলাই গৌরনদীর পশ্চিম বেজহার এলাকায় দুর্ঘটনায় নিহত হন মোটরসাইকেল চালক আব্দুর রহমান (৩০)। ৬ জুলাই উজিরপুরের ইচলাদী টোল প্লাজা এলাকায় মোইক্রোবাসের চাপায় বেল্লাল হোসেন শেখ (৪০) নামে এক মোটরসাইকেল আরোহী নিহত হন। একই দিন গৌরনদীর খাঞ্জাপুরে দুই বাসের সংঘর্ষে ৩২ জন এবং বরিশালের কাশিপুর বাঁশতলা নামক এলাকায় বাস-ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে দুই জন আহত হয়েছেন। ২৫ জুন উজিরপুরের বামরাইলে বাস-কাভার্ড ভ্যান ও থ্রি-হুইলারের ত্রিমুখী সংঘর্ষে কাভার্ড ভ্যানচালক আবিদ আলীর (৪২) মৃত্যু হয়।
এদিকে বরিশাল জেলার বাইরেও কয়েকটি দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২০ জুলাই রাত ৯টার দিকে বরগুনার বেতাগী উপজেলার ঝোপখালী এলাকায় মোটরসাইকেলের ধাক্কায় দীপক হালদার (৫৫) নামে এক ব্যবসায়ীর মৃত্যু হয়। এর আগে ১৭ জুলাই বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়কের আমতলী উপজেলার শাঁখারিয়া এলাকায় যাত্রীবাহী বাস ও পণ্যবাহী ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে রিয়াদ (৩৫) নামের এক যুবক নিহত হন। এ ঘটনায় আহত হন কমপক্ষে সাতজন। ২ জুলাই মঠবাড়িয়া-ভাণ্ডারিয়া সড়কের তুষখালী কলেজসংলগ্ন সড়কে বাসচাপায় মো. জাহাঙ্গীর হোসেন ও মো. হিরন মিয়া নামে দুই গরু ব্যবসায়ী নিহত হন। এ ঘটনায় আহত হন আরো দুজন। ৬ জুলাই পিরোজপুর-ঢাকা মহাসড়কের নাজিরপুর উপজেলার শৈলদাহ এলাকায় বাসচাপায় আব্দুল্লাহ আল মামুন (৩২) নামে একজন স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা নিহত হন।
গত ২৯ জুন সকালে বরিশাল-স্বরূপকাঠি সড়কের নেছারাবাদ কুড়িয়ানা বাজার এলাকায় মোটরসাইকেলের ধাক্কায় পরিমল বেপারি (৪৫) নামে এক পথচারী নিহত হন। আহত হন মোটরসাইকেল আরোহী।
১৬ জুলাই ভোরে বরিশাল-পটুয়াখালী মহাসড়কের মৌকরণ ব্রিজের কাছে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাস খাদে পড়ে ২০ যাত্রী আহত হন। ১৬ জুলাই বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ভোলা-চরফ্যাশন সড়কের লালমোহন উপজেলার ডা. আজাহার উদ্দিন কলেজের কাছে বাসে উঠতে গিয়ে ছিটকে রাস্তায় পড়ে চিত্তরঞ্জন দাস (৬০) নামের এক বৃদ্ধ নিহত হয়েছেন।
ঢাকা-বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়কে হঠাৎ করে দুর্ঘটনার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় অনেকটা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন এ অঞ্চলের মানুষ। দাবি তুলেছেন নিরাপদ সড়কের। ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ বরিশালের আহ্বায়ক রুহুল আমিন বলেন, পদ্মা সেতু দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতির গতিসঞ্চার বাড়িয়েছে। সেতু উদ্বোধনের পর এই অঞ্চলে যানবাহনের চাপ কয়েক গুণ বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে অসুস্থ প্রতিযোগিতা। চালকরা কত দ্রুত বরিশাল থেকে ঢাকা বা ঢাকা থেকে বরিশালে পৌঁছাতে পারেন সেই প্রতিযোগিতা বেড়েছে। কিন্তু সড়ক প্রশস্ত হয়নি। বর্তমান সময়ে সড়ক দুর্ঘটনার এটি একটা বিশেষ কারণ।
তিনি আরো বলেন, দক্ষিণাঞ্চলের মহাসড়কে অবৈধ যানবাহন চলাচল করছে। যেমন বাকেরগঞ্জে ইজিবাইককে যে বিআরটিসি বাসটি চাপা দিয়েছে সেটা দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে মহাসড়কে চলাচল করে আসছিল। অথচ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। তিনি বলেন, বিআরটিএর নজরদারির অভাবে অবৈধ যানবাহন দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেশি বাড়িয়ে দিচ্ছে। তাই সড়ক-মহাসড়কে বিআরটিএর তদারকি জরুরি বলে মনে করেন নিরাপদ সড়কের এই সংগঠক।
সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) বরিশাল জেলার সভাপতি প্রফেসর শাহ্ সাজেদা বলেন, সড়কের তুলনায় ছোট যানবহনের সংখ্যা বেড়েছে। চালকরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নয়। বড় গাড়ি যারা চালায় তাদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সচেতনতার বিকল্প নেই বলেও মনে করেন তিনি।
এদিকে মহাসড়কে দুর্ঘটনা প্রতিরোধ এবং শৃঙ্খলা ফেরাতে কাজ করছে হাইওয়ে পুলিশ। চলতি মাসের ২২ দিনেই মহাসড়কে বিভিন্ন যানবহনে সড়ক পরিবহন আইনে ৩০০টি মামলা দিয়েছেন তারা। এর মধ্যে ২০০টি মামলা হয়েছে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালোনার কারণে। এর পরেও বেপরোয়া গতি থামছে না বলে জানিয়েছেন বরিশাল-ঢাকা মহাসড়কের গৌরনদী হাইওয়ে থানার ওসি শেখ মো. বেল্লাল হোসেন। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর মহাসড়কে যানবাহনের প্রতিযোগিতা বাড়ছে। এই প্রতিযোগিতা যে শুধু চালকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ সেটা কিন্তু না, যাত্রীদের মধ্যেও প্রতিযোগিতা বেড়েছে। কে কার আগে যাবে, আড়াই ঘণ্টা-তিন ঘণ্টায় গন্তব্যে পৌঁছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার মহাসড়কে যানবাহনের প্রতিযোগিতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। আর আমি মনে করে এটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা।
তিনি বলেন, পদ্মা সেতু উদ্বোধন হলেও দক্ষিণাঞ্চলের সড়ক-মহাসড়কের প্রশস্ততা বাড়েনি। তার মধ্যে যানবাহন কয়েক গুণ বেড়েছে। দুর্ঘটনা কমানোর পাশাপাশি সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে আমরা নিয়মিত স্পিডগান নিয়ে চেকপোস্ট বসাচ্ছি। আমাদের চেকপোস্ট দেখলে গাড়ির গতি কমে যায়। আবার চেকপোস্ট অতিক্রম করার পর পরই গতি বেড়ে যায়।