বাংলাদেশের চা শিল্পে ২০২৩ সালে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হলেও সদ্য বিদায়ী ২০২৪ সালে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হয়নি। গত বছর ১৬৮টি চা-বাগান ও ক্ষুদ্রায়তন চা-চাষিদের হাত ধরে ১০ কোটি ২৯ লাখ ১৮ হাজার কেজি চা উৎপাদিত হয়েছিল, যা চা শিল্পের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। কিন্তু ২০২৪ সালে উৎপাদনে নানা কারণে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। শ্রমিক অসন্তোষ, উৎপাদন খরচের বৃদ্ধি, বিরূপ আবহাওয়া এবং কাঙ্খিত দাম না পাওয়ার মতো সমস্যার কারণে চায়ের উৎপাদন কমে গেছে।
২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত, দেশের ১৬৯টি চা বাগানে মাত্র ৮ কোটি ৬৬ লাখ ৫১ হাজার কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে। যদিও ডিসেম্বর মাসে উৎপাদনের পরিমাণ কিছুটা বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে, তবুও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২ কোটি ১২ লাখ ৬৯ হাজার কেজি চা উৎপাদন কম হবে। চা বোর্ডের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশীয় চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০ কোটি ৮০ লাখ কেজি, কিন্তু জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ৭ কোটি ৬৬ লাখ কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের উৎপাদনের হিসাব জানুয়ারি পর্যন্ত চূড়ান্ত না হওয়া সত্ত্বেও, লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এখনো একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে চায়ের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। সার, সেচ এবং কীটনাশকের মূল্য বৃদ্ধির পাশাপাশি শ্রমিকদের ধর্মঘট এবং উৎপাদনে বিরূপ আবহাওয়ার কারণে চা শিল্পে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। বিশেষ করে গ্রীষ্মকালে তীব্র খরা এবং অতিরিক্ত তাপমাত্রা চা গাছের জন্য অনুকূল ছিল না, যার ফলে উৎপাদন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একদিকে উৎপাদন কমে গেছে, অন্যদিকে উৎপাদন খরচও বেড়েছে, যার ফলে বাগান মালিকদের জন্য লোকসানের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
এই পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে ন্যাশনাল টি কোম্পানির (এনটিসি) বাগানগুলোতে। শ্রমিকদের বকেয়া বেতন আদায়ের জন্য দীর্ঘসময় ধর্মঘট চলায় উৎপাদন কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। এনটিসি চা বাগানগুলোর ১২টি বাগান দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল। এসব সমস্যার সমাধান না হলে চা শিল্পের ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কা তৈরি হবে, এমনটাই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এছাড়া, চায়ের গড় দাম বাড়লেও উৎপাদন খরচের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। গত বছর এক কেজি চায়ের উৎপাদন খরচ ছিল ২২৬ টাকা, কিন্তু এবছর চায়ের উৎপাদন খরচ বেড়ে ২০০ থেকে ২২০ টাকায় পৌঁছেছে। সেই তুলনায় নিলামে চায়ের গড় দাম ১৮০ থেকে ২০০ টাকার মধ্যে ছিল, যার কারণে বাগান মালিকদের লাভের পরিমাণ কমে গেছে।
বাংলাদেশ চা গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক ড. ইসমাইল হোসেন জানান, ২০২৪ সালে চায়ের উৎপাদন কম হওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে এনটিসি চা বাগানগুলোতে শ্রমিক অসন্তোষ এবং উত্তরবঙ্গের বাগানগুলোতে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি হয়েছে। উত্তরবঙ্গের বাগানগুলোতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং খরার কারণে উৎপাদন কমেছে। তবে তিনি আশাবাদী যে, বাকি বাগানগুলোর উৎপাদন হিসাব পাওয়া গেলে পরিস্থিতির পরিপূর্ণ চিত্র পাওয়া যাবে।
সরকারি মালিকানাধীন ন্যাশনাল টি কোম্পানির (এনটিসি) ইন্ডিপেন্ডেন্ট ডিরেক্টর মহসিন মিয়া মধু বলেন, "চায়ের উৎপাদন খরচ অব্যাহতভাবে বাড়ছে, যা বাগান মালিকদের জন্য অস্বস্তিকর। যদি উৎপাদন খরচ এবং বিক্রির দাম না বাড়ে, তবে চা শিল্পে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে।"
চা শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই সংকট কাটিয়ে উঠতে হলে সরকার এবং সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। বিশেষ করে শ্রমিক অসন্তোষ সমাধান, উৎপাদন খরচ কমানো এবং চায়ের বাজারমূল্যের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য কার্যকর নীতি গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে উন্নত প্রযুক্তি ও গবেষণার মাধ্যমে চা উৎপাদনের খরচ কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া জরুরি।
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।