ইসলামে কি কোনো পোশাক নির্ধারিত আছে?

নিজস্ব প্রতিবেদক
ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: বুধবার ৭ই জুন ২০২৩ ১১:২৫ পূর্বাহ্ন
ইসলামে কি কোনো পোশাক নির্ধারিত আছে?

ইসলামি শরিয়ত মুসলমানদের জন্য নির্দিষ্ট কোনো মাপ বা আকৃতির পোশাক আবশ্যক করেনি। হজরত ইদরিস আলাইহিস সালামের সময় থেকে পোশাক হিসাবে কাপড়ের বুনন ও ব্যবহার শুরু হয়েছে। স্থান, কাল, পাত্রভেদে যে কোনো শালিন পোশাকই ইসলামে বৈধ। পোশাকের ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় বাড়াবাড়িও ইসলামে কাম্য নয়। মানুষকে কেমন পোশাক পরবে এর একটি ঘোষণা এসেছে কোরআনে-


یٰبَنِیۡۤ اٰدَمَ قَدۡ اَنۡزَلۡنَا عَلَیۡکُمۡ لِبَاسًا یُّوَارِیۡ سَوۡاٰتِکُمۡ وَ رِیۡشًا ؕ وَ لِبَاسُ التَّقۡوٰی ۙ ذٰلِکَ خَیۡرٌ ؕ ذٰلِکَ مِنۡ اٰیٰتِ اللّٰهِ لَعَلَّهُمۡ یَذَّکَّرُوۡنَ


‘হে আদাম সন্তান! আমি তোমাদের পোশাক-পরিচ্ছদ দিয়েছি তোমাদের লজ্জাস্থান আবৃত করার জন্য এবং শোভা বর্ধনের জন্য। আর তাকওয়ার পোশাক হচ্ছে সর্বোত্তম পোশাক। ওটা আল্লাহর নিদর্শনসমূহের মধ্যে একটি; যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে।’ (সুরা আরাফ : ২৬)


আল্লাহ তাআলা এ আয়াতে আদম সন্তানকে সম্বোধন করে বলেছেন, তোমাদের পোষাক আল্লাহ তাআলার একটি মহান নেয়ামত। একে যথার্থ মূল্য দাও। এখানে শুধু মুসলিমদের সম্বোধন করা হয়নি- বরং সমগ্র বনি আদমকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে। এতে ইঙ্গিত রয়েছে যে, গুপ্তাঙ্গ আচ্ছাদন ও পোষাক মানব জাতির একটি সহজাত প্রবৃত্তি ও প্রয়োজন। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সবাই এ নিয়ম পালন করে। এরপর পোশাকের বিশদ বিবরণে তিন প্রকারের পোশাকের কথা বলা হয়েছে। তাহলো-


১. (لِبَاسًا يُوَارِي سَوْآتِكُمْ) এখানে يُوَارِي শব্দটি موارة থেকে উদ্ভুত, এর অর্থ আবৃত করা। মানুষের ঐসব অঙ্গ, যেগুলো খোলা রাখাকে মানুষ স্বভাবতই খারাপ ও লজ্জাকর মনে করে। উদ্দেশ্য এই যে, আমি তোমাদের মঙ্গলার্থে এমন একটি পোষাক সৃষ্টি করেছি, যা দ্বারা তোমরা গুপ্তাঙ্গ আবৃত করতে পারো। হজরত মুজাহিদ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, আরবের কিছু লোক আল্লাহর ঘরের তওয়াফ উলঙ্গ হয়ে সম্পাদন করতো। আবার কোনো কোনো লোক যে পোশাক পরে তওয়াফ করেছে সে পোষাক আর পরতো না। এ আয়াতে তাদেরকেও উদ্দেশ্য নেওয়া হয়েছে। (তাবারি)


২. ওয়ারিশা (وَرِيشًا) অৰ্থাৎ সাজ-সজ্জার জন্য মানুষ যে পোষাক পরে। গুপ্তাঙ্গ আবৃত করার জন্য তো সংক্ষিপ্ত পোষাকই যথেষ্ট হয়; কিন্তু আমি তোমাদের আরও পোষাক দিয়েছি, যাতে তোমরা তা দ্বারা সাজ-সজ্জা করে বাহ্যিক দেহাবয়বকে সুশোভিত করতে পার। হজরত ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, এখানে ‘রীশ’ বলে ‘সম্পদ' বোঝানো হয়েছে। (তাবারি) আর বাস্তবিকই পোষাক একটি গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান সম্পদ।


৩. আল্লাহ তাআলা এ আয়াতে তৃতীয় এক প্রকার পোশাকের কথা উল্লেখ করে বলেছেন- (وَلِبَاسُ التَّقْوَىٰ ذَٰلِكَ خَيْرٌ) তা হচ্ছে তাকওয়ার পোশাক আর এটিই সর্বোত্তম পোশাক। হজরত ইবন আব্বাস ও উরওয়া ইবন যুবাইর রাদিয়াল্লাহু আনহুমের তাফসির অনুযায়ী তাকওয়ার পোশাক বলে সৎকর্ম ও আল্লাহভীতি বোঝানো হয়েছে। এটি মানুষের চারিত্রিক দোষ ও দুর্বলতার আবরণ এবং স্থায়ী কষ্ট ও বিপদাপদ থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায়। এ কারণেই এটি সর্বোত্তম পোশাক। হজরত কাতাদাহ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, তাকওয়ার পোশাক বলে ঈমানকে বোঝানো হয়েছে। (তাবারি)


(৩) অর্থাৎ মানুষকে এ তিন প্রকার পোষাক দান করা আল্লাহ্ তা'আলার শক্তির নিদর্শনসমূহের অন্যতম- যাতে মানুষ এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে।


ইসলামে পোশাক পরার মূল উদ্দেশ্য


পোশাক পরতে হবে মানুষের সতরকে আবৃত করে রাখার জন্য। যেমন, পুরুষের সতর হচ্ছে- নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত। আর নারীর সতর হচ্ছে- নারীদের পরিবেশে বুক থেকে হাঁটু পর্যন্ত এবং বাইরের পরিবেশে দু-হাতের তালু ও মুখমণ্ডল ছাড়া পুরো দেহ। এটা ঢেকে রাখা ফরজ। সুতরাং যে পোশাক মানুষের সতর (লজ্জাস্থান) আবৃত করে না, তা কখনও পোশাক হতে পারে 

মানবসভ্যতার জনক হজরত আদম আলাইহিস সালামের সময় থেকেই পোশাকের ব্যবহার ছিল। আদি মানবরা পোশাক হিসাবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে পশুচর্ম ব্যবহার করতো। তাদের সম্পর্কে নগ্নতা ও অসভ্যতার যে ধারণা প্রচলিত রয়েছে, তা সম্পূর্ণ অমূলক।


পোশাক হিসাবে কাপড়ের বুনন ও ব্যবহার শুরু হয়েছে হজরত ইদরিস আলাইহিস সালামের যুগ থেকে। বর্ণিত রয়েছে- هو اول من خاط الثياب و لبيسة ‘হুওয়া (ইদরিস) আওয়ালু মান খাতাস ছিয়াবা ওয়া লাবিসাহ’ অর্থাৎ ‘প্রথম হজরত ইদরিস আলাইহিস সালামই কাপড় সেলাই করেন এবং পরিধান করেন।’


উল্লেখ্য, ত্রয়োদশ শতকে মুসলিম বিজয়ের পর বাংলার পোশাক ও সংস্কৃতিতে মৌলিক পরিবর্তন আসে। এক সময় এ অঞ্চলের পুরুষরা প্রিয় পোশাক হিসাবে সেলাই করা লুঙ্গি, পায়জামা, পাঞ্জাবি, ধুতি ও নারীরা শাড়ি ও ব্লাউজের ব্যবহারে প্রাধান্য দেয়। আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এ দেশের পুরুষরা পশ্চিমা রীতির অনুসরণে শার্ট, প্যান্ট, স্যুট ও টাই পরা শুরু করে। অন্যদিকে নারীরা শাড়ির পরিবর্তে আরবীয় ধরনের ফ্রক, সালোয়ার-কামিজ ও অন্যান্য ডিজাইনের পোশাকের প্রতি ঝুঁকে পড়ে। পোশাকের পরিবর্তনের এ ধারা বর্তমানে আরও বেশি গতিশীল।


পোশাক-পরিচ্ছদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে ধর্ম ও জাতীয়তার গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এ অঞ্চলে ধর্মীয় ঐতিহ্যের কারণে হিন্দুরা ধুতি, পৈতা পরে। খ্রিষ্টানরা ক্রুসচিহ্নিত পোশাক পরে। বৌদ্ধরা গেরুয়া কাপড়ের পোশাক পরে। আর মুসলিমরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে লুঙ্গি, পায়জামা, পাঞ্জাবি, জুব্বা, টুপি ও পাগড়ি পরে থাকে। বিশেষত উপমহাদেশে মুসলিমদের এ পোশাককে সাধারণ ইসলামি পোশাক মনে করা হলেও বাস্তবে চূড়ান্ত কথা হলো ধর্মের নির্ধারিত কোনো পোশাক নেই।


মনে রাখতে হবে


পোশাক-পরিচ্ছদের ব্যাপারে ইসলাম যেমন উদারতার পরিচয় দিয়েছে, তেমনি কিছু মূলনীতিও নির্ধারণ করে দিয়েছে, যা সভ্যতা, শালীনতা রক্ষায় একান্ত প্রয়োজন। ইসলামের এ মূলনীতিগুলো পালন করে নারী-পুরুষের জন্য যে কোনো পোশাকই পরিধান করা অনুমোদনযোগ্য। পোশাক পরা প্রসঙ্গে এই হলো ইসলামের ব্যাপকতর গ্রহণযোগ্য নীতি। বর্তমান সময়ের এত বৈচিত্র্যের মধ্যেও পোশাকে ঐক্য থাকবে শুধু আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের দিকনির্দেশনা পালনের জন্য এবং ইসলামি শরিয়ত প্রদত্ত সতর ঢাকার শর্তগুলো মেনে চলার মধ্যেই পোশাকের ব্যবহার করতে হবে।