ইসলামে মেরাজ একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রেসালাতের অনেক বড় একটি মুজেজা। উম্মতে মুহাম্মাদিসহ বিশ্ববাসীর জন্য অনেক বড় একটি শিক্ষণীয় ঘটনা ও নেয়ামত। নবিজীর মেরাজে কী ঘটেছিল? এ সম্পর্কে হাদিসে কী এসেছে?
নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মেরাজ সম্পর্কে বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ তাআলা কোরআনুল কারিমে ঘোষণা করেন-
سُبۡحٰنَ الَّذِیۡۤ اَسۡرٰی بِعَبۡدِهٖ لَیۡلًا مِّنَ الۡمَسۡجِدِ الۡحَرَامِ اِلَی الۡمَسۡجِدِ الۡاَقۡصَا الَّذِیۡ بٰرَکۡنَا حَوۡلَهٗ لِنُرِیَهٗ مِنۡ اٰیٰتِنَا ؕ اِنَّهٗ هُوَ السَّمِیۡعُ الۡبَصِیۡ
‘পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাতের বেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত। যার চারদিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি, যাতে (সে রাতে) আমি তাকে কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দেই। নিশ্চয়ই তিনি পরম শ্রবণকারী ও দর্শনশীল।’ (সুরা ইসরা : আয়াত ১)
নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়ত লাভের ১১তম বছরের কোনো এক রাতে মেরাজ সংঘঠিত হয়েছিল। অনেকে ২৬ রজব দিবাগত রাতের কথা বলে থাকেন। সে হিসেবে আজ সেই ঐতিহাসিক রাত। মেরাজ ছিল তৎকালিন সময়ের সেরা আলোড়ন সৃষ্টিকারী শ্রেষ্ঠ মুজেজা। যা আজও ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য শ্রেষ্ঠ সত্যায়ন।
মেরাজের আশ্চর্যজনক ও তৎপর্যপূর্ণ ঘটনায় বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সম্মান ও উচ্চ মর্যাদাই প্রকাশ পেয়েছে। মেরাজের এ ঘটনায় বিশ্বাস স্থাপন করা প্রতিটি মুসলমানের জন্য তার আক্বিদা-বিশ্বাসের অংশও বটে। মেজারে ঘটনায় মুসলিম উম্মাহর জন্য রয়েছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।
তবে নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মেরাজ, মেরাজের বাহন ইত্যাদি নিয়ে অনেক বই-ছবি প্রণীত হয়েছে। যার মধ্যে করা হয়েছে অনেক বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ি। যার কোনোটিই কাম্য নয়। যা মানুষকে বিভ্রান্তির দিকে নিয়ে যায়। মেরাজের সঠিক তথ্য ও ইতিহাস থেকে বঞ্চিত হয় ঈমানদার মুমিন মুসলমান। সে কারণে মেরাজ সম্পর্কিত হাদিসের সুস্পষ্ট কিছু বর্ণনা তুলে ধরা হলো-
হজরত মালিক ইবনু সাসা রাদিয়াল্লাহু আনহু বণৃনা করেন আল্লাহর নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে রাতে তাকেঁ ভ্রমণ করানো হয়েছে সে রাতের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন-
এক সময় আমি কাবা ঘরের হাতিমের অংশে ছিলাম। কখনো কখনো রাবী (কাতাদাহ) বলেছেন, হিজরে শুয়েছিলাম। হঠাৎ একজন আগন্তুক আমার কাছে এলেন এবং আমার এ স্থান থেকে সে স্থানের মাঝের অংশটি (হলকুমের নিচ থেকে নাভি পর্যন্ত) চিরে ফেললেন।
তারপর আগন্তুক (হজরত জিবরিল আমিন) আমার হৃদপিণ্ড বের করলেন। তারপর আমার কাছে একটি সোনার পাত্র আনা হল যা ঈমানে পরিপূর্ণ ছিল। তারপর আমার হৃদপিন্ডটি ধৌত করা হল এবং ঈমান দ্বারা পরিপূর্ণ করে যথাস্থানে আবার রেখে দেয়া হল।
তারপর সাদা রং এর একটি জন্তু আমার কাছে আনা হল। যা আকারে খচ্চর হতে ছোট ও গাধা হতে বড় ছিল। জারুদ তাকে বলেন, হে আবূ হামযা, এটাই কি বুরাক? আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘হ্যাঁ’।
সে একেক কদম রাখে দৃষ্টির শেষ সীমায়। আমাকে তার উপর সওয়ার করানো হল। তারপর আমাকে নিয়ে জিবরিল আলাইহিস সালাম চললেন।
প্রথম আসমানে গমন
প্রথম আসমানে নিয়ে এসে (জিবরিল) দরজা খুলে দিতে বললেন, জিজ্ঞাসা করা হল, ইনি কে? তিনি বললেন, জিবরিল। আবার জিজ্ঞাসা করা হল, আপনার সঙ্গে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। আবার জিজ্ঞাসা করা হল, তাঁকে কি ডেকে পাঠান হয়েছে? তিনি বললেন, ‘হ্যা’। তখন বলা হল, মারহাবা, উত্তম আগমনকারীর আগমন হয়েছে। তারপর আসমানের দরজা খুলে দেয়া হল। আমি যখন (প্রথম আসমানে) পৌঁছলাম, তখন সেখানে আদম আলাইহিস সালাম-এর দেখা পেলাম। জিবরিল আলাইহিস সালাম বললেন, ইনি আপনার আদি পিতা আদম আলাইহিস সালাম, তাঁকে সালাম করুন। আমি তাঁকে সালাম করলাম। তিনি সালামের জবাব দিলেন এবং বললেন, নেক্কার পুত্র ও নেক্কার নবীর প্রতি খোশ আমদেদ।
২য় আসমানে গমন
তারপর (সেখান থেকে) উপরের দিকে চলে দ্বিতীয় আসমানে পৌঁছে (জিবরিল) দরজা খুলে দিতে বললেন, জিজ্ঞাসা করা হল কে? তিনি বললেন, জিবরিল। আবার জিজ্ঞাসা করা হল, আপনার সঙ্গে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। জিজ্ঞাসা করা হল, তাঁকে কি ডেকে পাঠানো হয়েছে? তিনি উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ’। তারপর বলা হল - মারহাবা! উত্তম আগমনকারীর আগমন ঘটেছে।
তারপর (দ্বিতীয় আসমানের দরজা) খুলে দেয়া হল। সেখানে পৌঁছলাম তখন সেখানে ইয়াহ্ইয়া ও ‘ঈসা আলাইহিস সালাম-এর দেখা পেলাম। তাঁরা দুই জন ছিলেন একে অপরের খালাত ভাই। তিনি (জিবরিল) বললেন, এরা হলেন, ইয়াহ্ইয়া ও ঈসা আলাইহিস সারাম। তাদের প্রতি সালাম করুন। তখন আমি সালাম করলাম। তাঁরা জবার দিলেন, তারপর বরলেন, নেক্কার ভাই ও নেক্কার নবীর প্রতি খোশ আমদেদ।
৩য় আসমানে গমন
এরপর (সেখান থেকে) তিনি আমাকে নিয়ে তৃতীয় আসমানের দিকে চললেন, সেখানে পৌঁছে জিবরিল বললেন, খুলে দাও। তাঁকে বলা হল কে? তিনি উত্তর দিলেন, জিবরিল। জিজ্ঞাসা করা হল আপনার সঙ্গে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। জিজ্ঞাসা করা হল, তাঁকে কি ডেকে পাঠানো হয়েছে? তিনি উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ’। বলা হল, তাঁর জন্য খোশ-আমদেদ। উত্তম আগমনকারীর আগমন হয়েছে।
তারপর (দ্বিতীয় আসমানের) দরজা খুলে দেয়া হল। আমি সেখানে পৌঁছে ইউসুফ আলাইহিস সালামকে দেখতে পেলাম। জিবরিল বললেন, ইনি ইউসুফ আলাইহিস সালাম। আপনি তাঁকে সালাম করুন। আমি তাঁকে সালাম করলাম, তিনিও জবাব দিলেন এবং বললেন, নেক্কার ভাই, নেক্কার নবীর প্রতি খোশ-আমদেদ।
৪র্থ আসমানে গমন
তারপর জিবরিল আলাইহিস সালাম আমাকে নিয়ে উপর দিকে চললেন এবং চতুর্থ আসমানে পৌঁছলেন। আর দরজা খুলে দিতে বললেন। জিজ্ঞাসা করা হল, আপনি কে? তিনি বললেন, জিবরিল। জিজ্ঞাসা করা হল, আপনার সঙ্গে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। জিজ্ঞাসা করা হল, তাঁকে কি ডেকে পাঠানো হয়েছে? তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ’। তখন বলা হল, তাঁর প্রতি মারহাবা। উত্তম আগমনকারীর আগমন ঘটেছে।
তারপর (৪র্থ আসমানের দরজা) খুলে দেয়া হল। আমি (সেখানে) ইদরিস আলাইহিস সালাম- এর কাছে পৌঁছলে জিবরিল বললেন, ইনি ইদরিস আলাইহিস সালাম। তাকেঁ সালাম করুন। আমি তাঁকে সালাম করলাম। তিনিও জবাব দিলেন। তারপর বললেন, নেক্কার ভাই ও নেক্কার নবীর প্রতি মারহাবা।
৫ম আসমানে গমন
এরপর তিনি আমাকে নিয়ে উপর দিকে গিয়ে পঞ্চম আসমানে পৌঁছে দরজা খুলতে বললেন। জিজ্ঞাসা করা হল আপনি কে? তিনি বললেন, জিবরিল। জিজ্ঞাসা করা হল, আপনার সঙ্গে কে? তিনি উত্তর দিলেন, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। জিজ্ঞাসা করা হল, তাঁকে কি ডেকে পাঠানো হয়েছে? তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ’। বলা হল, তাঁর প্রতি মারহাবা। উত্তম আগমনকারীর আগমন হয়েছে।
সেখানে পৌঁছে হারূন আলাইহিস সালামকে পেলাম। জিবরিল বললেন, ইনি হারূন আলাইহিস সালাম তাঁকে সালাম করুন। আমি তাঁকে সালাম করলাম; তিনিও জবাব দিলেন, এবং বললেন, নেক্কার ভাই ও নেক্কার নবীর প্রতি মারহাবা।
৬ষ্ঠ আসমানে গমন
তারপর আমাকে নিয়ে যাত্রা করে ষষ্ঠ আকাশে পৌঁছে দরজা খুলতে বললেন। জিজ্ঞাসা করা হল, আপনি কে? তিনি বললেন, জিবরিল। জিজ্ঞাসা করা হল, আপনার সঙ্গে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। প্রশ্ন করা হল, তাকে কি ডেকে পাঠানো হয়েছে? তিনি বললেন, ‘হ্যা’। ফেরেশ্তা বললেন, তার প্রতি মারহাবা। উত্তম আগন্তুক এসেছেন।
সেখানে পৌঁছে আমি মূসা আলাইহিস সালামকে পেলাম। জিবরিল আলাইহিস সালাম বললেন, ইনি মূসা আলাইহিস সালাম। তাঁকে সালাম করুন। আমি তাঁকে সালাম করলাম। তিনি জবাব দিলেন এবং বললেন, নেক্কার ভাই ও নেক্কার নবির প্রতি মারহাবা।
মুসা আলাইহি সালামের কান্না
(সেখান থেকে) আমি যখন অগ্রসর হলাম তখন তিনি (মুসা আলাইহিস সালাম) কেঁদে ফেললেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হল, আপনি কিসের জন্য কাঁদছেন? তিনি বললেন, আমি এজন্য কাঁদছি যে, আমার পর একজন যুবককে নবি বানিয়ে পাঠানো হয়েছে, যাঁর উম্মত আমার উম্মত হতে অধিক সংখ্যায় জান্নাতে প্রবেশ করবে।
সপ্তম আসমানে গমন
তারপর জিবরিল আলাইহিস সালাম আমাকে নিয়ে সপ্তম আকাশের দিকে গেলেন এবং দরজা খুলে দিতে বললেন, জিজ্ঞাসা করা হল এ কে? তিনি উত্তর দিলেন, আমি জিবরিল। আবার জিজ্ঞাসা করা হল, আপনার সাথে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। জিজ্ঞাসা করা হল, তাকে ডেকে পাঠানো হয়েছে কি? তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ’। বলা হল, তাঁর প্রতি মারহাবা। উত্তম আগমনকারীর আগমন হয়েছে।
আমি সেখানে পৌঁছে ইবরাহিম আলাইহিস সালামকে দেখতে পেলাম। জিবরিল আলাইহিস সালাম বললেন, ইনি আপনার পিতা তাঁকে সালাম করুন। আমি তাঁকে সালাম করলাম। তিনি সালামের জবাব দিলেন এবং বললেন, নেক্কার পুত্র ও নেক্কার নবির প্রতি মারহাবা।
সিদরাতুল মুনতাহায় গমন
[‘সিদরাহ’ শব্দের অর্থ কূল বৃক্ষ আর ‘মুনতাহা’ শব্দের অর্থ শেষসীমা। পৃথিবী হতে উর্ধ্বলোকে উপনীত হয়ে তা ওখানে গিয়েই থেমে পড়ে।তারপর তার অপর পাড়ে যাঁরা রয়েছেন তাঁরা সেখান হতে তা গ্রহণ করে উপরে নিয়ে যান। শেষ সীমায় চিহ্নস্বরূপ ঐ স্থানটাতে একটা কূল বৃক্ষ থাকায় ঐ সীমান্ত চিহ্নকে ‘সিদরাতুল মুনতাহা’ বলা হয়।]
তারপর আমাকে সিদ্রাতুল মুনতাহা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হল। (সেখানে) দেখতে পেলাম, তার ফল ‘হাজার’ অঞ্চলের মটকার ন্যায় এবং তার পাতাগুলি হাতির কানের মত। আমাকে বলা হল, এ হল সিদরাতুল মু্নতাহা।
বিশেষ নহর পরিদর্শন
সেখানে আমি চারটি নহর দেখতে পেলাম। যাদের দুইটি ছিল অপ্রকাশ্য আর দুইটি ছিল প্রকাশ্য। তখন আমি জিব্রাঈল আলাইহিস সালামকে জিজ্ঞাসা করলাম, এ নহরগুলি কী? তিনি বললেন, অপ্রকাশ্য, দুইটি হল জান্নাতের দুইটি নহর। আর প্রকাশ্য দুইটি হল নীল নদী ও ফুরাত নদী।
বায়তুল মামুর দেখা
তারপর আমার সামনে ‘আল-বায়তুল মামুর’ প্রকাশ করা হল, এরপর আমার সামনে (৩টি পাত্র পরিবেশন করা হলো)-
১. একটি শরাবের পাত্র,
২. একটি দুধের পাত্র ও
৩. একটি মধুর পাত্র রাখ হল।
আমি দুধের পাত্রটি গ্রহণ করলাম। তখন জিবরিল বললেন, এটিই হচ্ছে ফিতরাত। আপনি ও আপনার উম্মতগণ এর উপর প্রতিষ্ঠিত।
৫০ নামাজকে ৫ ওয়াক্তে সাব্যস্ত করার ঘটনা
তারপর আমার উপর দৈনিক ৫০ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করা হল। এরপর আমি ফিরে আসলাম। মুসা আলাইহিস সালাম-এর সম্মুখ দিয়ে যাওয়ার সময় তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন- আল্লাহ তাআলা আপনাকে কী আদেশ করেছেন?রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমাকে দৈনিক ৫০ ওয়াক্ত নামাজের আদেশ দেয়া হয়েছে।
তিনি বললেন, আপনার উম্মত দৈনিক ৫০ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতে সমর্থ হবে না। আল্লাহর কসম! আমি আপনার আগে লোকদের পরীক্ষা করেছি এবং বনি ইসরাইলদের হেদায়াতের জন্য কঠোর শ্রম দিয়েছি। তাই আপনি আপনার প্রতিপালকের কাছে ফিরে যান এবং আপনার উম্মতের (বোঝা) হালকা করার জন্য আরজ করুন।
আমি ফিরে গেলাম। ফলে আমার উপর হতে দশ (ওয়াক্ত) কমানো হলো। আমি আবার মূসা আলাইহিস সালামের কাছে ফিরে এলাম। তিনি আবার আগের মত বললেন।আমি আবার ফিরে গেলাম। ফলে আল্লাহ তা’আলা আরও দশ (ওয়াক্ত) কমিয়ে দিলেন। ফেরার পথে মূসা আলাইহিস সালামের কাছে পৌঁছলে, তিনি আবার আগের কথা বললেন।
আমি আবার ফিরে গেলাম। আল্লাহ তাআলা আরো দশ ওয়াক্ত কমিয়ে দিলেন। আমি মূসা আলাইহিস সালামের কাছে ফিরে এলাম। তিনি আবারও একই কথা বললেন।আমি আবার ফিরে গেলাম। তখন আমাকে প্রতিদিন দশ ওয়াক্ত নামাজ আদায়ের আদেশ দেয়া হয়। আমি ফিরে এলাম। মূসা আলাইহিস সালাম ঐ কথাই আগের মত বললেন।
আমি আবার ফিরে গেলাম, তখন আমাকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আদেশ করা হয়। তারপর মূসা আলাইহিস সালাম কাছে ফিরে এলাম। তিনি বললেন, আপনাকে কী আদেশ দেয়া হয়েছে? আমি বললাম, আমাকে দৈনিক পাঁচবার নামাজ আদায়ের আদেশ দেয়া হয়েছে।
মূসা আলাইহিস সালাম বললেন, আপনার উম্মত দৈনিক পাঁচবার নামাজ আদায় করতেও সামর্থ হবে না। আপনার আগে আমি লোকদের পরীক্ষা করেছি। বনি ইসরাইলদের হেদায়াতের জন্য কঠোর শ্রম দিয়েছি। আপনি আপনার রবের কাছে ফিরে যান এবং আপনার উম্মতের জন্য আরো সহজ করার আরজি পেশ করুন।রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমি আমার রবের কাছে আরজি করেছি, এতে আমি লজ্জাবোধ করছি। আর আমি এতেই সন্তুষ্ট হয়েছি এবং তা মেনে নিয়েছি।
তারপর তিনি বললেন, আমি যখন (মুসা আলাইহিস সালাম থেকে বিদায় গ্রহণ করে সামনের দিকে) অগ্রসর হলাম, তখন এক ঘোষণাকারী ঘোষণা দিলেন- ‘আমি আমার অবশ্য প্রতিপাল্য নির্দেশ জারি করে দিলাম এবং আমার বান্দাদের উপর হালকা করে দিলাম।’ (বুখারি)
মেরাজের অন্যান্য ঘটনা
হাদিসের আলোকে এটি ছিল বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মেরাজের সংক্ষিপ্ত চিত্র। এ সফরে বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো অনেক কিছু নিজ চোখে দেখেছেন। বিভিন্ন হাদিসে তিনি তা বর্ণনা করেছেন।
এ রাতে বিশ্বনবি জাহান্নাম পরিদর্শনে গেলে মালেক নামক জাহান্নামের প্রধান রক্ষী নবীজীকে সালাম ও অভ্যর্থনা জানান। (মুসলিম)
এমন এক দল লোকের পাশ দিয়ে নবীজী গমন করেছিলেন, যাদের নখ ছিল তামার। এই নখ দ্বারা তারা স্বীয় মুখম-ল ও বক্ষ আচঁড়াচ্ছিল। এদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে জিবরীল নবীজীকে জানালেন, এরা সেই লোক, যারা দুনিয়াতে মানুষের গোশত ভক্ষণ করত। অর্থাৎ একে অপরের গীবত ও মানহানি করত। অন্য এক বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, বরং দুনিয়াতে গীবতকারী এসব লোকদেরকে মৃত ভক্ষণ করতে দেখেছিলেন নবীজী। (মুসনাদে আহমাদ)
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জান্নাত দেখার সৌভাগ্যও লাভ করেছিলেন। (তিরমিজি)
নবীজী জান্নাতে প্রবেশ করে একপাশে একটি হালকা আওয়াজ শুনতে পেলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, এটা কিসের আওয়াজ? জিবরিল বললেন, মুয়াযযিন বেলালের কণ্ঠ। মিরাজ থেকে ফিরে নবীজী সাহাবায়ে কেরামের উদ্দেশে বললেন, বেলাল সাফল্য অর্জন করেছে, আমি তার জন্য এমন সব মর্তবা দেখেছি। (মুসনাদে আহমাদ)
বিভিন্ন বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বায়তুল মাকদিসে যাওয়া বা আসার পথে মক্কার কুরাইশদের বাণিজ্য কাফেলাও দেখতে পেয়েছিলেন। (মুসান্নেফে ইবনে আবি শায়বা)
শবে মিরাজের সকাল বেলা। নবীজী হাতীমে কাবায় চিন্তিত মন নিয়ে একান্তে বসে আছেন। মনে মনে ভাবছেন, রাত্রে সংঘটিত মিরাজ ও ইসরার কথা প্রকাশ করলে মানুষ আমাকে মিথ্যুক বলে অভিহিত করবে নাতো? ইতিমধ্যে কাছ দিয়ে যাচ্ছিল আবু জাহল। নবীজীর কাছে বসে বিদ্রোপের ছলে বলল, কোনো ব্যাপার আছে নাকি?
নবীজী বললেন, ‘হ্যাঁ’। সে বলল কী? তিনি জবাব দিলেন, আজ রাতে আমার মেরাজ হয়েছে। সে বিস্ময়ের সাথে জানতে চাইলো, কতদূর পর্যন্ত যাওয়া হয়েছিল?
নবীজী বললেন, বায়তুল মাকদিস পর্যন্ত। সে আরও ঠাট্টা করে বলে উঠল, চমৎকার তো! এরপর সকালেই তুমি আমাদের কাছে এসে গেলে?তিনি দৃঢ়তার সাথে বললেন, ‘হ্যাঁ’। এরপর আবু জাহল কথা না বাড়িয়ে তাঁকে বলল, আচ্ছা! আমি যদি পুরো কওমকে ডেকে নিয়ে আসি তাহলেও কি তুমি একই কথা বলতে পারবে? নবীজী আরও সুদৃঢ় হয়ে বললেন, অবশ্যই।
আবু জাহল লুয়াই ইবনে কা’ব গোত্রের নাম ধরে ডাকতে লাগল। আর তারাও দলে দলে খানায়ে কাবায় সমবেত হতে লাগল। সকলে এসে উপস্থিত হলে আবু জাহল বলল, আমাকে যা কিছু তুমি শুনিয়েছিলে, পারলে তা এদের কাছেও ব্যক্ত করো।নবীজী পুনরায় একই ঘটনা তাদের সম্মুখে ব্যক্ত করলে কিছু লোক বিস্ময়ে হাতের উপর হাত রাখল। আবার অনেকেই হতবাক হয়ে মাথায় হাত দিল।
তারা বলল, তাহলে তুমি কি আমাদের কাছে বায়তুল মাকদিসের অবস্থা বর্ণনা করতে পারবে? উল্লেখ্য, উপস্থিত অনেকেই বায়তুল মাকদিস সম্পর্কে সম্যক অবগত ছিল।’ (তিরমিজি)
নবীজী বলেন, আমি তাদের কাছে বায়তুল মাকদিসের অবস্থা বর্ণনা করতে লাগলাম। কিছু বিষয় আমার কাছে অস্পষ্ট মনে হচ্ছিল। মনে মনে আমি খুব চিন্তিত হচ্ছিলাম। আমি তখনও কাবার হাতীমে পুরো কওমের সামনে দণ্ডায়মান। ইতিমধ্যেই পুরো বায়তুল মাকদিস আমার চোখের সামনে উদ্ভাসিত করা হল। আকীলের ঘরের উপর উদ্ভাসিত বায়তুল মাকদিস আমি স্বচক্ষে দেখে দেখে সব কিছু নিসংকোচে বলতে লাগলাম।
(বিশ্বনবির বর্ণনা) শুনে উপস্থিত লোকেরা মন্তব্য করল, মানচিত্র ও অবস্থা তো সঠিকই বর্ণিত হয়েছে।
হজরত আবু বকরের সত্যায়ন
মক্কার কোনো পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছিলেন হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু। মক্কার কাফেররা তাকে এ বিস্ময়ের কথা বলে সুধাল, তবুও কি তুমি তাকে বিশ্বাস করবে?
হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর হৃদয়ে ঈমানের বহ্নিশিখা জ্বলে উঠল। তিনি এক আকাশ আস্থা নিয়ে সুদৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠলেন, আমি তো এর চেয়েও আরো দূরের অনেক জটিল বিষয়েও তাঁকে বিশ্বাস করি। তাঁর কাছে আসা আসমানী বার্তাসমূহের উপর রয়েছে আমার অটল বিশ্বাস ও সুদৃঢ় ঈমান। অতএব…(মুসতাদরাকে হাকেম)
এছাড়াও প্রাগৈতিহাসিক সূত্র মতে বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মেরাজের অনেক ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। বিশ্বনিবর মেরাজ ছিল মক্কার হাতে গোনা কয়েকজন নব মুসলিমের জন্য কার্যকরী টনিক ও ঈমানি স্পৃহা বাড়ানোর অন্যতম উপাদেয়। যা বিশ্বনবির রেসালাতের সত্যতার অন্যতম মুজেজাও বটে।আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে মেরাজের সঠিক ইতিহাসকে হৃদয়ে ধারণ করে নিজেদের ঈমানকে আরো শক্তিশালী করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।