কেউ ভুলের উর্ধ্বে নয়। গৃহকর্মী কিংবা মালিক সবারই কমবেশি ভুল হয়ে থাকে। বর্তমান সময়ে গৃহকর্মীর কোনো ভুল হলেই তাদের ওপর নেমে আসে নির্যাতন। অথচ গৃহকর্মীর প্রতি কোনো ধরনের রূঢ় আচরণ সমর্থন করে ইসলাম। তাদের সঙ্গে উত্তম আচরণের বিশেষ ফজিলত ঘোষণা করেছেন বিশ্বনবি। দিয়েছেন উত্তম আচরণের সুন্দর দিকনির্দেশনা। হাদিসের একাধিক বর্ণনায় ওঠে এসেছে-
১. প্রতিদিন ৭০ বার ক্ষমা
হজরত আবদুল্লাহ ইবনু ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে একজন লোক এসে বললো, হে আল্লাহর রাসুল! আমি খাদেমের অপরাধ কতবার ক্ষমা করবো? তার কথা শুনে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নীরব থাকলেন। সে আবার বললো- হে আল্লাহর রাসুল! আমি খাদেমের (গৃহকর্মীর) অপরাধ কতবার ক্ষমা করবো? তিনি বললেন, ‘প্রতিদিন ৭০ বার।’ (তিরমিজি, আবু দাউদ)
হাদিসের অন্য বর্ণনায় এসেছে, নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুই বার চুপ করে থাকার পর তৃতীয় বার বলেছেন, তাকে প্রতিদিন ৭০ বার ক্ষমা করবে।’ (তিরমিজি, আবু দাউদ)
২. আজাদ করে দেওয়া
কোনো গৃহকর্মীকে নির্যাতন করলে তাকে আজাদ করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। যে কারণে গৃহকর্মীকে কোনোভাবে নির্যাতন করা যাবে না। হাদিসে এসেছে- হজরত হিলাল ইবনু ইয়াসাফ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, ‘আমরা সুয়াইদ ইবনু মুকাররিন রাদিয়াল্লাহু আনহুর বাড়িতে থাকতাম। আমাদের সঙ্গে একজন কড়া মেজাজী বৃদ্ধ ছিলেন এবং তার সঙ্গে একজন দাসী ছিলো। তিনি তার চেহারায় চড় মারলেন।
এ কারণে সুয়াইদ রাদিয়াল্লাহু আনহু এত বেশি উত্তেজিত হয়েছিলেন যে, আমরা তাকে এমন উত্তেজিত হতে আর কখনো দেখিনি। তিনি বলেন, একে আজাদ করা ব্যতীত তোমার জন্য অন্য কোনো পথ নেই। তুমি দেখছো যে, আমাদেরকে মুকাররিনের সাতটি সন্তান। আমাদের মাত্র একজন খাদেম ছিলো। আমাদের কনিষ্ঠ জন তার মুখে চড় মেরেছিল বিধায় নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের তাকে আজাদ করার নির্দেশ দিলেন।’ (মুসলিম, মুসনাদে আহমাদ, আবু দাউদ)
৩. মুনিবকে বেত্রাঘাত করা হবে
গৃহকর্মীর প্রতি অবিচারের শাস্তিও মারাত্মক। এমনকি নির্দোষ কোনো গৃহকর্মীকে অপবাদ দিলে আল্লাহ তাআলা তাদের বেত্রাঘাত করবেন বলে এভাবে হাদিসে ঘোষণা দিয়েছেন- হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, তাওবার নবি আবুল কাসেম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার নির্দোষ গোলামের উপর মিথ্যা অপবাদ দেবে, কেয়ামতের দিন তাকে বেত্রাঘাত করা হবে।’ (আবু দাউদ, বুখারি, মুসলিম)
৪. গৃহকর্মীকে মারা যাবে না
হজরত আবু মাসউদ আনসারি রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন কোনো এক সময় আমি আমার এক গোলামকে মারতে ছিলাম। তখন আমার পেছন থেকে একজন লোককে বলতে শুনলাম, আবু মাসউদ, জেনে রাখ!, আবু মাসউদ, জেনে রাখ! আমি পেছনে তাকানো মাত্রই দেখতে পেলাম রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
তিনি বললেন, ‘তুমি এর উপর যে পরিমাণ ক্ষমতার অধিকারী, তোমার উপর আল্লাহ এর চেয়েও অনেক বেশি ক্ষমতার অধিকারী।’ আবু মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, এরপর থেকে আমার কোনো গোলামকে আর কখনো মারিনি।’ (তিরমিজি, মুসলিম)
৫. দোষ দেওয়া যাবে না
গৃহকর্মীকে মারা এবং গালি দেওয়া যাবে না। এমনকি অন্যায় অপবাদ দেওয়াও যাবে না। হাদিসে এসেছে-
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, তওবাকারী আবুল কাসেম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘কেউ যদি তার নির্দোষ গৃহকর্মীর বিরুদ্ধে (জেনার) অপবাদ দেয় তবে আল্লাহ তাআলা কেয়ামতের দিন তার উপর হদ (নির্ধারিত শাস্তি) প্রতিষ্ঠিত করবেন। তবে গোলাম যদি প্রকৃতপক্ষেই সেরকমের হয় তাহলে ভিন্ন কথা।’ (তিরমিজি, বুখারি, মুসলিম)
৬. গৃহকর্মীর অপরাধ ক্ষমা করা
নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খাদেমের অপরাধ ক্ষমা করা এবং তাদের প্রতি উদার হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। হাদিসে এসেছে-
হজরত আবু সাঈদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ যখন তার খাদেম/গৃহকর্মীকে মারে এবং সে (খাদেম) আল্লাহ তাআলার দোহাই দেয়, তখন তোমাদের হাত তুলে নাও (মারধর বন্ধ কর)।’ (তিরমিজি)
৭. গৃহকর্মীর সঙ্গে উত্তম আচরণ করা
সব গৃহকর্তার উচিত, নিজ নিজ খাদেম/গৃহকর্মীর সঙ্গে উত্তম আচরণ করা। কেননা নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের প্রতি উত্তম আচরণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। এমনকি বিদায় হজের ভাষণে তাদের অধিকারের ব্যাপারে বিশেষ নসিহত পেশ করেছেন। হাদিসে এসেছে-হজরত আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘অধীনস্থদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারকারী জান্নাতে যেতে পারবে না।’ (তিরমিজি, ইবনে মাজাহ)
হজরত আবু যার রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘এরা (গৃহকর্মী/গোলাম) তোমাদের ভাই, এদেরকে আল্লাহ তাআলা তোমাদের অধীনস্থ করেছেন। সুতরাং যে ব্যক্তির এরূপ ভাই (গোলাম, বাদী, খাদেম, গৃহকর্মী) তার অধীনে আছে, সে যেন তার খাদ্য থেকে তাকে খেতে দেয় এবং তার পোশাক-পরিচ্ছদ থেকে তাকে পরতে দেয়। সে এরূপ কাজের বোঝা যেন তার উপর না চাপায় যা করতে সে সমর্থ নয়। সে তার উপর সাধ্যাতীত কোনো কাজের বোঝা চাপিয়ে দিলে সে যেন তাকে সহযোগিতা করে।’ (তিরমিজি, বুখারি, মুসলিম)
সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, কোনোভাবেই নিজেদের অধীনস্থ গোলাম, বাদী, খাদেম কিংবা গৃহকর্মীর প্রতি রুঢ় আচরণ না করা। তাদের ওপর জুলুম-নির্যাতন না করা। তাদের সাধ্যের অতীত কাজ চাপিয়ে না দেওয়া। বরং তাদের সঙ্গে ভালো উত্তম আচরণ করা। যদি তারা কোনো কারণে অন্যায় করে ফেলে তবে তাদেরকে বাবরবার এমনকি ৭০ বার পর্যন্ত ক্ষমা করে দেওয়ার পাশাপাশি তাদের সঙ্গে কোমল ও উত্তম আচরণ করা জরুরি। কেননা তাদের সঙ্গে উত্তম আচরণেই মিলবে জান্নাত। আর বিরূপ আচণের রয়েছে ভয়াবহ সব শাস্তি।আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে নিজেদের গোলাম, বাদী, খাদেম, গৃহকর্মীর সঙ্গে উত্তম আচরণ করার তাওফিক দান করুন। হাদিসের ওপর যথাযথ আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।