হোসেন মোঃ এরশাদ একাধারে একজন সামরিক সৈরশাসক, মুক্তিযুদ্ধকালে সুযোগ থাকার পরেও মুক্তিযুদ্ধে যোগ না দিয়ে ছিলেন পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে। নিয়োগ পেয়েছিলেন পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে পালিয়ে আসতে চেষ্টা করা সামরিক বাহিনীর সদস্যদের জন্য গঠিত সামরিক ট্রাবুনালের চেয়ারম্যান পদে। তার ক্রীত অপরাধের বিচার না হয়ে ১৯৯১-৯৬ বাদে দীর্ঘ আটচল্লিশ বছর ছিলেন ক্ষমতার কেন্দ্র বিন্দুতে। আজ তার জীবনাবসান হয়েছে। বিশ্বের অপরাপর সৈরশাসকদের ন্যায় নয় সে বিদায় কালেও রাষ্ট্রীয় মর্যাদা নিয়েই বিদায় নিচ্ছেন। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করা হয়েছে। একজন সাংসদ ও সর্বশেষ বিরোধীদলীয় নেতা হিসাবে তার মরদেহ মহান পার্লামেন্ট ভবনে আসবে জানাযা শেষে স্পীকার মন্ত্রী, রাজনৈতিক নেতারা তার মরদেহে ফুল দিয়ে শেষ শ্রদ্ধা জানাবেন। মহাজোট নেতা হিসাবে তার শরিক দলের নেতারা কেউ কেউ হয়তো কান্নায় ভেঙ্গে পড়বেন।
জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ- এর মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। শোকবার্তায় বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে সংসদে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের গঠনমূলক ভূমিকার কথা স্মরণ করেন শেখ হাসিনা। কিন্তু নুর হোসেন, জাফর, জয়নাল, দীপালি সাহা, সেলিম,দেলোয়ার, বসুনিয়া,শাহজাহান সিরাজ, ডাঃ মিলন এদের কি হবে? যারা আজ কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছেন,ফুল নিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করছেন, শোক বার্তা দিচ্ছেন তাদের কি মনে পড়ছে এই তাজাপ্রাণগুলি তাদেরই ডাকে আন্দোলনে সামিল হয়েছিল। যাদের মনে ক্ষোভ আছে তারা অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের বিরুপ মন্তব্য দিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। রাষ্ট্র যেখানে তাকে মর্যাদাবান করছে সেখানে আপনার আমার ক্ষোভে কি আসে যায়।
কে ছিলেন হোসেন মোঃ এরশাদ তিনি কি শুধুমাত্র একজন রাষ্ট্রপতি, সামরিক সৈরশাসক, বিরোধী দলীয় নেতা বা একজন বিশ্ব বেহায়য়া।না সেটা নয় তিনিই ছিলেন এদেশের রাজনীতির বিষবৃক্ষ। ‘পৃথিবীর কোথাও পরাজিত প্রশাসনের পদস্থদের নতুন প্রশাসনে দায়িত্ব দেয়া হয়না।’ এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে কিউবার মহান বিপ্লবের পর কমরেড চেগুয়েভারা যিনি কিউবার পরাজিত প্রশাসনকে সমূলে উৎপাটন করে কিউবা প্রশাসনকে নতুন করে ঢেলে সাজিয়ে দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন। এমনকি চিনের মাও সে তুং, কম্পুচিয়ার বিপ্লবী সরকার ও এই কাজটিই করেছিলেন। আর আমরা ৭১এর রাজাকার পাকবাহিনী সহায়ক ডিসি এস পি ওসিদের এনে প্রশাসন এ বসিয়েছিলাম। পাকিস্তান প্রত্যাগত সেনাসদস্যদের সেনাবাহিনীতে আত্বীকরন করা হয়েছিল। যার খেসারত আজকেও জাতিকে দিতে হচ্ছে।।আর এই খেলার প্রধান ক্রীড়ানক ছিলেন এই এরশাদ।
স্বাধীনতাত্তোর এদেশীয় রাজনীতির সকল মর্মস্পর্শী ঘটনার পিছনে পাকিস্তান প্রত্যাগত সেনাবাহিনীর একটি ভুমিকা ছিল আর পিছনের নায়ক ছিলেন এই এরশাদ। তিনি ছিলেন অত্যন্ত কৌশলী নিজেকে আড়ালে রাখেই তিনি তার সকল মিশন সফল করেছিলেন।থেকেছেন সব সময় ধরাছোয়ার বাইরে। সুযোগ থাকার পরেও নিজেকে মুক্তিযুদ্ধে যুক্ত করেন নি ছিলেন পাকিস্তানিদের পক্ষে এটা জানার পরেও বঙ্গবন্ধুর কাছে থেকে বাগিয়ে নিয়েছিলেন ভারতে উচ্চতর সেনা প্রশিক্ষণের সুযোগ। ১৯৭৫সালের বিয়োগান্তক ১৫ আগষ্ট ছিলেন দেশের বাইরে। এরপর থেকেই তার খেলা জিয়াউর রহমানকে সামনে রেখে দেশের মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তা হত্যার নীল নকশা যার শুরু খালেদ মোশাররফ, কর্নেল তাহের আর পরিসমাপ্তি ১৯৮১ সালের জিয়া হত্যা, জেনারেল মঞ্জুর হত্যা এবংজিয়া হত্যাকে কেন্দ্র করেই মুক্তিযোদ্ধা ব্রিগেডিয়ার মহসীনউদ্দিন সহ আরও ১৩জন মুক্তিযোদ্ধাকে ফাসি দিয়ে হত্যা করে সমাপ্ত করেন।
১৯৮২ সালের ২৪শে মার্চ সামরিক ফরমান বলে নিজেই দখল করে নিলেন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা। এবার শুরু করলেন রাজনীতির নুতন খেলা।সকল রাজনৈতিকদলের নেতাদের কেনাবেচা। দীর্ঘ নয় বছর সৈরাচারী শাসন চালিয়ে তিনি দেশের রাজনীতি ওছাত্ররাজনীতির সকল নৈতিকতা ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। টাকা দিয়ে রাজনীতি কেনাবেচা তিনিই শুরু করেন। রাজনীতিতে পুরোপুরিভাবে পুনর্বাসিত করেন মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি জামাতকে।
দীর্ঘ নয় বছরের সামরিক সৈরশাসন ছাত্রগণ অভ্যুত্থানে পতন ঘটলেও রাজনীতি থেকে এরশাদের অবসান ঘটাতে পারে নাই। ৫ বছর কারান্তরালে থেকেও সে পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। ১৯৯৬ সালের সরকারকে এক কৌশলী সমর্থন দিয়ে তিনি কারামুক্ত হয়ে দীর্ঘ ২২ বছর এদেশের বিরোধী দলীয় রাজনীতির এক খেলা খেলেছেন। তিনি বিরোধী দলের ছিলেন কিন্তু কোন আন্দোলন সংগ্রাম করেন নি। ২০০১ থেকেও তৎকালীন সরকারের সুবিধা নিয়েছেন আবার শেষ মুহুর্তে ২০০৬ সালে পল্টনে এসে মহাজোটের সভায় যোগ দিয়েছেন। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের দশম ও একাদশ নির্বাচনে তার আলোচিত ভুমিকা ধ্বংস করে দিয়েছে এদেশীয় বিরোধীদলীয় রাজনীতির ধারনা। ১/১১ সকল রাজনৈতিকদলকে নাড়া দিলেও স্পর্শ করেনি এরশাদকে। এভাবেই এরশাদ তার ঘটনাবহুল জীবন রেখে এদেশীয় রাজনীতিকে রেখে আজ বিদায় নিলেন। একমাত্র মঞ্জুর হত্যা মামলা তার অবিনাশী খেলার লাগাম টেনে ধরেছিল তা নাহলে আমাদেরকে হয়তো আরো কিছু মর্মস্পর্শী ঘটনার মুখোমুখি হতে হতো।
৯০ বছরের বর্ণাঢ্য জীবন, নাটকীয়তায় ভরা দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন কাটিয়ে, জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে কিছু সময় অতিবাহিত করে, সাবেক রাষ্ট্রপতি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ আজ সকাল ৭-৪৫মিনিটে ইন্তেকাল করেন।( ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।) মহান আল্লাহ উনার জীবনের সমস্ত ভুল ত্রুটি ক্ষমা করে দিয়ে -- উনার জীবনের ভালো কাজ গুলিকে কবুল করে-- উনাকে জান্নাত বাসী করুন। যাহোক তিনি চলে গেছেন আল্লাহ তাকে জান্নাতি করুন কারন এ জাতির জন্য কিছু ভালো কাজও তিনি করে গেছেন। তার প্রাপ্য তিনি পাবেন।
ইনিউজ ৭১/টি.টি. রাকিব
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।