বাকশাল কী এবং কেন?

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: বুধবার ২০শে মার্চ ২০১৯ ০৬:৩৭ অপরাহ্ন
বাকশাল কী এবং কেন?

২০০ বছরের অধিক সময়ে গোলামির জিঞ্জির থেকে মুক্তি পেলেও পাক-ভারত উপমহাদেশে দ্বি-জাতি তত্তে¡র ভিত্তিতে পাকিস্থান নামক একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। পাকিস্থান রাষ্ট্রের জন্মের আগে ও পরে তৎকালীন নেতৃবৃন্দের মধ্যে এ. কে ফজলুল হক, শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ বিভাগীয় সীমারেখার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে ইংরেজরা তাদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক পাকিস্থান ও ভারতের তথাকথিত রাষ্ট্রের সীমারেখা বাস্তবায়ন করে বাঙ্গালীদের উপেক্ষা করা হয়েছিল। স্বাধীনতার পরবর্তী পর্যায়ে মওলানা ভাসানী এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্থানিদের একগুয়েমীর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। আন্দোলনের এক সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে মত বিরোধিতা চলতে শুরু করে। পরবর্তীতে ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু বাংলার মুক্তির সনদ ৬ দফা ঘোষণা করেন। বাংলার ছাত্র সমাজ বাঙ্গালীর মুক্তির সনদ ১১ দফা উত্থাপন করেন। এদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বিভিন্ন সময়ে কারাগারে নিক্ষিপ্ত করে এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র নামে এক ভৌতিক মামলা করে সঙ্গী সহ বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে অনির্দিষ্ট কালের জন্য কারাবাসে প্রেরণ করে। 

এদিকে বাংলার ছাত্র-কৃষক, শ্রমিক-জনতা বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য নিরলস আন্দোলন শুরু করেন। তৎকালীন আয়ুব খান সরকার আন্দোলনকে সামাল দিতে না পেরে আরেক সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খানের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করে। ক্ষিপ্ত ছাত্র- জনতার সামাল দিতে ইয়াহিয়া সরকার ব্যর্থ হয়ে বঙ্গবন্ধুকে কারাগার থেকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলার সাত কোটি মানুষ উল­াসিত হয়ে উঠে এবং সারাদেশে জনতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙ্গালির মুক্তি চাই ও ৬ দফা বাস্তবায়নের জন্য বাঙ্গালী জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়। অবশেষে সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খান ৬ দফার অধিকাংশ দফা মেনে নিয়ে নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খান জাতীয় নির্বাচন দেন। সেই নির্বাচনে বাঙ্গালী জাতি সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে বঙ্গবন্ধুর হাতকে অধিক শক্তিশালী করে তোলেন। নির্বাচন পরবর্তীতে ইয়াহিয়া সরকার তালবাহনা করে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে বাঙ্গালী জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। ইতিমধ্যে ইয়াহিয়ার তালবাহনা রুপ যখন বাঙ্গালী জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার ছক আঁকেন তখন বঙ্গবন্ধু ৭ ই মার্চে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক সমাবেশের ডাক দেন। সেই সমাবেশে লক্ষ লক্ষ মানুষের উপস্থিতে ইয়াহিয়া খানের একগুয়েমীর কথা তুলে ধরে বাঙ্গালীকে ঐক্যবদ্ধ থেকে বাঙ্গালীর মুক্তির জন্য সশস্ত্র স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেন। 

বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্ত মোতাবেক বাঙ্গালীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে সশস্ত্র আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত হয় এবং স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ইতিমধ্যে ২৫ শে ডিসেম্বর দিবাগত রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্থানের কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। দীর্ঘ ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধে বাংলার ত্রিশ লক্ষাধিক মানুষের রক্তের বিনিময়ে এবং দুই লক্ষাধিক মা-বোনের ইজ্জত সম্ভ্রমের বিনিময়ে অবশেষে ১৬ ই ডিসেম্বর পশ্চিমাদের পরাহুত করে বাংলা ও বাঙ্গালীর স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনে। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুকে বিশ্বনেতৃত্বের চাপে ৮ই জানুয়ারি মুক্তি দিতে বাধ্য হয় এবং তাঁকে লন্ডনের একটি বিমানে করে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের সময়ে প্রথমে দিলি­তে অবতরণ করেন এবং দিলি­ থেকে ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন। স্বাধীন দেশে এসে বঙ্গবন্ধু ক্ষমতা গ্রহন করেন এবং ১৯৭৩ সালে একটি জাতীয় নির্বাচন দেন। সেই নির্বাচনে বাংলার জনগণ বঙ্গবন্ধুর মনোনীত প্রার্থীকে নির্বাচিত করে পুনঃ সরকার গঠন করেন। ১৯৭৪ সালে স্বাধীনতা বিরোধী পাকিস্থানী পন্থীরা ভিতরে ভিতরে স্বাধীনতার বিরোধিতা করে দেশে দ‚র্ভিক্ষের পায়তারা করে। চট্টগ্রামে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা খাদ্য-দ্রব্যাদি জাহাজ থেকে নামিয়ে এনে কর্ণফুলীর মোহনায় ডুবিয়ে দিয়ে কৃত্রিম দ‚র্ভিক্ষের সংকট সৃষ্টি করে এবং বিভিন্ন স্থানে সা¤প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু করে দেয়।

অন্য উপায় না দেখে বঙ্গবন্ধু বাংলার সমস্ত মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি পরিবারে আবদ্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং সেই বৈঠকে তিনি বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক লীগ(বাকশাল) নাম ঘোষণা করেন। দেশের সমস্ত দলের নেতৃবৃন্দ ও জনতাকে এই দলের সদস্য হওয়ার জন্য আহবান জানান। তাঁর এই উদ্দেশ্য ছিল যে, সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশে বিভিন্ন দলের সদস্যরা তাদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ভিতরে ভিতরে কেউ বাকশালের বিরোধীতা করেন। বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিয়েছিলেন সদ্য স্বাধীনতা অর্জনের দেশে বিভিন্ন জনের বিভিন্ন মত থাকতে পারে, তবে আমরা সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছি। সেই স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তোলার জন্য একটি ঘরে বসে আমরা সবাই আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতাকে অর্থবহ করার জন্য একটি পরিবারে রুপান্তর করতে চাই। প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ গঠিত হবে। কোনো রেষারেষি দেশের অভ্যন্তরে দেশবিরোধী চক্রান্ত বন্ধ করার নিমিত্তে স্বাধীনতাকে অর্থবহ করার মানসে তিনি এই দলের নাম ঘোষণা করেছিলেন। এখানে বাকশাল শব্দটি কোন বন্তু বিশেষের নাম নয়। অথচ দেখা যায় বাকশাল নাম ধারনের বিরুদ্ধে এখনো পর্যন্ত স্বাধীনতা বিরোধি চক্র চক্রান্ত করে চলছে। এই চক্রের অবসান হউক। সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশকে বিশ্বের দরবারে একটি সম্মান জনক দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সকলকে ঐক্যবদ্ধ করার মানসে জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই আহবানটুকু জানিয়ে ছিলেন। এখানে বাকশালের নামে সমালোচনা করার কিছু আছে বলে মনে করি না।  লেখক: শিক্ষানুরাগী, রাজনীতিবীদ

ইনিউজ ৭১/টি.টি. রাকিব