বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের কয়েকটি ধারা বাতিল ঘোষণা করেছে হাইকোর্ট। বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ মঙ্গলবার (১৭ ডিসেম্বর) পৃথক রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে এই রায় ঘোষণা করেন। আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্তি-সংক্রান্ত ২০ ও ২১ ধারা এবং সংবিধানে যুক্ত ৭ক, ৭খ, ৪৪ (২) অনুচ্ছেদকে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বাতিল ঘোষণা করেন। একই সঙ্গে ১৪২ অনুচ্ছেদের গণভোটের বিধান পুনর্বহাল করা হয়েছে।
২০১১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে এবং জাতীয় চার মূলনীতি—জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনে। পাশাপাশি রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল রেখে অন্যান্য ধর্মের সমমর্যাদা নিশ্চিত করা হয়। একই সময়ে ৭ই মার্চের ভাষণ, ২৬শে মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণা এবং স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
রায়ের পর রিটকারীর আইনজীবী অ্যাডভোকেট শরীফ ভূঁইয়া বলেন, “আমরা পঞ্চদশ সংশোধনী পুরোপুরি বাতিল চেয়েছিলাম। আদালত বেশ কিছু ধারা বাতিল করেছেন। তবে অন্যান্য ধারাগুলো নিয়ে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না দিয়ে তা ভবিষ্যৎ সংসদের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। ভবিষ্যৎ সংসদ প্রয়োজন অনুযায়ী এগুলো বহাল রাখতেও পারে বা বাতিল করতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, আদালত তাদের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে বাংলাদেশের সংবিধানের মূল কাঠামোর অংশ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কারণ, গণতন্ত্র এবং নির্বাচন বাংলাদেশের সংবিধানের একটি মূল ভিত্তি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে সুসংহত করেছে। তাই এটি সংবিধানের মূল কাঠামোর একটি অংশ হিসেবে বিবেচিত।
রিটের রায়ের ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার পথে বড় বাধা দূর হয়েছে বলে মনে করেন আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া। তবে তিনি বলেন, “তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে বাতিল করা হয়েছিল দুটি প্রক্রিয়ায়—সংসদের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন এবং আদালতের রায়ের মাধ্যমে। বিষয়টি এখন আপিল বিভাগের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে। জানুয়ারিতে এ বিষয়ে রিভিউ শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। সেই রিভিউ নিষ্পত্তি হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আবার ফিরে আসতে পারে।”
রায়ের বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, “আদালত অত্যন্ত প্রজ্ঞাবান সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে সংবিধানের মূল কাঠামোর অংশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আদালত যেসব ধারা নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত দেননি, সেগুলো ভবিষ্যৎ সংসদের জন্য রেখে দিয়েছেন। এটি রাজনীতিবিদদের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আমি মনে করি, এটি একটি ঐতিহাসিক রায়। হাইকোর্টের এই রায় যদি আপিল বিভাগে বহাল থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে কোনো সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাদ দিতে পারবে না।”
এ রায়ে সংবিধানের ৭ক ও ৭খ অনুচ্ছেদ বাতিল করা হয়েছে। ৭ক অনুচ্ছেদে সংবিধান বাতিল বা স্থগিত করা অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। আর ৭খ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল সংবিধানের মৌলিক কাঠামো সংশোধন অযোগ্য। এছাড়া ৪৪ (২) অনুচ্ছেদে হাইকোর্ট বিভাগের ক্ষমতা অন্য কোনো আদালতকে দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছিল, যা এই রায়ের মাধ্যমে বাতিল করা হয়েছে।
সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে গণভোটের বিধান বিলুপ্তি-সংক্রান্ত ৪৭ ধারা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থী বলে রায় দেন আদালত। এতে দ্বাদশ সংশোধনীর ১৪২ অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল করা হয়।
রায়ের ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার ভবিষ্যৎ ফেরত আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া ও সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার এই রায়কে গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।