রাজনীতির রেসে এখন এক অপ্রতিরোধ্য শক্তি আওয়ামী লীগ। প্রায় এক যুগ ধরে রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকা এই রাজনৈতিক দলকে পাল্লা দেয়ার মত কোনো রাজনৈতিক শক্তির অস্তিত্ব এখন মাঠে নেই। মহাসমারোহে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করেছে আওয়ামী লীগ। লাখো নেতাকর্মী নিয়ে করেছে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় বিজয় র্যালি। বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পালন করেছে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী।
করোনার ভয়াবহতা মোকাবেলায় গণমানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সুনাম কুড়িয়েছে আওয়ামী লীগ এবং তার সহযোগী ও অঙ্গসংগঠনগুলো। মাঠের প্রতিপক্ষ নিয়ে খুব বেশি বেগ পেতে না হলেও ঘরের কোন্দল ও নেতাদের অতিকথন নিয়ে বারবার বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে দেশের সবচেয়ে প্রাচীন এই দলটিকে। বছরের প্রথম দিকেই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই আব্দুল কাদের মির্জা সরাসরি তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়ে আলোচনায় আসেন। সমালোচনা করেন নির্বাচনে প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে। তার বক্তব্যে রাজনৈতিক অঙ্গনে তোলপাড় শুরু হয়। বিব্রত হয় দল, সরকার ও প্রশাসন।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের বর্তমান মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস ও সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনের মধ্যে বিরোধের শুরু হয় মেয়র পদে মনোনয়নকে কেন্দ্র করে। এরপর ‘টাকার হিসাব’ নিয়ে এই বছরের জানুয়ারিতে তাদের বিরোধ প্রকাশ্যে আসে। ব্যারিস্টার তাপস নিজ মালিকানাধীন ব্যাংকে শত শত কোটি টাকা স্থানান্তর করেছেন, তার মেয়র পদে থাকার যোগ্যতা নেই- এমন অভিযোগ করেন সাঈদ খোকন। সাঈদ খোকনের বক্তব্য মানহানিকর, আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে- হুঁশিয়ারি দেন ব্যারিস্টার তাপস। এ নিয়ে শুরু হয় কথার লড়াই, চলে অনুসারীদের পাল্টাপাল্টি মিছিল-মানববন্ধন। দলের নীতিনির্ধারকদের হস্তক্ষেপের পর কয়েক মাস দুজনই চুপ ছিলেন। তবে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনের ভিত্তিতে আদালত গত জুন মাসে সাঈদ খোকনের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও পরিবারের আটটি ব্যাংক হিসাব জব্দের আদেশ দিলে সংবাদ সম্মেলন করে তাপসের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ঝাড়েন সাঈদ খোকন। দুদকের তৎপরতার পেছনে তাপসের হাত রয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি। অবশ্য তাপস পাল্টা জবাব না দিয়ে বিষয়টি আদালত ও দুদকের বলে এড়িয়ে যান। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের সংখ্যা নিয়ে কটূক্তি করে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সিটি মেয়র মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলমের বক্তব্য সংবলিত একটি ভিডিও গত সেপ্টেম্বরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হলে এ নিয়ে ব্যাপক তোলপাড় হয়। গত ৩ অক্টোবর দলের স্বার্থ পরিপন্থী কর্মকাণ্ড ও সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে জাহাঙ্গীর আলমকে শোকজ করে আওয়ামী লীগ। গত ১৯ নভেম্বর দলের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে মহানগরের সাধারণ সম্পাদক ও প্রাথমিক সদস্য পদ থেকে তাকে বহিষ্কার করে আওয়ামী লীগ। এরপর ২৫ নভেম্বর মেয়র পদ থেকে তাকে সাময়িক বহিষ্কার করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।
বছর ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচিত-সমালোচিত এক নাম হেলেনা জাহাঙ্গীর। নিজেকে সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী, আওয়ামী লীগ নেত্রী ও গায়িকা পরিচয় দিতে ভালোবাসতেন তিনি । গত জুলাই মাসে সারা দেশে ‘চাকরিজীবী লীগ' গঠনের উদ্যোগ নিয়ে ব্যাপক সমালোচিত হন হেলেনা। এর আগে কখনো আওয়ামী লীগের রাজনীতি না করলেও তিনি দলটির মহিলা বিষয়ক উপকমিটির সদস্য হন। ‘আমি হেলেনা জাহাঙ্গীর কোনো এমপি-মন্ত্রীকে টাইম দিই না’ এমন একটি ভিডিও প্রকাশ পায় ফেসবুকে। এসব বিষয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনার পর তাকে বহিষ্কার করা হয় আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক উপকমিটির সদস্যপদ থেকে। হেলেনা জাহাঙ্গীরকে গুলশানের বাড়ি থেকে মদসহ গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
চলতি বছরের শেষদিকে বিস্ফোরক বক্তব্য দিয়ে আলোচনায় আসেন তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান। সংবিধানে ইসলাম ধর্ম না রাখাসহ তার নানা বক্তব্যে দল বিব্রত হয়। একটি সাক্ষাৎকারে তারেক রহমানের মেয়েকে নিয়ে বক্তব্য দেন তিনি। এরপর এক চিত্রনায়িকার সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিমন্ত্রীর কিছু আপত্তিকর অডিও ফাঁস হলে দেশজুড়ে নিন্দা ও সমালোচনার ঝড় ওঠে। এতে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সরকার। এ ঘটনায় তাকে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করতে নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে গত ৭ ডিসেম্বর মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন ডা. মুরাদ হাসান। এরপর জামালপুর আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক থেকে বহিষ্কার করা হয় মুরাদকে। কয়েক দিন আত্মগোপনে থেকে কানাডায় পাড়ি জমান তিনি। কিন্তু কানাডার ইমিগ্রেশন থেকে সেদেশে প্রবেশ করতে গেলে তাকে পাঠিয়ে দেয়া হয় দুবাই। সেখান থেকেও ফেরত আসতে হয় মন্ত্রীত্ব হারানো মুরাদকে।
দল থেকে বহিষ্কার ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয় রাজশাহীর কাটাখালী পৌরসভার মেয়র আব্বাস আলীর বিরুদ্ধে। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে বিরোধিতা করার কারণে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ১ ডিসেম্বর গ্রেফতার হন আব্বাস আলী।
করোনাকালে সাংগঠনিক কাজে ছেদ পড়ে আওয়ামী লীগের। কয়েক দফা উদ্যোগ নিয়েও খুব বেশি জেলায় সম্মেলন করা সম্ভব হয়নি। রাজশাহী ও ঢাকা বিভাগে কিছু জেলায় সম্মেলন হয়েছে। আগে আওয়ামী লীগের ইউনিট সম্মেলনের নজির না থাকলেও এবার ঢাকা মহানগর উত্তর ইউনিট সম্মেলন শেষ করেছে। চলমান রয়েছে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের ইউনিট সম্মেলন প্রস্তুতি। একইভাবে রাজশাহী বিভাগে ৩৫টি উপজেলার সম্মেলন করতে সক্ষম হয়েছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। সাংগঠনিক কাজে গতি না এলেও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন নিয়ে চাঙ্গা ছিল তৃণমূল আওয়ামী লীগ। তবে ইউনিয়ন পর্যায়ে ছিল বিদ্রোহী প্রার্থীর ছড়াছড়ি। নৌকার প্রার্থী না হতে পারলেই দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যেতেও পিছপা হননি তৃণমূল আওয়ামী লীগ নেতারা। সঠিক প্রার্থী বাছাইয়ের ব্যর্থতাকে দায়ী করছেন তারা। স্থানীয় এমপি-মন্ত্রীদের পছন্দের প্রার্থী না হওয়ায় অনেক ইউনিয়নেই ছিল বিদ্রোহী প্রার্থী । ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন নিয়ে চলতি বছর তৃণমূলে দুই সহস্রাধিক নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। নির্বাচনী সহিংসতায় ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে।
গত এক বছরে দলের কার্যক্রম সম্পর্কে আওয়ামী লীগের সভাপতি মন্ডলীর সদস্য আব্দুর রহমান বলেন, সঙ্কট-সম্ভাবনায় মনে রাখার মত একটি বছর গেছে। আওয়ামী পরিবার থেকে অনেক নেতাকে আমরা হারিয়েছি। তবে দুস্থ ও অসুস্থ অনেক মানুষের পাশে আওয়ামী লীগ দাঁড়িয়েছে।
পাশাপাশি আমরা সাংগঠনিকভাবেও সুসংগঠিত হয়েছি। আর সীমাবদ্ধতার কথা যদি বলি, সেটা করোনা অতিমারি। এটা ছাড়া তেমন কোনো সীমাবদ্ধতা ছিল না।
গত একবছরের দিকে ফিরে তাকিয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, বিদায়ী বছরে আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন করোনার ধাক্কা সামাল দেয়া। আল্লাহর রহমতে এবং জননেত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে আমরা তুলনামূলক অনেক কম ক্ষতির মধ্য দিয়ে এই সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। তবে স্বাধীনতাবিরোধীদের চলমান ষড়যন্ত্র উন্নয়নের পথে সবসময় অন্তরায় হিসেবে কাজ করেছে। দেশের স্বার্থে শুধু আওয়ামী লীগ নয়, দলমত নির্বিশেষে সবাইকে আন্তরিক হয়ে কাজ করতে হবে।
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।