বাংলাদেশে স্বর্ণের দাম এখন ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে। প্রতিদিনই বাড়ছে এই মূল্যবান ধাতুর বাজারদর। এক সময় যে স্বর্ণ ছিল বিয়েশাদির অপরিহার্য অংশ, এখন তা মধ্যবিত্ত এমনকি নিম্ন-মধ্যবিত্তের নাগালের অনেক বাইরে চলে গেছে। দেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতায় এ পরিস্থিতি শুধু স্বর্ণপ্রেমীদের নয়, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকেও প্রভাবিত করছে।
বর্তমানে দেশের বাজারে ভরিপ্রতি স্বর্ণের দাম দুই লাখ ১০ টাকার কাছাকাছি। কয়েক বছর আগেও এই দাম ছিল অর্ধেকেরও কম। কিন্তু বিশ্ববাজারে অস্থিরতা, ডলারের দাম বৃদ্ধি, আমদানি নির্ভরতা ও স্থানীয় চাহিদা বৃদ্ধির কারণে স্বর্ণের বাজারে আগুন লেগেছে।
বাংলাদেশে স্বর্ণের দাম নির্ধারণ করে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস)। তারা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি আউন্স স্বর্ণের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশের বাজারেও তা সমন্বয় করতে হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে— কাদের জন্য এই সমন্বয়? দেশের অধিকাংশ মানুষের আয় যখন স্থবির, তখন প্রতিনিয়ত বিলাসপণ্যের মতো স্বর্ণের দাম বাড়ানো কি ন্যায্য?
বাজারে এখন যে স্বর্ণের দাম, তাতে সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে বিয়ের মতো সামাজিক অনুষ্ঠানে গহনা কেনা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এক সময় বিয়েতে কনের জন্য মা-বোনেরা সামান্য হলেও কিছু স্বর্ণের অলংকার কিনে দিতেন; এখন সেটি ‘লাক্সারি’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ অবস্থায় বিকল্প হিসেবে অনেকেই এখন ইমিটেশন গহনা, সিলভার জুয়েলারি বা কৃত্রিম অলংকারের দিকে ঝুঁকছেন। কিন্তু তাতেও প্রকৃত স্বর্ণের মূল্য ও সামাজিক প্রতীকের ঘাটতি থেকে যাচ্ছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি অর্থনীতির অন্তর্নিহিত দুর্বলতাকে স্পষ্ট করে। ডলার সংকট, আমদানি ব্যয়, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং জনগণের আর্থিক অনিরাপত্তা— সব মিলিয়ে স্বর্ণ হয়ে উঠেছে নিরাপদ বিনিয়োগের প্রতীক। ফলে ব্যবসায়ীরা চাহিদাকে পুঁজি করে দামের লাগাম টেনে ধরছেন না।
এক অর্থে, স্বর্ণ এখন এক শ্রেণির সম্পদশালীদের জন্য ‘ধন প্রদর্শনের মাধ্যম’। আর মধ্যবিত্তদের জন্য তা এক স্বপ্নের জিনিস। বাজারে যতই দামের নতুন রেকর্ড গড়ুক না কেন, এর পেছনে সাধারণ মানুষের আর্থিক দূরবস্থা লুকিয়ে আছে।
অর্থনীতিতে বলা হয়, কোনো দেশের নাগরিক যদি মৌলিক চাহিদার বাইরে নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে স্বর্ণের দিকে ঝুঁকে পড়ে, তা মূলত অর্থনৈতিক আস্থাহীনতার লক্ষণ। বাংলাদেশের বর্তমান স্বর্ণবাজার সেই সংকেতই দিচ্ছে।
এখন প্রয়োজন— সরকার, বাজুস ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সমন্বিত উদ্যোগে বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং স্বচ্ছ দাম নির্ধারণ ব্যবস্থা প্রবর্তন করা। একইসঙ্গে মধ্যবিত্তের জন্য বিকল্প বিনিয়োগমুখী পরিকল্পনা নেওয়া জরুরি।
অন্যথায়, স্বর্ণের এই জ্বলজ্বলে দাম একসময় মানুষের জীবনে অর্থনৈতিক অন্ধকার ডেকে আনবে— যেখানে স্বপ্ন থাকবে, কিন্তু তা ছোঁয়ার ক্ষমতা থাকবে না।
লেখক: এম.কে. রানা, গণমাধ্যমকর্মী