প্রকাশ: ২৮ জুন ২০২৫, ২১:১৩
বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে। ধরুন, আগামী মাসেই নির্বাচন। নির্বাচনী মাঠে যদি ভোট হয় একদম স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষভাবে, তাহলে বিএনপির জয়ের সম্ভাবনা একরকম হিসেবের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। কারণ গণতান্ত্রিক প্রেক্ষাপটে একটি শক্তিশালী বিরোধী দলের প্রতি জনসমর্থন দৃশ্যমান। তবে, বাস্তবতা কিন্তু ততটা সরল নয়। ভেতরে লুকিয়ে আছে এক জটিল অঙ্ক—যেখানে ভোটের সংখ্যা নয়, বরং আসনের বিন্যাসই শেষ পর্যন্ত নির্ধারণ করতে পারে কে গঠন করবে সরকার।
ইতিহাস বলে, এই অদ্ভুত গণনার জালে একাধিকবার বদলে গেছে নির্বাচনের ফলাফল। উদাহরণ হিসেবে ২০০১ সালের নির্বাচনকে ধরাই যাক। সে বছর বিএনপি পেয়েছিল মাত্র ০.৮৪% বেশি ভোট, অথচ সংসদে আসন পেয়েছিল ১৩১টি বেশি। বিএনপি পেয়েছিল ১৯৩টি আসন, আর প্রায় সমান ভোট পাওয়া আওয়ামী লীগ পেয়েছিল মাত্র ৬২টি। এই বিপুল পার্থক্য মূলত সৃষ্টি হয়েছিল ভোটার বিভাজন, এলাকা পুনর্বিন্যাস এবং কৌশলগত নির্বাচনী এলাকার কারণে।
২০০৮ সালে পরিস্থিতি একেবারে পালটে যায়। ঢাকা শহরকে কেন্দ্র করে নতুন ৭টি আসন সৃষ্টি করা হয়, যার সবই আওয়ামী লীগের অনুকূলে যায়। পুরনো আসনগুলোর সীমারেখা এমনভাবে পুনর্বিন্যাস করা হয় যাতে শহরাঞ্চল বা আওয়ামী লীগপন্থী ভোটারদের একত্র করা সম্ভব হয়। এর ফলে অনেক আসনেই বিএনপির অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ে।
উদাহরণস্বরূপ, ঢাকা-১ আসনে ২০০১ সালে বিএনপি জয় পেলেও, দোহার ও নবাবগঞ্জকে একত্র করে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ২০০৮ সালে বিশাল ব্যবধানে জয় পান। একইভাবে, ঢাকা-২ আসনে শহরাঞ্চল যুক্ত হওয়ায়, বিএনপি তাদের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের কাছে বড় ব্যবধানে হেরে যায়। এমনকি ধানমন্ডি-কেন্দ্রিক ঢাকা-১০ আসনের মতো নতুন এলাকাগুলো আওয়ামী লীগের জন্য শক্ত ঘাঁটিতে পরিণত হয়।
এছাড়া গ্রামীণ আসনগুলোতেও পরিবর্তনের ছাপ পড়ে। কিশোরগঞ্জে ৭টি আসন থেকে ৬টিতে নামিয়ে আনা হয় এবং পুনর্বিন্যাসের ফলে আওয়ামী লীগ ৫টিতেই জয় পায়। বরগুনায়ও একই ঘটনা ঘটে, যেখানে এক আসনে আওয়ামী লীগপন্থী বেতাগী উপজেলা যুক্ত করায় তাদের প্রার্থী জয়ের মুখ দেখে। এই পুনর্বিন্যাস কার্যত বিএনপির গ্রামীণ শক্তিকে খণ্ডিত করে।
এই “নির্বাচনী এলাকা পুনর্বিন্যাস” ছিল ২০০৮ সালের নির্বাচনের সবচেয়ে বড় গেম-চেঞ্জার। বিএনপির সেই সময়ের অনেক ‘নিশ্চিত’ আসন হঠাৎ করেই প্রতিযোগিতাপূর্ণ হয়ে ওঠে, কিংবা একেবারে প্রতিপক্ষের ঘাঁটিতে পরিণত হয়। ফলাফল—১৬০টির মতো আসন বিএনপির হাতছাড়া হয়ে যায়, যার বেশিরভাগই ছিল পূর্বে তাদের শক্ত ঘাঁটি।
এই প্রেক্ষাপটে যদি ২০২৫ সালের নির্বাচনের দিকে তাকাই, তাহলে দেখা যাচ্ছে প্রায় ৮০ থেকে ১০০টি আসন যেগুলো এক সময় বিএনপির বলে ধরা হতো, এখন হয় প্রতিযোগিতাপূর্ণ, নয়তো আওয়ামী লীগের অনুকূলে গেছে। ফলে, গণভোটে বিএনপি এগিয়ে থাকলেও, আসনে পিছিয়ে পড়তে পারে।
এই পরিস্থিতিকে বলা যায় “অদৃশ্য জাল”, যার সূক্ষ্ম পরিকল্পনায় লুকিয়ে আছে প্রশাসনিক কৌশল, ভৌগোলিক পুনর্বিন্যাস এবং সামাজিক ডেমোগ্রাফির খেলা। এই জালকে উপেক্ষা করে শুধু জনমত দিয়ে ফলাফল নির্ধারণ করা অসম্ভব।
তবে, এই ঘাপলাগুলোর কথা শুধু গুজব নয়, বরং পরিসংখ্যান ও পূর্ববর্তী নির্বাচনের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায়—কোন আসন কেমনভাবে পরিবর্তিত হয়েছে এবং কীভাবে তার ভোটার কাঠামো বদলেছে।
নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, এই অদৃশ্য জালের রহস্য আরও ঘনীভূত হচ্ছে। জনগণ কি আদৌ সঠিক প্রতিনিধিকে সংসদে পাঠাতে পারবে, নাকি আবারও পুনর্বিন্যাসের অঙ্কে হারিয়ে যাবে তাদের ভোটের মূল্য?
পরবর্তী পর্বে প্রকাশিত হবে—কোন কোন আসনগুলো আছে এই “ঘাপলার” তালিকায়, এবং কীভাবে সেই আসনগুলো হয়ে উঠতে পারে ২০২৫ সালের নির্বাচনের টার্নিং পয়েন্ট।