চট্টগ্রামে যখন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়, সেই সময়ে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে শয্যার অভাবে অনেক রোগী ভর্তি হতে পারেননি। এমন ঘটনাও হয়েছিল, যেখানে রোগী নিয়ে তিন-চার হাসপাতালে ঘুরে জায়গা না পাওয়ায় মৃত্যুও হয়েছে অনেকের। সৌভাগ্যক্রমে যারা ভর্তি হতে পেরেছিলেন, তাদের চিকিৎসা নিতে হয়েছে ফ্লোরে থেকেই। এসব কারণে-অভিযোগে বেশ আলোচনা সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল তখন।
হাসপাতালগুলোর পক্ষ থেকে যখন শয্যা খালি না থাকার দোহাই দেয়া হয়েছিল, বর্তমানে চট্টগ্রামের কোভিড রোগীদের চিকিৎসায় বিদ্যমান সরকারি-বেসকারি ২৮টি হাসপাতালের ৬০ শতাংশ শয্যাই খালি পড়ে আছে। শুধু সাধারণ শয্যাই নয়, ওই সময়ে যে একটি শয্যা জোগাড় করতে মানুষ হন্যে হয়ে খুঁজেছিল, বর্তমানে সেই সোনার হরিণ নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) ২৫ শতাংশ শয্যাও খালি। গতকাল (সোমবার) স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে প্রাপ্ত সর্বশেষ তথ্যে এমনটি জানা যায়।
হঠাৎ রোগী কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, বর্তমানে রোগীদের মধ্যে রোগের তীব্রতা কম। সংক্রমণ বাড়তে থাকলেও আগের চেয়ে সচেতনা বেড়েছে বহুগুণ। যারাই হাসপাতালে আসছেন, তাদের বেশিরভাগই জটিল রোগী। অন্য সকলেই বাসায় থেকে চিকিৎসা সেবা নিচ্ছেন। ফলে রোগীদের চাপ অনেক কমেছে হাসপাতালগুলোতে। যদিও অধিকাংশ রোগীদের ভাষ্য, হাসপাতালের নানা অব্যবস্থাপনার খবরে দুর্ভোগ পোহানোর আশঙ্কায় তারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, স্বাস্থ্য খাতের অব্যবস্থাপনায় রোগীরা দুর্ভোগের কথা ভেবে হাসপাতালমুখী হচ্ছেন না। যার কারণে কষ্ট হলেও বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন তারা।
স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, চট্টগ্রামে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাগুলোর মধ্যে ২৮টি হাসপাতাল করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছে। এরমধ্যে ফিল্ড হাসপাতালসহ চট্টগ্রামে বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে সর্বমোট ২৩টি। যাতে ২ হাজার ৫৭টি শয্যা রয়েছে। আর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে করোনা ইউনিটসহ সরকারি ব্যবস্থাপনায় বাকি পাঁচটি হাসপাতালে শয্যা রয়েছে ৫৮২টি। সবমিলিয়ে এ ২৮টি হাসপাতালে শয্যার সংখ্যা ২ হাজার ৬৩৯টি। এরমধ্যে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র রয়েছে মাত্র ১৩টি হাসপাতালে। যার সংখ্যা মাত্র ৯২টি।
গতকাল (সোমবারের) সর্বশেষ তথ্যে, সরকারি-বেসরকারি ২৮টি হাসপাতালের ২ হাজার ৬৩৯ শয্যার বিপরীতে কোভিড, নন- কোভিডসহ রোগী ভর্তি আছেন মাত্র ১ হাজার ৫৪ জন। অর্থাৎ ৩৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ রোগী ভর্তি আছে এসব হাসপাতালে। বাকি ৬০ শতাংশের বেশি শয্যাই খালি। এছাড়া ১৩টি হাসপাতালে থাকা ৯২টি আইসিইউ’র মধ্যে কোভিড, নন-কোভিডসহ রোগী ভর্তি আছে ৬৯ জন। অর্থাৎ ২৫ শতাংশ আইসিইউ শয্যাও খালি।
হঠাৎ রোগী কমার কারণ হিসেবে স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে সচেতনতা আর রোগের তীব্রতা কমার কারণেই রোগীরা হাসপাতালমুখী না হওয়ায় শয্যাগুলো খালি পড়ে আছে বলে উল্লেখ করা হয়। তবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাসপাতালে কোভিড রোগীদের জন্য শয্যা খালি নেই ভেবেই বাসায় বসে চিকিৎসা নিচ্ছেন তারা। কিন্তু এমন হতে থাকলে গুরুতর রোগীদের হাসপাতালে না যাওয়ার প্রবণতা তাদের জীবনকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলতে পারে বলেও অভিমত তাঁদের।
এ প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্য অধিকার রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘ করোনার শুরু থেকেই চট্টগ্রামের স্বাস্থ্যখাত বেহাল দশায় পরিণত হয়। হাসপাতাল ঘুরে ঘুরে রাস্তাঘাটে মানুষ চিকিৎসা না পেয়ে মরেছে। যার কারণে এখন তারা হাসপাতালে যেতে অনাগ্রহী। কিন্তু গুরুতর রোগীরা যদি হাসপাতালে যেতে আগ্রহী না হয়, তাহলে তাদের জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে’। এ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের মতে, ‘কোন হাসপাতালে কয়টি আইসিইউ এবং কয়টি সাধারণ শয্যা খালি আছে সেটি প্রতিদিন প্রকাশ করা উচিত। তাহলে সে অনুযায়ী এলাকা বাছাই করে রোগীরা তাদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে পারবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি’।
জানতে চাইলে স্বাস্থ্যদপ্তর চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক ডা. হাসান শাহরিয়ার কবির পূর্বকোণকে বলেন, ‘সার্বিক পরিস্থিতি আগের চেয়ে তুলনামূলক ভালো। যার জন্য করোনা রোগীদের মধ্যে শুরুর মতো শয্যা নিয়ে হাহাকার নেই। বর্তমানে যারা আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের অধিকাংশই মৃদু উপসর্গে ভুগছেন। তাদের হাসপাতালে যাওয়ারও প্রয়োজন হয় না। যার ফলে বাসা বা বাড়িতে বসেই তারা সেবা নিচ্ছেন। তাছাড়া মানুষ আগের চেয়ে এখন অনেক সচেতন। যার কারণেই এসব হাসপাতালের শয্যা খালি আছে। তবে স্বাস্থ্য বিভাগ সর্বোপরি প্রস্তুত আছে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোতেও নিয়মিত রোগী ভর্তি করানো হচ্ছে। আগে যেমন অভিযোগ পাওয়া যেত, সেটিও এখন নেই। আশা করি, সামনেও সমস্যা হবে না’।
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।