২০১২ সালের ২৯ জানুয়ারির আগের দিনগুলো অন্য সবার মতোই বেশ স্বাভাবিক ছিল জাকির হোসেনের। সুঠাম দেহের অধিকারী এ মানুষটি এক সময় কাচঁপুরে তৃপ্তি সয়াবিন কোম্পানিতে কাজ করতেন।
কোনো এক কারণে কোম্পানিটি হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বেকার হয়ে যান তিনি। এর মাঝে আরও একটি দুর্ঘটনার শিকার হন তিনি। সেই দুর্ঘটনায় একটি পা কেটে ফেলতে হয়েছে তার। এরপর থেকে জীবনে ভোগান্তি আর হতাশা শুরু। এ অবস্থায় ১৯৮৮ সাল থেকে তিনি এ পায়ের ওপর ভর করে টেনে যাচ্ছেন সংসার নামক লাগামহীন ঘোড়া। জাকির হোসেনের মাঝখানের জীবনের গল্পগুলো আরও করুণ। বর্তমানে তিনি থাকেন নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ থানাধীন কাঁচপুর ইউনিয়ন পরিষদের কুতুবপুরে।
৫০ বছর বয়সী জাকির হোসেন সিদ্ধিরগঞ্জের সাইলো খেয়াঘাটস্থ শীতলক্ষ্যা নদীতে যাত্রী পারাপার করেন। এক ঘাট থেকে যাত্রী আরেক ঘাট নিয়ে যেতে জনপ্রতি পাঁচ টাকা নেন তিনি। এতে প্রতিদিন তার আয় হয় ২৫০-৩০০ টাকা। এটি করোনা পরিস্থিতি সৃষ্টির আগের গল্প। চলমান করোনার কারণে বর্তমানে তার আয় নেমেছে চার ভাগের এক ভাগেরও নিচে। এই আয় দিয়ে বর্তমানে সংসার চলছে তার।
তার সংসারে মা, স্ত্রী, দুই ছেলে, ছেলেদের স্ত্রী ও এক নাতি রয়েছেন। তবে তার দুই ছেলেও আয় রোজগার করতো। করোনা সেটিও কেড়ে নিয়েছে তাদের কাছ থেকে। জাকিরের বড় ছেলে কাজ করেন বাড়ির পাশে রহিম স্টিল মিল ফ্যাক্টরিতে।আর ছোট ছেলে কাজ করতো এলাকার কিউট কোম্পানিতে। কিন্তু করোনা সংক্রমণের পর থেকে তাদের কাজ বন্ধ রয়েছে।
জাকির হোসেনের ছোট ছেলে ইয়াসিন আরাফাত গণমাধ্যমকে বলেন, গত আড়াই মাস যাবৎ আমার কাজ বন্ধ। বেকার বসে আছি। বাবার উপার্জনে চলছে সংসার। করোনা দুর্যোগ শুরুর সময় স্থানীয় চেয়্যারম্যানের কাছ থেকে কিছু ত্রাণ পেয়েছিলেন জাকির হোসেন। যা পরিমাণে খুবই কম।
জাকির হোসেন এ প্রতিবেদককে বলেন, ইমুনও দিন গেছে আমরা ঘরের সবাই এক বেলা খাইছি। সরমের কতা, মানুষের বাইত্তে আমরা পচা ভাত আইন্যাও খাইছি। কি করমু, খাইয়্যাতো বাঁচতে অইবো।
তিনি জানান, তিন মাস আগে তার ছেলের ঘরে পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। তখন সিজারসহ মোট ৩৫ হাজার টাকা খরচ হয়। পুরো টাকাটা তাকে এলাকার মানুষের কাছ থেকে ধার করতে হয়েছে। যাদের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েছেন তাদের বলেছিলেন নৌকা চালিয়ে ধীরে ধীরে সেই টাকা পরিশোধ করে দেবে। কিন্তু লকডাউনের কারণে আয় কম হওয়ায় ওই টাকাটা এখনও পরিশোধ করতে পারেননি তিনি।
এ বিষয়ে তিনি বলেন, টাকাটা কেমনে পরিশোধ করমু, এইডা লইয়্যা চিন্তায় আছি।পোলাগো কাজ কাম এতদিন বন্ধ আছিলো। আর ভাইরাসের কারণে আমারও এখন খুব বেশি আয় নাই।নাতিডার প্রতি সপ্তাহে ৫শ ট্যাকার দুধ লাগে। হুনতাছি সামনে আবার লকডাউন অইবো। এবার লকডাউন অইলে মরণ ছাড়া আমগো গতি নাই। তিনি আরও বলেন, এক পা লইয়্যা নৌকা বাইতে খুব কষ্ট হয়। আমার কাছে যদি কিছু ট্যাকা পুঁজি থাকতো তাইলে আমি এই কাজ ছাইড়্যা ছোডোখাডো একটা দোকান দিতাম।
কথা হয় একই খেয়া ঘাটের মাঝি ওমর ফারুকের সঙ্গে। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, আমরা মোট ২৫ জন মাঝি এ ঘাটে নৌকা চালাই। আমগো লগের খালি জাকির ভাইয়েরই পাও নাই। ওনার যদি অভাব না থাকতো তাইলে তো ওনি এক পাও লইয়া কষ্ট কইরা নৌকা চালাইতো না। কথা হয় কাচঁপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মোশাররফ ওমরের সঙ্গে। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, করোনা সংক্রমণের শুরু থেকেই আমি ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছি। লকডাউনের সময় উনাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে সহায়তা করেছি। প্রয়োজনে অসচ্ছল জাকির হোসেনকে আবারও সহযোগিতা করবেন বলে তিনি আশ্বাস দেন।
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।