কালকিনিতে প্রায় ১৫টি কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মানে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক
মোঃ আতিকুর রহমান আজাদ,উপজেলা প্রতিনিধি কালকিনি (মাদারীপুর)
প্রকাশিত: বৃহঃস্পতিবার ৫ই ডিসেম্বর ২০১৯ ০৩:০০ অপরাহ্ন
কালকিনিতে প্রায় ১৫টি কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মানে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অগ্রাধিকার প্রকল্প কমিউনিটি ক্লিনিক। মাদারীপুরের কালকিনিতে এ কমিউনিটি ক্লিনিকের একটি ভবন নির্মাণকাজে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রকৌশীর যোগসাজসে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তিনটি ভবনের কাজ বন্ধ রয়েছে। জানা যায়, সিডিউল অনুযায়ী কমিউনিটি ক্লিনিকের নতুন মডেলের প্রতিটি ভবনে চারটি রুম থাকবে, দুটিতে সেবাদানকারীরা বসবেন, একটি রোগীদের ওয়েটিং রুম আর একটি লেবার (ডেলিভারি) রুম হিসেবে ব্যবহৃত হবে। বাথরুম থাকবে দুটি। একটি হাই কমোড, একটি নরমাল কমোড, ফ্লোর ও ওয়াল পুরোটাই টাইলস ফিটিং থাকবে, জানালায় থাইগ্লাস, পানির ট্যাংকি, পানি ওঠানোর জন্য মটর থাকবে। গভীর নলকূপ ও ফার্নিচার থাকবে আধুনিক মানের কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে।

কিন্তু আধুনিকতার ছোয়া কথা থাকলেও বাস্তব চিত্রে এর কিছুই পাওয়া যায়নি। এরমধ্যে নিন্মমানের সামগ্রী ও আসবাবপত্র প্রত্যেকটি কমিউনিটি ক্লিনিকে ব্যবহার করা হচ্ছে। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের সাথে তদারকি প্রতিষ্ঠানের যোগসাযোসে করে ধামাপাচা দিয়ে প্রভাব খাটিয়ে হ্যান্ডওভার নেওয়া চেষ্টা করছে। উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের সূর্যমনি কমিউনিটি ক্লিনিকের কাজ শেষ করেছে ঘোজামিল দিয়ে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটির কাজ সমাপ্ত করে বিল তুলে নিয়েছে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। সেগুলোর কাজের মানও খুব খারাপ। বাশঁগাড়ী আউলিয়ারচর কমিউনিটি ক্লিনিকের ঢালাইয়ের কাজে নিন্মমানের ইট, বালু ও খোয়ার ব্যবহার করার কারণে কাজ বন্ধ করে দিয়েছিল এলাকাবাসী। দক্ষিণ ভাউতলী কমিউনিটি ক্লিনিকের ছাদ ঢালাইয়ের পর চারপাশের ইট গাথার পর প্রায় ১ বছর হলেও ঠিকাদার আর কোন কাজ করেনি।

অপরদিকে পূর্ব এনায়েতনগরের পূর্ব আলীপুর কমিউনিটি ক্লিনিকের ছাদ ঢালাইয়ের কাজ শেষ করে গত ৮ মে তার পর থেকে কাজ বন্ধ। লক্ষীপুর ইউনিয়নের বিদ্যাবাগিস কমিউনিটি ক্লিনিকের কাজও বন্ধ প্রায় ১ বছর। তারপর থেকে আর কোন কাজ করেনি। এ পাঁচটি ছাড়াও বাকি আরও ১০টি কাজে অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। লক্ষ্মীপুরের সূর্যমনি কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রাক্কলিত মূল্য ২২ লক্ষ চুরানব্বই হাজার ৫৪৬ টাকা, দক্ষিণ ভাউতলী কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রাক্কলিত মূল্য ২৬ লক্ষ ৬৫ হাজার ৩১০ টাকা, পূর্ব এনায়েতনগর কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রাক্কলিত মূল্য ২৬ লক্ষ ১৬ হাজার ৯১৪ টাকা ও আউলিয়ারচর কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রাক্কলিত মূল্য ২৭ লক্ষ ৪৯ হাজার ৭৮৮টাকা। 

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সূর্যমনি কমিউনিটি ক্লিনিকের কাজ শেষ করেছে। তবে গভীর নলকূপ থেকে পানি ওঠে না। কাজের মান ভালো না হওয়ায় এলাকাবাসী কাজ বন্ধ করে দিয়েছিল। কাজের ব্যাপারে সূর্যমনি এলাকার স্থানীয় মাদারীপুর জেলা ছাত্রলীগীরে সহ-সভাপতি মোঃ ইকবাল হোসেন সরদার বলেন, কাজের মান খুবই খারাপ যে ছাদের পুরান রড দিয়েছে, ঢালাইয়ের সময় নিন্মমানের খোয়া,সাধারণ বালু, সিমেন্ট দিয়েছে কম। ফার্নিচার মানও খারাপ, টাইলস দেওয়ার কথা যা ছিল তা দেয় নাই, কম দিয়েছে ও টাইলসের মানও ভাল না, ফিটিংস ও ভাল হয় নাই। কাজের ব্যাপারে কোন খোজ খবর নিতে গেলে বলে আমরা গোপালগঞ্জের শেখ পরিবারের লোক, বেশি ঝামেলা করলে চাঁদাবাজীর মামলার হুমকি দেয়। এলাকার মুরুব্বিরা ও কমিউনিটি ক্লিনিকের সভাপতি

চিকিৎসা করে ঢাকা থেকে এলেই আমরা নিন্মমানের কাজ করার জন্য ঠিকাদার ও স্বাস্থ্য প্রকৌশলী মাদারীপুর জেলার অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার জাকিয়া সুলতানার বিরুদ্ধে বিভিন্ন দফতরে অভিযোগ দিবো। এব্যাপারে কমিউনিটি ক্লিনিকের সভাপতি মোঃ মোদাচ্ছের হোসেন বলেন, কাজের মান খুবই খারাপ,দায়সারা ভাবে কাজ করে গেছে। এখন কাজ বুজিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে কাগজে সাক্ষর দিতে বলে। কাজের ব্যাপারে বেশি খোজ খবর নিতে গেলে বলে চাঁদাবাজী মামলার হুমকি দেয়। আবার বলে আমরা শেখ পরিবারের লোক। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে কাজ করে গেছে।

অভিযুক্ত ঠিকাদার মোঃ শিপন বলেন, ভাই আগে জানলে এই কাজ নিতাম না। কাজে আমার লাভ হয় নাই। সূর্যমনি এলাকার মানুষ  ভাল না। আমি এত ভাল কাজ করলাম তারও আমাকে তারা মারছে। আবার আমার কাছে চাদা চায়। আরও অভিযোগ আছে যে, ক্ষমতা দেখিয়ে কাজ সম্পন্ন করতে চায় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। আউলিয়ারচর কমিউনিটি ক্লিনিকের ভবন নির্মাণ কাজ চলমান তবে কাজের মান খারাপ। একই ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের তিনটি কউমিনিটি ক্লিনিকের কাজ বন্ধ। আর বন্ধ কমিউনিটি ক্লিনিক ৩ টি হলো দক্ষিণ দক্ষিণ ভাউতলী কমিউনিটি ক্লিনিক, পূর্ব আলীপুর কমিউনিটি ক্লিনিক ও লক্ষীপুর বিদ্যাবাগিস কউমিনিটি ক্লিনিক। নিন্মমানের ইট, বালু ও খোয়া ব্যবহার করা হচ্ছে। সরকারের নিয়ম-কানুন তোয়াক্কা না করে ঠিকাদার ইচ্ছামত ঢালাই দিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

আরও অভিযোগ আছে স্বাস্থ্য প্রকৌশলী মাদারীপুর জেলার অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার জাকিয়া সুলতানার বিরুদ্ধে। তিনি সাইডে এসে ঠিকাদারকে হুমকি-ধমকি দেয় ঠিকই, তা শুধু লোক দেখানো। অনুসন্ধানে আরও দেখা যায়, কালকিনি উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কাজের ওয়ার্ক অর্ডারের কপি পাবেন। কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, তারা কোন কপি পাননি।

সরেজমিনে দেখা যায়, আউলিয়াচর কমিউনিটি ক্লিনিকের কাজের মান ভালো নয়। স্থানীয়রা অভিযোগ করে বলেন, আমরা প্রতিবাদ করে কী হবে? স্থানীয় লোকজন কাজ বন্ধ করে দিলেও বন্ধের দিন কাজ শুরু করে কাজের মান খুব খারাপ, কাজ শুরু করে আর আসে না। কোন দিন আসে, কোন সময় যায় তা-ও আমরা জানি না। কাজ দেখভালের দায়িত্বে থাকা অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার জাকিয়া সুলতানা কাজের সাইডে কখন আসে কেউ জানে না। তারপরও কারো সামনে পরলে বলে ইট, বালু, রড, খোয়া ভালো না তবে এগুলো শুধু লোক দেখানো। তিনি যাওয়ার পর যেই সেই। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক এলাকাবাসী বলেন, আউলিয়ারচর কমিউনিটি ক্লিনিকের কাজ খারাপ হওয়ার কারণে আমরা কিছু বলতে গেলে ঠিকাদার বা তার লোকজন বলে, আপনাদের এত খবর রাখার দরকার নাই। আপনারা জানেন না যে আমার বাড়ি আপনাদের এলাকায়। যে ঠিকাদার ইয়াহিয়া খান প্রভাবশালী তাই আমরা কিছু বলতে পারি না। আউলিয়ারচর কমিউনিটি ক্লিনিকের সভাপতি মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান সুমনকে তার ব্যবহৃত মোবাইলে একধিকবার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

অভিযোগের ব্যাপারে ঠিকাদার ইয়াহিয়া খান বলেন, ‘আমি মূল ঠিকাদার না, আমি কাজ কিনে করছি।’  আঊলিয়ারচর কমিউনিটি ক্লিনিকের কাজের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আপনাকে কাজ দেখার জন্য কে খবর দিয়ে আনছে। ভাই, কাজ শুরু করার পরই মাদারীপুর জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের এসিস্টেন্ট ইঞ্জিনিয়ার জাকিয়া সুলতানা  ১৮ লাখ টাকা বিল দিয়ে দিয়েছে। ভাই , আপনার সাথে দেখা করে কাজ করব।’ এব্যাপারে স্বাস্থ্য বিভাগের মাদারীপুর জেলা এসিস্টেন্ট ইঞ্জিনিয়ার জাকিয়া সুলতানাকে তার ব্যাক্তিগত মোবাইল একাধীকবার যোগাযোগ করার চেষ্ঠা করে তাকে পাওয়া যায় নি। 

কালকিনি স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাক্তার আল বিধান মোহাম্মদ সানাউল্লাহ বলেন, ‘কাজগুলো মূলত  স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর থেকে করা হয়। কাজগুলো করার পর তা আমাদেরকে বুঝিয়ে দেয়া হয়। আমরা হ্যান্ডওভার নিয়ে স্থাপনাটি ব্যবহার করি। কাজ করার পর এলাকার বিভিন্ন জনপ্রতিনিধি, সিএইচসিপি এবং কমিউনিটি গ্রুপের সদস্যরা কাজের মানের ব্যাপারে সরাসরি আমার কাছে অভিযোগ জানান। আমি স্বাস্থ্য প্রকৌশলী অধিদপ্তরকে অবহিত করি। অথচ আমি বিভিন্ন প্রশ্ন ও ক্ষোভের সম্মুখীন হই। এ নির্মাণ কাজে ব্যত্যয় ঘটলে তার দায়ভার আমি নিব না।’

এ ব্যাপারে কালকিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘আমি কমিউনিটি ক্লিনিকের কাজের কোন কাগজপত্র পাইনি। পেলে তদন্ত করে দেখবো। আর কাজের মান ভালো না হলে কাজ বন্ধ করে দেব।’ এ ব্যাপারে কালকিনি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মীর গোলাম ফারুক বলেন, ‘১৫টি কমিউনিটি ক্লিনিকের কাজ চলেেছ আমি জানি না। কাজের কোন ধরনের কাগজপত্র আমি পাইনি।’ 

কাজের অনিয়মের ব্যাপারে মাদারীপুর সিভিল সার্জন মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমি ইঞ্জিনিয়ার না। আমি কাজের মানের ব্যাপারে কোন কিছু জানি না। আমার অফিসের পাশে স্বাস্থ্য বিভাগের ইঞ্জিনিয়ার ডিপার্টমেন্ট আছে। তাদের সাথে যোগাযোগ করুন। তারা বলতে পারবে কাজের ভালো-মন্দের ব্যাপারে।’

এব্যাপারে স্বাস্থ্য বিভাগের মাদারীপুর জেলা তত্ত্বাবধায়ক প্রকেীশলী আব্দুল হান্নান শেখের কাছে কাজের অনিয়মের কথা ও কাজ বন্ধের কথা জানতে চাইলে তিনি উল্টো কালের কন্ঠের  কাছে জানতে চান, কোন কমিউনিটি ক্লিনিকের কাজের কি কি ত্রুটি আছে ও কোনটি কোনটি বন্ধ আছে আমাকে বলেন। কয়েকটি কমিউনিটি ক্লিনিকের কাজ বন্ধের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভাই আমরা পারি ঠিকাদারকে চিঠি লিখতে ও জরিমানা করতে। আর কী করতে পারি? তবে ঠিকাদার কাজ করবে। কাজের মান ভালো না এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি শুনেছি কমিউনিটি ক্লিনিকে কাজ ভালো হয়েছে। আপনি যদি দুই-তিন মাস আগের করা বলেন তা কি হবে। আপনি বর্তমানের কথা বলেন।

ইনিউজ ৭১/এম.আর