
দলের মধ্যে শুদ্ধি অভিযানের অংশ হিসেবে সারা দেশে অনুপ্রবেশকারীদের তালিকা প্রণয়ন করছে আওয়ামী লীগ। বরিশাল বিভাগে ৪৩৩ জনের অনুপ্রবেশকারী নাম, ঠিকানা, পরিচয় ও আগের দলের তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। বরিশাল অ লে আওয়ামী লীগের অনুপ্রবেশকারীদের তালিকায় দেখা যায়, বিভাগের ৬ জেলায় মোট অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা ৪৩৩ জন। এ তালিকায় অনুপ্রবেশকারীর শীর্ষে রয়েছে ভোলা এবং বরিশাল জেলা। এর মধ্যে বরিশালের ৫টি উপজেলা আওয়ামী লীগ এবং অঙ্গ সহযোগী সংগঠনে অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা ২৩১ জন ও ভোলায় ১৩৬ জন। এর বাইরে পটুয়াখালীতে ২৫ জন, ঝালকাঠিতে ১৫ জন, পিরোজপুরে ১০, বরগুনা জেলায় ১০ জন ও বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারী মাত্র ৬ জন।
প্রকাশিত তালিকাটি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বরিশাল জেলার যে তালিকাটি প্রনয়ণ হয়েছে তাতে মাত্র ৫টি উপজেলার নাম রয়েছে। তাছাড়া বরিশাল জেলায় আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারী ২৩১ জনের মধ্যে ২২৫ জনই মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার। অপর চারটি উপজেলার মধ্যে হিজলা উপজেলায় ২১ জন, উজিরপুরে ৭ জন, গৌরনদী ও বাবুগঞ্জ উপজেলায় রয়েছে ১ জন করে। তবে তালিকায় নেই বরিশাল সদর উপজেলা, আগৈলঝাড়া, বানারীপাড়া, বাকেরগঞ্জ ও মুলাদী উপজেলার নাম।অনুপ্রবেশকারীর তালিকায় বরিশাল মহানগরে রয়েছেন ৬ জন। তারা হলেন, কাউনিয়া ভাটিখানার তৌহিদুল ইসলাম বাদশা, কাউনিয়া ব্রা রোডের মোঃ কাওছার বিশ্বাস, পশ্চিম কাউনিয়ার আউয়াল মোল্লা ও সাবেক কাউন্সিলর নাসিরউদ্দিন হাওলাদার, কাউনিয়া থানাধীন কাগাশুরার রাসেল মুন্সী ও কাউনিয়া কামারপাড়ার মোঃ ইব্রাহিম হাওলাদার। তবে বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রবেশকারীর নাম তালিকায় প্রকাশ পেয়েছে।
তালিকায় যাদের নাম এসেছে তারা বিএনপি, জামায়াত-শিবির এবং ফ্রীডম পার্টি থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েই ‘পরশ পাথরের’ ছোঁয়ায় সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক, সহ-সভাপতি, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, সাংগঠনিকসহ গুরুত্বপূর্ণ পদ-পদবি পেয়েছেন। কেউ কেউ উপজেলা, ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ও পৌর মেয়রও হয়েছেন বঙ্গবন্ধুর প্রতীক নৌকা নিয়ে। তারাই এখন ছড়ি ঘুরাচ্ছেন জেলা-উপজেলা ও ইউনিয়নে। পরিস্থিতি এমন যে কোথাও কোথাও নব্য আওয়ামী লীগারদের হাতে আওয়ামী লীগ বা তার সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা মার খাচ্ছেন, অপমান-অপদস্ত হচ্ছেন। তাদের পক্ষে এখন আওয়ামী লীগ করাই দুরূহ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে এসব নেতার অনুপ্রবেশ ঘটেছে টানা ১০ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা দলটিতে। এসব নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশও করা হয়েছে তালিকায়। দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, অনুপ্রবেশকারী, বিতর্কিত বা অপকর্মকারী কেউ যেন আওয়ামী লীগের কোনও পর্যায়ের নেতৃত্বে না আসতে পারে, এ ব্যাপারে দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দিয়েছেন।
সূত্রে জানা যায়, নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিশাল জয়ের পর থেকেই দলের বিভিন্ন স্তরে শুরু হয় ব্যক্তিকেন্দ্রিক দলভারি করার প্রবণতা। কেন্দ্রীয় নেতা, মন্ত্রী-এমপিরা নিজ বলয় ভারি করতে ‘ফুলের তোড়ায়’ বরণ করে নেন বিএনপি ও জামায়াত-শিবির নেতাদের। যাদের অনেকের বিরুদ্ধে ছিল আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী হত্যাসহ নাশকতা ও অবৈধ অস্ত্রের একাধিক মামলা। এমনকি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনীর দেহরক্ষীর নাম উঠে এসেছে আ’লীগে অনুপ্রবেশকারীর তালিকায়। দল বদল করে আওয়ামী লীগে এসে রাতারাতি পুনর্বাসিত হয়েছেন তারা। শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধুর আদর্শবিরোধী ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধীরা এখন জেলা-উপজেলায় চালকের আসনেও বসেছেন। ‘অন্য দল থেকে আওয়ামী লীগে নয়’ দলের হাইকমান্ডের এমন নির্দেশনা থাকলেও তোয়াক্কা করেননি মন্ত্রী-এমপি ও নেতারা।
প্রকাশিত ওই তালিকা নিয়ে আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মধ্যে অনেকটা ক্ষোভের স ার হয়েছে। দাবি তুলেছেন সঠিকভাবে অনুপ্রবেশকারীদের তালিকা করার। যদিও প্রকাশ পাওয়া অনুপ্রবেশকারীদের তালিকার দায় নিতে নারাজ আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ের শীর্ষ নেতারা। জানা গেছে, বিএনপি ও জামায়াত-শিবির ছেড়ে আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশ শুরু হয় ২০০৯ সাল থেকে। আর এই অনুপ্রবেশ স্রোতের আকার ধারণ করে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন পূর্ব ও পরবর্তী চারদলীয় জোটের সহিংস আন্দোলন দমে যাওয়ার পর থেকে। দেশের তৃণমূল পর্যায়ে এখন বিএনপি-জামায়াত খুঁজে পাওয়া ভার। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার এবার টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর স্থানীয় পর্যায়ে যেন সবাই আওয়ামী লীগ হয়ে গেছে। যাদের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ‘কাউয়া’ এবং ‘হাইব্রিড’ নামে অভিহিত করে আলোচিত হয়েছিলেন। বর্তমানে বাস্তবতা এমন যে এসব নব্য আওয়ামী লীগারদের দাপটে সারা দেশে মূল স্রোতের আওয়ামী লীগাররাই কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন।
বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ‘মহানগর এবং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারীদের সঠিকভাবে তালিকা হলে অধিকাংশ দাপুটে নেতাই নামই চলে আসবে এই তালিকায়। কেননা মহানগর এবং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতাই বিএনপি ও জাতীয় পার্টি থেকে আসা। বিশেষ করে প্রয়াত শওকত হোসেন হিরন মেয়র থাকাবস্থায় আওয়ামী লীগে হঠাৎ করেই গণজোয়ার সৃষ্টি হয়। ওই জোয়ারের সাথেই ভেসে আসে অনুপ্রবেশকারীরা। আর যারা এসেছেন তাদের মধ্যে বেশিরভাগ বিএনপির। এদের মধ্যে অনেকেই আবার শওকত হোসেন হিরনের হাত ধরে পেয়েছেন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব। আওয়ামী লীগের স্থানীয় সমর্থনে হয়েছেন ওয়ার্ড কাউন্সিলরও। মহানগর আওয়ামী লীগে এমন অনেক নেতাই রয়েছেন যারা ইতিপূর্বে বিএনপি’র দায়িত্বশীল পদে ছিলেন। অথচ তাদের কারো নামই নেই অনুপ্রবেশকারীদের তালিকায়। ফলে চলমান শুদ্ধি অভিযান প্রশ্নবিদ্ধ হবে বলে মনে করছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা।

এ বিষয়ে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এ্যাডভোকেট গোলাম আব্বাস চৌধুরী দুলাল বলেন, ‘আমরা আগে থেকেই অনুপ্রবেশকারীদের বিষয়ে সতর্ক রয়েছি। ওয়ার্ড পর্যায়ে আওয়ামী লীগের যে সম্মেলন চলছে সেখানেও অনুপ্রবেশকারী, মাদকাসক্ত, মামলার আসামিসহ কোন বিতর্কিতদের স্থান দেয়া হচ্ছে না। তালিকা প্রনয়ণের বিষয়ে আমাদের কোন হাত নেই। বিভিন্ন আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী কেন্দ্র থেকেই এই তালিকা করা হচ্ছে। তাই এখানে অনুপ্রবেশকারীদের কেউ বাদ পড়লে সেখানে আমাদের করার কিছু নেই।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের প্রশ্ন, তাহলে আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ গণমানুষের কিংবা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মানুষের দখলে নয়, লুটেরা ও স্বাধীনতাবিরোধীদের দখলে চলে যাবে। আওয়ামী লীগ গণমানুষের এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মানুষের এবং তাদের দখলেই থাকুক। তা হলে আওয়ামী পথ হারাবে না। দেশও এগিয়ে যাবে।
ইনিউজ ৭১/এম.আর