হাজারো কোটি টাকার কাজের দায়িত্বে ‘জি কে বিল্ডার্স’

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: শনিবার ২১শে সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১২:২৬ অপরাহ্ন
হাজারো কোটি টাকার কাজের দায়িত্বে ‘জি কে বিল্ডার্স’

আওয়ামী লীগ সরকারের অনেক প্রভাবশালী নেতার সঙ্গে সখ্যতা আছে আলোচিত যুবলীগ নেতা ও ঠিকাদার এস এম গোলাম কিবরিয়া শামীমের (জি কে শামীম)। রাজনীতিবিদদের সখ্যতার প্রভাব খাটিয়ে তিনি নিজের প্রতিষ্ঠান জি কে বিল্ডার্সের মাধ্যমে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করতেন। দীর্ঘ সময় ধরে টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করার কারণে তিনি হয়ে উঠেছিলেন অঘোষিত ‘টেন্ডার কিং’। গতকাল শুক্রবার বিকালে গুলশান নিকেতনের নিজের কার্যালয় থেকেই র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‍্যাব) একটি দল শামীমকে গ্রেপ্তার করে। এ সময় তাঁর দপ্তর থেকে প্রায় দুইশ কোটি টাকার এফডিআর, নগদ প্রায় পৌনে দুই কোটি টাকাসহ অস্ত্র ও মাদক উদ্ধার করা হয়।

আটকের পর শামীমকে প্রাথমিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করে র‍্যাব। তাতে তাঁর অবৈধ কর্মকাণ্ডের অনেক তথ্য বেরিয়ে আসে বলে জানা গেছে। জিজ্ঞাসাবাদের সময় উপস্থিত ছিলেন র‍্যাবের এমন একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এসব তথ্য জানিয়েছেন। র‍্যাবের ওই কর্মকর্তা নাম গোপন রাখার শর্তে বলেন, ‘রাজধানী জুড়েই শামীমের টেন্ডার অধিপত্য আছে। তাঁর ভয়ে অধিকাংশ লোকই টেন্ডার জমা দিতেন না। কেউ জমা দিলে তাঁকে ভয়-ভীতি দেখানো হত। আবার তাঁর নিজের একাধিক লোকই টেন্ডার জমা দিতো। এগুলো ছিল টেন্ডার বাগানোর পরিকল্পনার অংশ।’

যদিও জি কে শামীমের কার্যালয়ের একজন কর্মচারী দাবি করেছেন, তাঁরা অবৈধভাবে কিছু করতেন না। তাদের অনেক কাজ আছে। সেখানে কর্মচারীরা কাজ করেন। তাদের বেতন ও মালামাল কেনার জন্য প্রচুর টাকার প্রয়োজন হয়। এ কারণেই কার্যালয়ে নগদ টাকা পাওয়া গেছে। এ সময় ওই কর্মচারী তাদের কোম্পানির চলমান কাজের একটি তালিকাও সরবরাহ করেন। তাতে দেখা যায়, রাজধানীতে কয়েক হাজার কোটি টাকার ভবনের নির্মাণকাজের দায়িত্বে আছে ‘জি কে বিল্ডার্স’। যদিও এসবের সত্যাসত্য তাৎক্ষণিকভাবে নির্ণয় করা যায়নি।

জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে ওই র‍্যাব কর্মকর্তা আরো বলেন, 'যুবলীগের পরিচয় দিয়ে শামীম টেন্ডারবাজি করতেন। বহু নেতার সঙ্গে তোলা ছবি দেখিয়ে ভয় দেখাতেন অন্যদের। আর তাঁকে না জানিয়ে কেউ টেন্ডার জমা দিলে তাঁকে নানাভাবে হয়রানি করা হতো। ভয় দেখিয়ে টেন্ডার হাতিয়ে নিতেন শামীম। এ ছাড়া চাঁদাবাজি থেকে তিনি বিপুল পরিমাণ অবৈধ টাকাও আয় করতেন। এসব পন্থা অবলম্বন করে শামীম হাজার কোটি টাকার মালিকও হয়েছেন।’ এ ছাড়া এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘শামীমের বিরুদ্ধে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজির অসংখ্য অভিযোগ ছিল অনেক আগে থেকেই। এ ছাড়া ঢাকা দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তারের পর তিনিও কিছু তথ্য দিয়েছেন।’
অনেকের কাছে শামীম ‘টেন্ডার কিং’ হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। গোয়েন্দাদের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, ঢাকাতে তাঁর একাধিক বাড়ি রয়েছে। নিকেতন এলাকায় তাঁর একাধিক ফ্ল্যাটও রয়েছে। শুধু তাই নয়, দেশের বিভিন্ন স্থানে তাঁর প্রচুর সম্পত্তিও রয়েছে।

র‍্যাব সদর দপ্তরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে আমরা তাঁকে আটক করেছি। তাঁর দেহরক্ষীদের অস্ত্রের লাইসেন্স থাকলেও সেসব অস্ত্র চাঁদাবাজির ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হতো বলে অভিযোগ আছে। তাঁর সাতজন দেহরক্ষীকে আমরা আটক করেছি। অস্ত্র ও গুলি জব্দ করেছি। তাঁর অফিসে মদও পেয়েছি, যেটা ঘৃণিত কাজ। তাঁর অফিস কক্ষে নগদ এক কোটি ৮০ লাখ টাকা পেয়েছি। এ ছাড়া ১৬৫ কোটি টাকার এফডিআরের কাগজ ও আমেরিকান ডলার পেয়েছি।’

পরে সারওয়ার আলম বলেন, শামীমের বিরুদ্ধে নিয়মিত আইনে মানি লন্ডারিংয়ের মামলা করা হবে। এ ছাড়া মাদকের মামলাও করা হবে। তবে আটকের পর শামীমের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা দিদারুল আলম বলেন, 'আমার স্যার কোনো অপরাধ করেননি। স্যারের অফিসে শত শত কোটি টাকার টেন্ডার হয়। এই অফিসে নগদ টাকা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। প্রতিদিন কর্মচারীদের বেতন দিতে হয়। নানা ধরনের কাজে টাকা লাগে।' দিদারুল আলম আরো বলেন, ‘এখন অন্তত ২২টি সরকারি টেন্ডারের কাজ চলছে। স্যার, আটক থাকলে এই কাজগুলো বন্ধ হয়ে থাকবে। এতে সরকারেরই ক্ষতি হবে। আমার স্যারকে অবৈধভাবে ধরা হয়েছে।’

এ সময় দিদারুল আলম একটি টেন্ডারের তালিকা দেন গণমাধ্যমকে। সেখানে দেখা যায়, জি কে বিল্ডার্স বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, পঙ্গু হাসপাতাল, মিরপুর ৬, মহাখালী ডাইজেস্টিভ, অ্যাজমা সেন্টার, ক্যানসার হাসপাতাল, সেবা মহাবিদ্যালয়, বেইলি রোডের পার্বত্য চট্টগ্রাম কমপ্লেক্স, সচিবালয় কেবিনেট ভবন, এনবিআর, নিউরো সায়েন্স, বিজ্ঞান যাদুঘর, পিএসসি, এনজিও ফাউন্ডেশন ও র‌্যাব হেডকোয়ার্টার্সের নির্মাণকাজের দায়িত্ব পেয়েছে।

ইনিউজ ৭১/এম.আর