পদ্মাসেতু ঘিরে অপার সম্ভাবনা, অপেক্ষায় দক্ষিণাঞ্চলবাসী

নিজস্ব প্রতিবেদক
এম. কে. রানা - বার্তা প্রধান ইনিউজ৭১
প্রকাশিত: রবিবার ৯ই জুন ২০১৯ ১১:১৭ অপরাহ্ন
পদ্মাসেতু ঘিরে অপার সম্ভাবনা, অপেক্ষায় দক্ষিণাঞ্চলবাসী

স্বপ্নের পদ্মা সেতু। দক্ষিণা লবাসীর স্বপ্নের সেতু। বিদেশী নানান কুটচালে নশ্চাৎ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল সেতু নির্মাণ কাজ। তবে উন্নয়নের সরকার বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সভাপতি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণের উদ্যোগ নিয়ে দক্ষিণা লবাসীর সেই স্বপ্নের বাস্তবে রূপ দেন। ইতিমধ্যে ত্রয়োদশ স্প্যান বসানোর মাধ্যমে মূল সেতুর প্রায় দুই কিলোমিটার দৃশ্যমান হয়েছে। এখন শুধু নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার ব্যাপার মাত্র। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই সেতুটির নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। এই সেতু ঘিরে অপার সম্ভাবনার দুয়ার খুলছে দক্ষিণাঞ্চলে। এটি বাস্তবে রূপ নিলে স¤প্রসারিত হবে দক্ষিণ-পশ্চিমা লের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড। সেতু ঘিরে সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন হবে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের। গতি ও মাত্রা বাড়বে অভ্যন্তরীণ ও আন্তঃদেশীয় যান চলাচলের। সবমিলিয়ে সেতুর উভয় পাশে বিকাশ ঘটবে সুষম অর্থনীতির। এতে আগামীতে জিডিপি ১ দশমিক ২ শতাংশ বাড়বে বলে আশা করছেন অর্থনীতিবিদরা।

স¤প্রতি পদ্মাসেতু নির্মাণ প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা যায়, মাওয়া-জাজিরা উভয় প্রান্তে পদ্মাসেতু নির্মাণ এবং এ প্রকল্প সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। ত্রয়োদশ স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান হয় স্বপ্নের সেতুর প্রায় দুই কিলোমিটার অংশ। জাজিরা পয়েন্টে নদীশাসনের পাশাপাশি সংযোগ সড়ক, ওজন সেতু এবং টোল প্লাজার কাজও শেষ। এছাড়া সেতু ঘিরে ফরিদপুর ভাঙা এলাকায় চলছে কর্মযজ্ঞ। যা দেখে মনেই হবেনা এটা বাংলাদেশ। এমন অভিমত দর্শনার্থীদের। কেননা পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ দেখতে প্রতিদিন বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হাজার হাজার মানুষ আসছে। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা। তবে মাওয়া অংশের সংযোগ সড়ক এবং অন্যান্য অংশের কিছু কাজ নিয়ে আরও অল্প কিছু সময় প্রয়োজন হবে। তবে সেটা যে অনেক বেশি সময়ের ব্যাপার নয়, তা-ও জানিয়ে দিচ্ছেন কর্মকর্তারা। তারা আরও বলছেন, চ্যালেঞ্জিং ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলো শেষ হয়ে যাওয়ায় বাকি কাজ বড় ধরনের জটিলতা ছাড়াই শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

পদ্মাসেতুর মহাযজ্ঞের কারণে ইতোমধ্যে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার মাওয়া এবং মাদারীপুরের জাজিরা উপজেলার গ্রামীণ অর্থনীতিতে। আশেপাশে লোকেরাই কাজ করছেন সেতু প্রকল্পের বিভিন্ন কাজে। আবার দেশের অন্য জেলা থেকে প্রকল্প এলাকার আশেপাশে এসে বসবাস শুরু করা কর্মীরাও অবদান রাখছেন এই অর্থনীতিতে। অন্যদিকে প্রকল্পে কর্মরত বিদেশিদের কেনাকাটায় ব্যবসা হচ্ছে স্থানীয়দের।

২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর দক্ষিণাঞ্চলের স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করা হয়। এ সময় সেতুর উভয় পাশে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড উৎসাহিত করতে নীতি-প্রণোদনা ঘোষণা, গ্যাস সংযোগের ব্যবস্থা, দক্ষিণে বিসিক শিল্পনগরীগুলো চালু ও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল (বেজা) মাধ্যমে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স¤প্রসারণে কার্যক্রম গ্রহণ করার কথা বলা হয়। পাশাপাশি সেতুর দক্ষিণ-পশ্চিমা লে শিল্প স্থাপনের সহায়ক নীতি গ্রহণ, মাশুল আদায়ে স্বয়ংক্রিয় ইলেকট্রনিক ব্যবস্থা, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রবাহে ফাইভার অপটিক ক্যাবল স্থাপনের কথা উলে¬খ করা হয়। এছাড়া মাস্টার প্লানের আওতায় সেতুর উভয় পাশে উন্নয়নের ব্যবস্থা, পৃথক উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠন, রেল সংযোগ স্থাপন, স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে লাভজনক অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত করার পাশাপাশি প্রকল্প এলাকায় ৪টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও ৪টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১টি জাদুঘর, পর্যটন আকর্ষণে নদীর উভয় পাশে ইকোপার্ক স্থাপনের কথা রয়েছে।

জাজিরা প্রান্তের বাসিন্দা প াশোর্ধ্ব হালিম সরদার জানান, সেতু প্রকল্পের পাইনপাড়া, করুলী চরে বিভিন্ন ধরনের পণ্য নিয়ে বিক্রি করেন তিনি। চরগুলোতে থাকা প্রায় ২০টি দোকানের মধ্যে তার একটি। পদ্মাসেতুর কারণে নিজেদের জীবনযাত্রার পরিবর্তনের আশা দেখা এই প্রৌঢ় বলেন, নদীর পাড়ে থেকে শুধু নদীর পাড় আর জীবনের ভাঙন দেখেছি। পদ্মাসেতু হলে আমাদের ছেলে-মেয়েরা সহজে ঢাকা যেতে পারবে। আবার যারা এখন ঢাকা থাকে, তখন তারা বাড়িতে থেকেও ঢাকার কাজ করতে পারবে। আমরা এখানকার বাজারে আমাদের গাছের কাঁঠাল, আম, কলা এবং অন্যান্য জিনিস বিক্রি করি। পদ্মাসেতু হলে সরাসরি ঢাকা নিয়েও বিক্রি করতে পারবো।

শরীয়তপুরের বাসিন্দা খিজির মাতবর বলেন, পদ্মাসেতুর কারণে এই এলাকার ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার হবে। সেতু নির্মাণ কাজ শেষ হয়ে গেলে আমাদের কাজের সুযোগ আরও বাড়বে। বিশেষ করে রাজধানীর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের কারণে ভিটে-মাটি না ছেড়েই ঢাকা গিয়ে কাজ করতে পারবো। সরকার এ এলাকার যে উন্নয়ন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে এবং উন্নয়ন করছে তাতে আমাদের জীবন আরও উন্নত হবে। তিনি বলেন, এখন আর আমাদের জমি নদীতে বিলীন হওয়ার শঙ্কা নেই। আমাদের ঘর-বাড়ির আশেপাশে কী সুন্দর এলাকা তৈরি করা হয়েছে! কতো সুন্দর আর প্রশস্ত রাস্তা! তাই সেতুর কাজ শেষ হলেই হয়। সেতুর কাজ যত তাড়াতাড়ি শেষ হবে, আমাদের স্বপ্ন পূরণের যাত্রা ততো তাড়াতাড়ি শুরু হবে। পদ্মাসেতুর নির্মাণ কাজে অংশগ্রহণকারী শাহাদৎ নামের এক কর্মীর সাথে কথা হয়। তিনি বলেন, সেতুটি যত তাড়াতাড়ি নির্মিত হবে ততোই উপকৃত হবে আমাদের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ। বিশেষ করে ঢাকার সাথে স্বল্প সময়ের মধ্যে যোগাযোগ, চিকিৎসা সেবা, অর্থনৈতিক সুবিধাসহ নানাবিধ সুবিধা ভোগ করবে দুই পাড়ের বাসিন্দারা।

অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, পদ্মা সেতু নির্মিত হলে অর্থনৈতিকভাবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সম্পৃক্ততা পরিপূর্ণ হবে। এর অনেক ইতিবাচক প্রভাব অর্থনীতিতে পড়বে। এর মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হবে। এতে সময় বেঁচে যাবে। এর উপকার আসবে অর্থনীতিতে। বাজারজাতকরণের দিক থেকে অর্থনীতির উপকার হবে। এছাড়া বিনিয়োগ সম্ভাবনা বাড়বে ওইসব অঞ্চলের। এর ইতিবাচক প্রতিফলন জিডিপিতে পড়বে। তিনি আরও বলেন, এর সঙ্গে অন্যান্য অবকাঠামো বিশেষ করে বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস স¤প্রসারণ করতে হবে ওইসব অঞ্চলে। তা করা হলে বিনিয়োগে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ অর্থনীতিবিদ মনে করেন পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নে হচ্ছে। এ জন্য বিনিয়োগ থেকে যে সুফল পাওয়া যায় সেটা যেন সর্বোচ্চ কাঙ্খিত হয়। এখন অপেক্ষা শুধু বাংলাদেশের গর্ব পদ্মাসেতুর কাজ শেষ হওয়ার।

ইনিউজ ৭১/টি.টি. রাকিব