মাইনসের সেবা কইর‌্যাই মোগো ঈদ আনন্দ

নিজস্ব প্রতিবেদক
এম. কে. রানা - বার্তা প্রধান ইনিউজ৭১
প্রকাশিত: সোমবার ৩রা জুন ২০১৯ ১১:২৮ অপরাহ্ন
মাইনসের সেবা কইর‌্যাই মোগো ঈদ আনন্দ

মোগো আবার ঈদ (!) মোরা মানুষের সেবা কইর‌্যাই ঈদ আনন্দ খুঁজি। তয় হারা বছর কাম কইর‌্যা যদি পোলা মাইয়ারে কিছু কিন্না (ক্রয় করে) না দেতে পারি হ্যালে রাস্তা কুড়াইন্না-ই ভাল।  হ্যারপন্নে ঈদের মধ্যেও মোরা গাড়ি চালাই। টাহাও আয় অপ আবার মানুষের সেবাও করি মোরা। দুইডাই বা কম কিসে? হ্যাছাড়া কিছু বাড়তি আয় অইলে পোলাপানের পইন্না জামা কাপুর কিনমু। অগো আনন্দই মোগো সুখ। কথাগুলো বলছিলেন রিক্সাচালক বারেক মিয়া।

প্রতি বছরই ঈদ আসে ঈদ যায়। কিন্তু শ্রেনী ভেদে ঈদ উপভোগের পার্থক্য থাকে। যেমনটি ধনী-দরিদ্র, শিশু-বৃদ্ধদের বেলায়। তবে একেক শ্রেনী পেশার মানুষ একেকভাবে ঈদ উপভোগ করেন। কেউবা আভিজাত্যে কেউবা পথে প্রান্তরে ঈদ কাটান। অবশ্য আনন্দের ঘাটতি থাকলেও দরিদ্র দিনমজুর ও শিশুদের বেলায় অন্যরকম অনুভুতি কাজ করে। 

ঈদ উপলক্ষে রাজধানীর অধিকাংশ মানুষ শেকড়ের টানে বাড়ি আসে। আবার বরিশাল থেকেও অনেকে গ্রামের বাড়িতে যায় শেকড়ের টানে। তবুও রাজধানী ঢাকার মতো জেলা শহরগুলোতে এক শ্রেনীর মানুষ থেকে যায়। তাদের উলে¬খযোগ্য সংখ্যক মানুষ শ্রমজীবী। এদের কেউ রিকশা চালক, কেউ অটোরিক্সা, কেউ আলফা মাহিন্দ্রা, কেউ বাস আবার কেউ সিএনজি চালান। ঈদের দিন সবার জন্য আনন্দের হলেও তাদের অনেকের মনেই আনন্দ নেই। অভাব তাদের আনন্দ অনেকটাই ফ্যাকাসে করে দিয়েছে। তাই তারা পরিবার-পরিজন ছেড়ে শহরেই রয়ে গেছেন। বাড়তি কিছু আয়ের জন্য তারা রাস্তায় নেমেছেন। ঈদ উপলক্ষে ঘরে ফেরা মানুষদের গন্তব্যে পৌঁছে দিয়ে যদি দুটাকা বেশি রোজগার করা যায় তাহলে প্রিয় সন্তানদের জন্য কিছু কিনতে পারবেন এমন ভরসায়। ঈদের দিন যারা পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনকে নিয়ে বাইরে বের হন, তাদেরকে গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করেন তারা। এই সময় আবার অনেকে রিকশায় করে ফাঁকা নগরী ঘুরে দেখার স্বাদ জাগে। সেই স্বাদও মেটান তারা। আর এভাবেই কাটে শ্রমজীবী মানুষের ঈদ আনন্দ।

নগরীর কাউনিয়া এলাকার রিক্সাচালক শওকত মিয়া। এলাকায় দিনমজুরের কাজ করলেও এখন এলাকায় কাজ নেই। সংসার চালাতে তো টাকার প্রায়োজন। কাজ না করলে সেই টাকা পাবেন কই? তাই নগরীতে এসেছেন রমজানের শুরুতে। উদ্দেশ্য রিকশা চালাবেন। তাই কাউনিয়া এলাকায় পরিচিত একজনের মাধ্যমে একটি গ্যারেজ থেকে রিকশা নিয়ে নেমে পড়েন সড়কে।
তিনি বলেন, রিকশার দৈনিক জমা দিতে হয় ৬০ টাকা। রাতে ফিরে খাওয়া দাওয়া সবই ওই গ্যারেজে। থাকা খাওয়া বাবদ গ্যারেজ ম্যানেজারকে দিতে হয় আরও ৯০ টাকা। বিনিময়ে তিনি সকালে আলু ভর্তা বা ভাজি আর পাতলা ডাল দিয়ে গরম ভাত খেয়ে রিকশা নিয়ে নেমে পড়েন। সুযোগ মতো দুপুরে এসে এক প্রকার সবজি ও ডাল দিয়ে ভাত খেয়ে কিছুটা সময় বিশ্রাম নিয়ে আবারও রাস্তায় নামেন রিকশা নিয়ে। আর রাতে যখনই ফেরেন তখন ওই একই ধরনের খাবার খেয়ে গ্যারেজের পাটাতনের ওপরই ঘুমিয়ে পড়েন। এই নিয়মেই চলছে রমজানের শুরু থেকে। 

ঈদের দিনেও রাস্তায় নামবেন কিনা এমন প্রশ্নে অটো চালক জামাল বলেন, “মোরা গরীব মানুষ। মোগো আবার ঈদ। দুই মাইয়া পোলা লইয়া চাইর জনের সংসার। সংসার চালাইতে তো টাহা লাগে। ঈদের সোমায় মাইয়া পোলারে লইয়া ঘোরতে মনে চায়। কিন্তু অভাবের সংসারে স্বাদ আল্লাদ (আহ্লাদ) মিডাইতে পারিনা। প্যাডের খিদায় ঈদেও গাড়ি চালামু”।
আলফা চালক লিটন বলেন, “ হারা রোজায় গাড়ি চালাইয়া উলডা লস অইছে। ঈদের মধ্যে যদি কয়ডা টাহা পাই হেরপন্নে গাড়ি চালামু। হ্যাছাড়া মানুগুলারেওতো বাড়ি পৌছাইয়া দেতে অইবে। ব্যাডারা কত কস্ট কইর‌্যা ঢাকা, খুলনা, চট্টগ্রাম দিয়া বাড়ি আইছে। হ্যারা মোগো মেহমান, হ্যাগো যাতে কষ্ট না অয় হেইডাইওতো মোগো দ্যাহা উচিত। 

রিক্সাচালক মঞ্জু মিয়া সাথে দেখা হয় সিটি কর্পোরেশনের সামনের ফুটপাতে। স্ত্রী সন্তান নিয়ে এসেছে ঈদ বাজার করতে। তিনি বলেন, “কিছু বাড়তি আয়ের জন্যই যাইনাই। ঈদের দিন রিকশা নিয়ে সকালেই নামমু”। ঈদে অনেক যাত্রীরাই নির্ধারিত ভাড়ার কিছু বেশিই দেয়। মোরাতো আর বড় বড় দোহানে যাইতে পারিনা, হেলইগ্যা বউ পোলা লইয়া এ্যাহানে আইছি। পোলার খুশিই মোর খুশি।”

রিক্সা চালক সেলিম মিয়া বলেন, “মেরা গরিব মানুষ। ঘরে বইয়া থাকলেতো আর পকেডে টাহা আইবে না। ঈদের ছুটি থাকপে ৭/৮ দিন। নগরীতে মানুষ নেই। যারা দ্যাশ বিদ্যাশ দিয়া বাড়ি আইছে হ্যাগো ধার দিয়া কিছু কামাইতে পারি হেইয়া দিয়া কয়ডা দিন চলা যাইবে। হেরপন্নে ঈদের দিনও গাড়ি নিয়ে রাস্তায় নামমু।’ অন্য সমায় তিন ঘন্টায় যা আয় করতাম, ঈদের দিন এক ঘন্টায় হেইয়া আয় করমু। ঈদের দিন তো কোনও সিটিং ফিটিং থাহে না। লোকজন যা পাই হেইয়াই উডাই। রাস্তায় গাড়ি কম দেইক্যা বকশিসসহ ভাড়াও বেশি। তাই আয়ও বেশি।’

বাংলাদেশে আর একদিন বাদেই ঈদুল ফিতর। দেশের অনেক মানুষ যখন ঈদ কেনাকাটা নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও দেশের অসহায় দরিদ্র পরিবারগুলোতে নেই ঈদ নিয়ে কোন আয়োজন, নেই কোন কেনাকাটার ধুম। তবুও তারা যাত্রীসেবা দিয়েই তার মধ্যে ঈদ আনন্দ উপভোগ করে থাকেন। সবাই ভাল থাকুন এটাই কামনা। ঈদ মোবারক।