যৌন নিপীড়কদের ক্ষমা নেই: প্রধানমন্ত্রী

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: মঙ্গলবার ৩০শে এপ্রিল ২০১৯ ১০:৫২ পূর্বাহ্ন
যৌন নিপীড়কদের ক্ষমা নেই: প্রধানমন্ত্রী

যৌন নিপীড়নকারীদের ক্ষমা হবে না বলে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা; বলেছেন, প্রয়োজনে ধর্ষণের জন্য ‘সর্বোচ্চ শাস্তি’ নির্ধারণ করে নতুন আইন হবে। সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের ঘটনার প্রেক্ষাপটে সোমবার সংসদে এক সাধারণ আলোচনায় সরকার প্রধানের এই হুঁশিয়ারি আসে। শেখ হাসিনা বলেন, “সংসদ সদস্যরা একটি কঠোর আইন করার কথা বলেছেন। আমরা মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে বিচারের ব্যবস্থা করছি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ বিষয় নিয়ে কাজ করছে। প্রয়োজনে এর জন্য কঠোর আইন করতে হয়, অবশ্যই আমরা তা করব। যারা এ ধরনের যৌন নিপীড়ন করবে, যেন সর্বোচ্চ শাস্তি হয় সেই ব্যবস্থা আমরা করব।”

সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ এদিন সংসদে একটি প্রস্তাব তোলেন। নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্ট চার্চের মসজিদ ও শ্রীলঙ্কার গীর্জা, হোটেলে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি শেখ ফজলুল করিম সেলিমের নাতি জায়ান চৌধুরীসহ বিপুল সংখ্যক মানুষকে হত্যা এবং ফেনীর সোনাগাজীতে মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে যৌন নিপীড়ন ও পুড়িয়ে মারার ঘটনায় গভীর ঘৃণা ও ক্ষোভ প্রকাশের পাশাপাশি সকল সন্ত্রাসী, যৌন নিপীড়নকারীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সকল দেশের সংসদ, সরকার ও নাগরিকদের নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানানো হয় সেখানে। আওয়ামী লীগ, জাসদ, জাতীয় পার্টি ও বিএনপির সংসদ সদস্যরা পরে ওই প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নেন। আলোচনা শেষে প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে সংসদ গৃহীত হয়।

ফেনীর নুসরাতের ঘটনা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমি ঘটনা শোনার সাথে সাথে ব্যবস্থা নিই। এই অধ্যক্ষের সঙ্গে আমাদের দলের কিছু নেতা জড়িত ছিল। আমি সাথে সাথে পুলিশকে নির্দেশ দিই- কে, কোন দল করে আমি দেখতে চাই না। অপরাধী অপরাধীই। তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই ধরনের ঘটনা কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না। “মেয়েদের ওপর নির্যাতন- শিক্ষক পূজনীয়, বাবার মত। শিক্ষকের কাছে শিখবে। সেই শিক্ষক রক্ষক হয়ে যদি ভক্ষক হয় আর যদি তা মাদ্রাসায় হয় তাহলে এর থেকে লজ্জার আর কী হতে পারে! তবে, জানি না যখন একটা ঘটনা ঘটে, আর তার প্রচার হয়, তখন দেখা যায় একটার পর একটা সিরিজ ঘটে যাচ্ছে।”

সংসদ নেতা বলেন, “যারাই এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকবে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই আমরা ব্যবস্থা নেব। দল মত আমি দেখব না। কে আমি তা দেখব না। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এই ধরনের যৌন নিপীড়ন যারা করবে তাদের ক্ষমা নেই।” বাংলাদেশের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন অনুযায়ী, ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। আর ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশুর মৃত্যু হলে দোষী ব্যক্তির সর্বোচ্চ শাস্তি হবে মৃত্যুদণ্ড। এর পাশাপাশি দুই ক্ষেত্রেই অর্থ দণ্ডের বিধান আছে। এ আইনের মামলায়  নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য সাত দিন থেকে এক মাস এবং মামলা নিষ্পত্তির জন্য একশত আশি দিন (ছয় মাস) সময় বেঁধে দেওয়া থাকলেও বাসতে ওই সময়ের মধ্যে রায় দেওয়া সম্ভব হয় না।

তাছাড়া ধর্ষণ এবং নারী ও শিশু নির্যাতনের এক একটি ঘটনা কিছু দিন পর পর সারা দেশকে নাড়া দিয়ে গেলেও এসব ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচার ও শাস্তির নজির কম। ধর্ষণের বেশিরভাগ মামলা বিচারের দীর্ঘসূত্রতায় ধামা চাপা পড়ে যায়। তাছাড়া ঠিকমত ডাক্তারি পরীক্ষা না হওয়া, সামাজিক জড়তা, প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপসহ নানা কারণে বিচার পাওয়া কঠিন হয়ে যায়। সরকারের হিসাব অনুযায়ী ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে ১৭ হাজার ২৮৯টি নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা হলেও তার মধ্যে মাত্র ৩ হাজার ৪৩০টি মামলার বিচার শেষ হয়েছে। নিম্ন আদালতে এসব মামলায় ১৭ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ৮০ জনের যাবজ্জীবনসহ ৬৭৩ জনের সাজা হলেও বাকি মামলার আসামিরা বিচারের বাইরেই থেকে গেছে।

এ কারণে ধর্ষণের অপরাধে শাস্তির মাত্রা বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ডের বিধান করার পাশাপাশি দ্রুততম সময়ে বিচার ও রায় কার্যকর করার জন্য আইন সংশোধনের দাবি রয়েছে বিভিন্ন সংগঠনের। যৌন নিপীড়নের প্রতিবাদ করায় আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়ার ঘটনা নিয়ে বলতে গিয়ে বিএনপি-জামায়াতের সরকারবিরোধী আন্দোলনের সময় পেট্রোল বোমার সন্ত্রাসের প্রসঙ্গ টানেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, “২০১৪ সালে আমরা অগ্নি সংন্ত্রাসের বিষয়টি দেখেছি। ওই সময় যদি একটি রাজনৈতিক দল অগ্নি সন্ত্রাস না করত, পুড়িয়ে মানুষ হত্যা না করত, তাহলে হয়ত ওই (ফেনীর মাদ্রাসার) অধ্যক্ষের মাথায় নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার চিন্তা আসত না। তার মাথায় এটা আসত কিনা সন্দেহ।“  জঙ্গিবাদকে একটি বৈশ্বিক সমস্যা হিসেবে বর্ণনা করে এর মোকাবিলায় বিশ্বব্যাপী জনমত সৃষ্টির ওপর জোর দেন শেখ হাসিনা।

শ্রীলঙ্কায় সাম্প্রতিক আত্মঘাতী বোমা হামলার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “শ্রীলঙ্কার চার্চে উৎসব ছিল। সেখানে প্রার্থনারতদের ওপর বোমা হামলা হল। এতে বাংলাদেশের জায়ান চৌধুরীসহ ৪২ জন বিদেশি মারা গেছে।… এই ঘটনার নিন্দা জানাই।”
এরপর ঢাকার গুলশান হামলার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের দেশেও চেষ্টা করা হয়েছিল- হোলি আর্টিজানে। আমরা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এই ঘটনা দমন করতে সক্ষম হই। এরপরে আরও ঘটনার চেষ্টা হয়েছে। আমাদের গোয়েন্দা সংস্থা, পুলিশ-র‌্যাব সকলে দিনরাত পরিশ্রম করে তদন্ত করে যখনই এ ধরনের ঘটনার এতটুকু আলামত পাওয়া যাচ্ছে সাথে সাথে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি।” এ বিষয়ে দেশের জনগণকেও সতর্ক থাকার এবং ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, “গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ ব্যাপারে তৎপর। তবে মানুষকেও এ ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে। কোথাও কোনো জঙ্গি সন্ত্রাসের সামান্য আলামত দেখলে সাথে সাথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে খবর দিতে হবে। সর্বস্তরের মানুষকে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে স্বোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানাব। সকলেকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।“ অন্যদের মধ্যে আমির হোসেন আমু, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, মতিয়া চৌধুরী, মোহাম্মদ নাসিম, শাহাজান খান, মেহের আফরোজ চুমকি, ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন, জাসদের মইন উদ্দিন খান বাদল, শিরিন আখতার, জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ, মশিউর রহমান রাঙ্গা, ফখরুল ইমাম ও বিএনপির হারুনুর রশীদ প্রস্তাবের ওপর আলোচনা করেন।

ইনিউজ ৭১/এম.আর