প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১:৩২
কোভিড-১৯ মহামারির আগে বাংলাদেশের আর্থিক প্রবৃদ্ধি ছিল ৭-৮ শতাংশের মধ্যে, যা দক্ষিণ এশিয়ার একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হিসেবে পরিচিত ছিল। তবে মহামারি পরবর্তী সময় থেকে সেই গতি আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। বিগত দুই অর্থবছরে ক্রমবর্ধমান বৈদেশিক ঋণ, রপ্তানি টিকিয়ে রাখার চ্যালেঞ্জ, এবং মুদ্রাস্ফীতি দেশের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে।
বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) মতে, বাংলাদেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৪-৫.১ শতাংশে নেমে আসতে পারে, যা পূর্ববর্তী অনুমানের চেয়ে অনেক কম। রাজনৈতিক সহিংসতা এবং অনিশ্চয়তা বিনিয়োগকারীদের আস্থায় আঘাত হানছে।
মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রার অবমূল্যায়ন
২০২৩ সালের মার্চ থেকে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের উপরে রয়েছে। খাদ্যে মূল্যস্ফীতি আরও প্রকট হয়ে অক্টোবরে ১২ শতাংশ ছাড়িয়েছে। ডলারের তুলনায় টাকার অবমূল্যায়ন ক্রমাগত বেড়ে জানুয়ারির তুলনায় ১.৬৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
বিদেশি বিনিয়োগে আস্থার ঘাটতি আরও গভীর হয়েছে। গত বছরের অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে বিদেশি বিনিয়োগ ছিল ৮৩৬ মিলিয়ন ডলার, যা চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চে কমে ৭৫২ মিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।
ব্যাংকিং খাতের সংকট
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে উচ্চ নন-পারফর্মিং লোন (এনপিএল) পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে যাচ্ছে। ২০০৮ সাল থেকে এনপিএল ৯.৫ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ২০২৩ সালের জুনে ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। এ ছাড়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আয় ২০২৩ সালের জুলাই-আগস্ট প্রান্তিকে ৫৫ বিলিয়ন টাকা কমেছে।
আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী প্রতি বছর রাজস্ব ০.৫ শতাংশ বৃদ্ধি করার লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও তা অর্জন করা যাচ্ছে না। আমদানি ঘাটতি ৫ শতাংশের বেশি এবং রপ্তানি আয় সামান্য ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। তৈরি পোশাক শিল্পে শ্রমিক অসন্তোষ ও সরবরাহ চেইনের জটিলতা রপ্তানির তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
ঋণ ও বৈদেশিক সাহায্যের চাহিদা
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় পদ্মা সেতু রেল সংযোগ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বৃহৎ প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য প্রচুর বিদেশি ঋণ নেওয়া হয়েছিল। এর ফলে ২০১৯ সালের বৈদেশিক ঋণ যেখানে ছিল ৩৮.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, তা ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর অর্থনীতির শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। অর্থনীতির উপর একটি শ্বেতপত্র তৈরি করতে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে একটি দশ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিদ্যুৎ, অবকাঠামো এবং ব্যাংকিং খাতের প্রধান সমস্যাগুলি চিহ্নিত করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক সাহায্য ও সহযোগিতা
অন্তর্বর্তী সরকার এডিবি এবং বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে জ্বালানি খাত সংস্কারের জন্য বাজেট সহায়তা হিসেবে ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার চেয়েছে। এ ছাড়াও আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ৪.৭ বিলিয়ন এএফএফ ঋণের সঙ্গে আরও ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সাহায্যের অনুরোধ করা হয়েছে।
বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সহযোগিতা বৃদ্ধির চেষ্টা করছে সরকার। যুক্তরাষ্ট্র থেকে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় ১৯৯ মিলিয়ন ডলার সহায়তা পাওয়ার কথা নিশ্চিত হয়েছে। তবে চীনের সাথে সোলার প্যানেল কারখানা স্থানান্তর এবং অন্যান্য সহযোগিতার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাড়া মেলেনি।
ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ
অন্তর্বর্তী সরকারের সময় পার হলেও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাবের কারণে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন প্রশ্নবিদ্ধ। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং কার্যকর অর্থনৈতিক নীতিমালা গ্রহণের মাধ্যমে স্থায়ী উন্নয়ন নিশ্চিত করার তাগিদ দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা। নির্বাচনের আগে এ অস্থিরতা কমানো সম্ভব না হলে দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য তা মারাত্মক আঘাত হতে পারে।