সবার চোখ আজ উচ্চ আদালতের দিকে। কারাবন্দি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ভাগ্য নির্ধারণ হবে আজ সোমবার। বহুল আলোচিত জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় জামিনের আবেদনের ওপর আজ আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানি হবে। শুনানিতে কী হবে খালেদা জিয়ার? তিনি জামিনে মুক্তি পাবেন, নাকি নিম্ন আদালতের রায়ই বহাল থাকবে? বিএনপির নেতাকর্মীসহ রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তিবর্গের মুখে এখন সে প্রশ্নগুলোই স্থান পাচ্ছে। অবশ্য ন্যায়বিচার পেলে খালেদা জিয়া মুক্তি পাবেন বলে আশাবাদী তার আইনজীবীরা। অন্যদিকে উভয়পক্ষের বক্তব্য শুনে উচ্চ আদালত সঠিক সিদ্ধান্ত দেবেন বলে জানিয়েছেন সরকারপক্ষের আইনজীবীরা।
খালেদা জিয়া জামিনে মুক্তি পেলে উন্নত চিকিৎসা নিতে বিদেশে যাবেন- তার বড় বোন সেলিনা ইসলামের এমন বক্তব্যের পর রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে ব্যাপক জল্পনা-কল্পনা। অবশ্য এ বিষয়ে দলের শীর্ষ নেতারা স্পষ্ট করে কিছু বলছেন না। তারা বলছেন, আগে তার মুক্তি হোক। কোথায় চিকিৎসা নেবেন- সে সিদ্ধান্ত খালেদা জিয়া নিজেই নেবেন।
এ পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক বিশ্নেষকদের অনেকে মনে করছেন, পরিবারের সদস্যরা খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করেই এ ধরনের বক্তব্য দিতে পারেন। আবার খালেদা জিয়ার সম্মতি ছাড়া এ ধরনের স্পর্শকাতর বক্তব্য দেওয়া কঠিন বলেও তারা মনে করেন। একইসঙ্গে বিশ্নেষকরা জানান, একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কারামুক্তির সঙ্গে আইনগত বিষয়ের পাশাপাশি রাজনৈতিক বিষয়ও জড়িত রয়েছে। এ বিষয়টিও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।
অবশ্য খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তি চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে আবেদন করার আহ্বান জানিয়েছে সরকারপক্ষ। রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কায় প্যারোলেও মুক্তি নিতে রাজি নন খালেদা জিয়া। তবে জামিনে মুক্তি পেলে উন্নত চিকিৎসায় বিদেশে যাওয়ার ব্যাপারে বোনের বক্তব্যে খালেদা জিয়ার অবস্থানে কিছুটা পরিবর্তন আসতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্নিষ্ট নেতারা।
অবশ্য দীর্ঘ দু'বছরে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে জোরালো কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারলেও হঠাৎ করে সরব হয়ে উঠেছেন বিএনপি নেতারা। দলের চেয়ারপারসনের মুক্তির দাবিতে গতকাল রোববার রাজধানীতে একটি বড় সমাবেশ করেছেন তারা। খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে প্রয়োজনে গণঅভ্যুত্থানের কথাও বলছেন। আদালতের মাধ্যমে তার মুক্তি না হলে রাজপথেই এর ফয়সালা হবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন নেতারা।
খালেদা জিয়ার জামিন খারিজ করে দেওয়া হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে আপিলের শুনানির আবেদনটি প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের কার্যতালিকার ২৮ নম্বরে রয়েছে। মোট ৩৬টি মামলার মধ্যে ইতোমধ্যে ৩৪টি মামলায় জামিন পেয়েছেন খালেদা জিয়া। সাজাপ্রাপ্ত দুটি মামলার মধ্যে আজ জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় জামিন পেলে অপরটি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায়ও আপিল বিভাগ থেকে জামিন পেতে হবে। এ পরিস্থিতিতে আজকের মামলাটির ওপর নির্ভর করছে অপর মামলার ভবিষ্যৎ। আজকের মামলার শুনানি গ্রহণ করে আরও দু-একটি শুনানির সম্ভাবনা রয়েছে। দু-তিন শুনানি শেষে এ মামলায় জামিন পেলে আগামী এক-দুই সপ্তাহের মধ্যে অপর মামলাটিরও শুনানি হতে পারে বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে খালেদা জিয়ার আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন গতকাল বলেন, খালেদা জিয়াকে তার সাংবাবিধানিক ও আইনগত অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। তিনি গুরুতর অসুস্থ। সার্বিক বিবেচনায় খালেদা জিয়ার মুক্তির পথে কোনো বাধা নেই। উচ্চ আদালতে শুনানিতে ন্যায়বিচার পেলে খালেদা জিয়া মুক্তি পাবেন বলে তারা আশাবাদী। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, খালেদা জিয়া আদালতের মাধ্যমেই জামিনে মুক্তি পাওয়া তার মানবাধিকার বলে মনে করেন।
বিএনপি চেয়ারপারসনের অপর আইনজীবী ব্যারিস্টার কাওসার কামাল বলেন, ৭৫ বছর বয়স, শারীরিক অসুস্থতা, সামাজিক অবস্থা, তিনবারের প্রধানমন্ত্রীসহ সবকিছু বিবেচনা করলে তিনি জামিনের হকদার। সাত বছরের মধ্যে দুই বছর তিনি কারাভোগ করেছেন। এর আগেও তিনি জামিনে মুক্ত ছিলেন। জামিনের তিনি কোনো অপব্যবহার করেননি। ন্যায়বিচার পেলে খালেদা জিয়ার জামিনের ব্যাপারে তারা শতভাগ আশাবাদী।
অন্যদিকে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, আইন অনুযায়ী শুনানি হবে। এর চেয়ে বেশি কিছু বলা উচিত হবে না। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেছেন, উচ্চ আদালত উভয়পক্ষের বক্তব্য শুনে সঠিক সিদ্ধান্ত দেবেন। তিনিও এর বাইরে আর কিছু বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
বহুল আলোচিত জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় গত বছরের ২৯ অক্টোবর খালেদা জিয়াকে সাত বছর কারাদ দিয়ে রায় ঘোষণা করেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন খালেদা জিয়া। একইসঙ্গে জামিনের আবেদন করা হয়। হাইকোর্ট গত ৩১ জুলাই জামিনের আবেদন সরাসরি খারিজ করে দেন। এই খারিজের রায়ের বিরুদ্ধে গত ১৪ নভেম্বর আপিল করেন খালেদা জিয়া। এ আবেদনে আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতির আদালত গত ১৭ নভেম্বর এক আদেশে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে ২৫ নভেম্বর শুনানির দিন ধার্য করেন।
সুপ্রিম কোর্ট ও নিম্ন আদালত মিলে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে এখন ১৭টি মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় তার ১৭ বছরের কারাদ হয়েছে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ১০ বছরের সাজার বিরুদ্ধে করা আপিল বিচারাধীন। ওই আপিলের সঙ্গে খালেদা জিয়ার জামিন চাওয়া হয়েছে, যা এখনও আপিল বিভাগে বিচারাধীন। আর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় নিম্ন আদালতের সাত বছরের সাজার বিরুদ্ধে করা আপিল হাইকোর্টে বিচারাধীন। অবশ্য এই মামলায় খালেদা জিয়ার জামিনের আবেদন খারিজ করে রায় দেন হাইকোর্ট। এই খারিজের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন করা হয়। ওই দুই মামলায় জামিন পেলেই মুক্তি পাবেন খালেদা জিয়া।
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বিশেষ জজ আদালত খালেদা জিয়াকে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দিয়ে কারাগারে পাঠান। পরে ২৯ অক্টোবর খালেদা জিয়ার সাজা বাড়িয়ে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেন হাইকোর্ট।
ইনিউজ ৭১/এম.আর
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।