বরগুনার চাঞ্চল্যকর রিফাত শরীফ হত্যা মামলার তদন্ত চলছে। এই হত্যাকাণ্ডের নায়ক সাব্বির আহমেদ ওরফে নয়ন বন্ড কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। এই মামলায় গ্রেফতার হওয়া আসামিদের মধ্যে প্রায় সবাই হত্যার দায় স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। রিফাত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গ্রেফতার হয়েছেন তার স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি। তিনি এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও মামলার প্রধান সাক্ষী। মিন্নিকে গ্রেফতারের পরই ঘটনা ভিন্ন মাত্রা পায়। হত্যা মামলার গতিপ্রকৃতি অন্য দিকে মোড় নেয়। একটি সূত্রে জানা গেছে, রিফাত হত্যায় তার স্ত্রী মিন্নিকে জড়িয়ে অভিযোগপত্র তৈরি হচ্ছে। চার্জশিটে মিন্নির নাম রাখতে তড়িঘড়ি করছে পুলিশ। বরগুনা পুলিশের কর্তাব্যাক্তিরা এখন ঢাকায় অবস্থান করছেন। ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে মিন্নিকে জড়িয়ে চার্জ গঠন করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা। এদিকে রিফাত হত্যার তদন্ত চলছে। তদন্ত করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। রিফাত হত্যার দেড় মাস পরও এই মামলার এজাহারভুক্ত চার আসামিকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। এ বিষয়ে পুলিশের কোনো তৎপরতাও চোখে পড়ছে না।
বরগুনা জেলা পুলিশের একটি সূত্র জানায়, পুলিশ সুপার মো. মারুফ হোসেন ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বরগুনা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) হুমায়ুন কবির কয়েক দিন ধরে ঢাকায় অবস্থান করছেন। মামলার অভিযোগপত্রের ব্যাপারে ‘উচ্চপর্যায়ের’ নির্দেশনা নিতে তারা ঢাকায় অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে। নির্দেশনামাফিক তৈরি হবে চার্জশিট। এদিকে মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোর আগে থেকেই অভিযোগ করে আসছেন যে, এ ঘটনায় মিন্নিকে ষড়যন্ত্র করে জড়ানো হয়েছে। তিনি বলেন, আমি শুনছি, মিন্নিকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেয়ার জন্য পুলিশ জোর তৎপরতা শুরু করেছে। আমি সব সময় বলে আসছি, প্রভাবশালী মহলকে বাঁচাতেই আমার নিরীহ মেয়েটাকে ফাঁসানো হচ্ছে। জীবনের নিরাপত্তা না থাকায় বাড়ি ছেড়ে ঢাকা অবস্থান করছেন বলে জানিয়েছেন কিশোর। তিনি বলেন, আমি অন্যায়ের প্রতিবাদ করার পর থেকে নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছি। প্রাণভয়ে এখন ঢাকায় চলে এসেছি।
রিফাত শরীফ হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি ১২ জন। আর সন্দেহভাজন আসামি ৪ থেকে ৫ জন। প্রধান আসামি সাব্বির আহম্মেদ ওরফে নয়ন বন্ড গত ২ জুলাই পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। এ মামলায় নয়ন বন্ডের বাইরে এজাহারভুক্ত ৭ আসামি এবং মিন্নিসহ সন্দেহভাজন ৮ আসামি মিলিয়ে গ্রেফতার হয়েছেন ১৫ জন। হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী ও নিহত রিফাত শরীফের স্ত্রী মিন্নিকে প্রধান আসামি করা হলে হত্যার অভিযোগ প্রমাণের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে জানান বরগুনার আইনজীবীরা। এ বিষয়ে মামলার তদারক কর্মকর্তা ও বরগুনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. শাহজাহান গণমাধ্যকে বলেন, মামলার তদন্তে অগ্রগতি সন্তোষজনক। বাকি চার আসামিকে ধরতে অভিযান চলছে। অভিযোগপত্র কবে নাগাদ দেয়া হবে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা তদন্ত কর্মকর্তা বলতে পারবেন। মিন্নিকে এই মামলার কত নম্বর আসামি করা হবে, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি এসপি স্যার জানেন’।
এদিকে মিন্নির বাবার পর তার মাও দাবি করেছেন যে, মিন্নির কাছ থেকে জোর করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেয়া হয়েছে। মিন্নির মা মিলি আক্তারের অভিযোগ- মিন্নিকে রিমান্ডে নিয়ে ট্যাবলেট খাইয়ে জবানবন্দি নেয়া হয়েছে। তাকে ভয় দেখিয়ে ও নির্যাতন করে এই জবানবন্দি দিতে রাজি করানো হয়েছে। পুলিশের লিখে দেয়া জবানবন্দি রাতভর মুখস্ত করানো হয়েছে। পরে আদালতে সেই জবানবন্দি দিতে মিন্নিকে বাধ্য করা হয়েছে। সোমবার সন্ধ্যায় বরগুনা পৌর শহরের নয়াকাটা মাইঠা এলাকার বাসভবনে গণমাধ্যমের সঙ্গে এসব কথা বলেন রিফাত শরীফ হত্যা মামলার আসামি আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির মা। এর আগের দিন রোববার মিন্নির মা-বোনসহ তার স্বজনরা কারাগারে তার সঙ্গে দেখা করতে গেলে তাদের কাছে এসব কথা জানান মিন্নি।
মিন্নির বরাত দিয়ে মা মিলি আক্তার জানান, পুলিশের নির্যাতন ও ভয়ে মিন্নি আদালতে পুলিশের লিখে দেয়া জবানবন্দি দিয়েছে। মিন্নিকে ইয়াবা ট্যাবলেট মেশানো পানি খাইয়ে জোর করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেয়া হয়েছে। রিমান্ডের নামে আটকে রেখে রাতভর পুলিশের লিখে দেয়া জবানবন্দি মুখস্থ করানো হয় তাকে। সেই জবানবন্দি না দিলে মা-বাবাকে আটক করে নির্যাতন করা হবে বলেও হুমকি দেয় রিতা নামের এক এএসআই। মেয়ের মুখ থেকে শোনা নৃশংস নির্যাতনের ঘটনা সাংবাদিকদের বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন মিন্নির মা মিলি আক্তার।
তিনি বলেন, ‘রিমান্ডে নিয়ে মেয়েটাকে তিন দিন পুলিশ না খাইয়ে রেখেছে। একটু পানি খেতে চাইলেও তাকে দেয়া হয়নি। বড়ির কথা বলে একপর্যায়ে ট্যাবলেট মিশিয়ে তাকে পানি খেতে দেয়া হয়। পুলিশের লেখা জবানবন্দি মুখস্থ করানোর জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখে। এতে মিন্নি বারবার অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেও পুলিশের মন গলেনি।’ মিন্নির বরাত দিয়ে লিপি আরও বলেন, ‘পুলিশ আমার মেয়েকে বলতে বলে- তুমি আদালতে বলবা, আমার স্বামী তো ভালো না, তাই হালকা পাতলা মাইর দেয়ার কথা বলেছি।’ এমনটি বললে মিন্নির সাজা কম হবে বলে তাকে আশ্বস্ত করে পুলিশ।
মিন্নির সঙ্গে সাক্ষাতের পর তার পরিবারের সদস্যরা জেলগেটে সাংবাদিকদের জানান, রোববার কারাগারে পরিদর্শনে এসে জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ মিন্নির খোঁজখবর নেন। এ সময় মিন্নি তার ওপর যে নির্যাতন চালানো হয়েছে, সে কথা ডিসিকে জানান। তবে ডিসি মিন্নির সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা অস্বীকার করেন। মিন্নির মা আরও বলেন, আমার মেয়ে আমাকে বলেছে- ১৬ জুলাই পুলিশ মিন্নিকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে এসে ১২-১৩ ঘণ্টা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালায়। পুলিশলাইনে একটি কক্ষে এএসআই রিতার নেতৃত্বে ৪-৫ পুলিশ সদস্য তাকে শারীরিক নির্যাতন করেছে এবং মারধর করেছে। এ সময় পানি পান করতে চাইলে তাকে পানিটুকুও দেয়া হয়নি।
রিফাত শরীফ হত্যার আসামি রিফাত ও রিশান ফরাজীকে দিয়েও পুলিশ মিন্নির জড়িত থাকার বিষয়ে জোর করে স্বীকারোক্তি নিয়েছে বলেও দাবি করেন তার মা মিলি আক্তার। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমার মেয়ে জবানবন্দি দিতে অস্বীকৃতি জানালে তার মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে নয়ন বন্ডের মতো গুলি করে মেরে ফেলার হুমকি দেয়া হয়। রিফাত ফরাজী ও রিশান ফরাজীকে আমার মেয়ের সামনে এনে বলতে বলে—বল, তোদের সঙ্গে মিন্নিও জড়িত ছিল। প্রথম দিকে না বললেও পুলিশের চাপে ও শারীরিক নির্যাতনের একপর্যায়ে তারা তা বলতে বাধ্য হয় এবং মিন্নি এ ঘটনায় জড়িত ছিল বলে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়।’
এ সময় মিন্নির মা জানান, মিন্নির আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে গিয়ে তার বাবাকে পুলিশ খুঁজছে। নিজেদের নিরাপত্তাহীনতার কথাও সাংবাদিকদের তুলে ধরে মিন্নির মা বলেন, আমার ছোট্ট ছেলেমেয়েরা আজ স্কুলে যেতে পারছে না। সন্ত্রাসীরা বাড়ির আশপাশে ঘুর ঘুর করছে। প্রসঙ্গত ২৬ জুন রিফাতকে প্রকাশ্য সড়কে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। সে সময় স্বামীকে বাঁচাতে মিন্নির চেষ্টার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সারা দেশে আলোচনার সৃষ্টি হয়। পর দিন রিফাত শরীফের বাবা দুলাল শরীফ ১২ জনকে আসামি করে যে মামলাটি করেন, তাতে মিন্নিকে প্রধান সাক্ষী করা হয়েছিল।
১৬ জুলাই মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বরগুনার মাইঠা এলাকার বাবার বাসা থেকে মিন্নিকে জিজ্ঞাসাবাদ ও তার বক্তব্য রেকর্ড করতে বরগুনা পুলিশলাইনসে নিয়ে যায় পুলিশ। এর পর দীর্ঘ ১০ ঘণ্টার জিজ্ঞাসাবাদ শেষে রাত ৯টায় মিন্নিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পর দিন মিন্নিকে আদালতে হাজির করা হয়। আদালতে তার পক্ষে কোনো আইনজীবী ছিলেন না। আদালত মিন্নির পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর করেন আদালতের বিচারক মো. সিরাজুল ইসলাম গাজী। পর দিন বরগুনার পুলিশ সুপার মো. মারুফ হোসেন সংবাদ সম্মেলনে জানান, মিন্নি তার স্বামী রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। এ হত্যার পরিকল্পনার সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন। এর পর দিন বিকালে মিন্নি একই আদালতে তার স্বামী রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। পরে আদালত তাকে জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
প্রসঙ্গত বরগুনা সরকারি কলেজের মূল ফটকের সামনের রাস্তায় ২৬ জুন সকাল ১০টার দিকে স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির সামনে কুপিয়ে জখম করা হয় রিফাত শরীফকে। বিকাল ৪টায় বরিশালের শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। এ হত্যার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশব্যাপী তোলপাড় শুরু হয়। হত্যাকাণ্ডের পরের দিন রিফাত শরীফের বাবা আবদুল হালিম শরীফ বরগুনা থানায় ১২ জনকে আসামি করে মামলা করেন। এ ছাড়া সন্দেহভাজন অজ্ঞাতনামা আরও চার-পাঁচজনকে আসামি করা হয়। এ মামলার প্রধান আসামি নয়ন বন্ড ২ জুলাই পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। মামলার এজাহারভুক্ত ছয় আসামিসহ এ পর্যন্ত ১৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৪ জনই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।
এদিকে মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হক কিশোরের দাবি, মিন্নির কাছ থেকে জোর করে জবানবন্দি নেয়া হয়েছে। তিনি এ হত্যা মামলার এক নম্বর সাক্ষীকে (মিন্নি) আসামি করা ও রিমান্ডে নেয়ার জন্য স্থানীয় সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুকে দায়ী করে আসছেন। গণমাধ্যমকে তিনি বলেছিলেন, ‘সবকিছুই শম্ভু বাবুর খেলা। তার ছেলে সুনাম দেবনাথকে রক্ষা করার জন্য আমার মেয়েকে বলি দেয়া হচ্ছে।’ শম্ভুর ছেলে সুনামের বিরুদ্ধে কিশোরের অভিযোগ, তার জন্যই এতদিন মিন্নির পক্ষে আদালতে দাঁড়াননি আইনজীবীরা। এ নিয়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বহু সমালোচনার পর বরগুনা ও ঢাকার আইনজীবীদের একটি অংশ মিন্নির পক্ষে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন।
ইনিউজ ৭১/টি.টি. রাকিব
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।